• ফুটবল

দ্য রেড বুল রেভোল্যুশন ইন ফুটবল

পোস্টটি ২৯৬৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
একটা এনার্জি ড্রিংকস কোম্পানি কিভাবে সারা বিশ্বের ফুটবলে বিপ্লব ঘটাতে পারে?
 
বলছিলাম অস্ট্রিয়ান প্রাইভেট কোম্পানি রেড বুলের কথা। গত দেড় দশক ধরে যারা ফুটবলে সুক্ষ্ম ও ধীরস্থির ভাবে ঘটিয়ে চলেছে একের পর এক বিপ্লব। 
 
১৯৮৭ সালের ১ এপ্রিল অস্ট্রিয়ায় প্রথমবারের মতো ব্যবসা শুরু করে রেড বুল কোম্পানি। আর তার ঠিক ৩৩ বছর ১০ মাস পর আজ সারাবিশ্বের ক্রীড়াজগতের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে সেই কোম্পানি টা।
 
কার রেসিং, আইস হকি থেকে শুরু করে ইস্পোর্টস, কোথাও বাকি নেই তাদের পদচারণা। বিশ্বের প্রায় সব খেলার সাথেই সমার্থক হয়ে উঠছে রেড বুল নামটি। তবে তারা সবচেয়ে বেশী আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে তখনই, যখন যুক্ত হয়েছে ফুটবলের সাথে।
 
ফুটবলে রেড বুলের শুরুটা হয় তাদের নিজেদের এলাকা থেকেই। ৬ এপ্রিল, ২০০৫। রেড বুলের যেখানে হেডকোয়ার্টার, সেই সালজবুর্গ শহরের দল এসভি অস্ট্রিয়া সালজবুর্গ কে কিনে নেওয়ার মাধ্যমে ফুটবলে যাত্রা শুরু করে তারা। কিনে নেওয়ার পরপরই তারা দলটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করে এফসি রেড বুল সালজবুর্গ। ক্লাব ম্যানেজামেন্টের পূর্ববর্তী সকল স্টাফকে সরিয়ে দেয়। ক্লাবের নতুন ব্যাজ তৈরি করে, সেই সাথে দলের অফিসিয়াল কিট কালার হিসেবে বেছে নেয় লাল-সাদা। এটি বর্তমানে রেডবুলের সবগুলো দলেরই অফিসিয়াল কালার।
 
কিন্তু শুরুতেই ব্যাপক সমালোনার মুখে পড়ে তাদের এ কার্যক্রম। ক্লাবের নাম, ব্যাজ ও চিরাচরিত বেগুনি রঙ পরিবর্তন করায় অবশ্যম্ভাবী ভাবেই সালজবুর্গ সমর্থকদের রোষানলে পড়ে রেড বুল। সমর্থকরা রেড বুল সালজবুর্গ কে বয়কট করে ও নিজেরা আগের নামে আরও একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে।
 
সেই থেকে এখন অবধি এগারটি অস্ট্রিয়ান বুন্দেসলিগা ঘরে তুলেছে রেড বুল সালজবুর্গ। সেই সাথে গড়ে তুলেছে সাদিও মানে, নাবি কেইতার মতো বড় বড় নাম।
 
image_search_1612093667675
 
রেড বুল এর পরবর্তী গন্তব্য ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে নিউইয়র্ক মেট্রোস্টার্স এর মালিকানা নেয় রেড বুল, নতুন নাম দেয় নিউইয়র্ক রেড বুল। স্বাভাবিকভাবেই এবারও সমর্থকদের রোষানলে পড়তে হয় তাদের। কিন্তু এবার তারা সমর্থকদের মন গলাতেও বেশ তৎপরতা চালায়। শুরুতেই দলে ভেড়ায় থিয়েরি অঁরি, টিম কাহিলদের মতো বড় বড় নাম গুলোকে।
 
নিউইয়র্ক রেড বুলের প্রথম ম্যাচ কে জাঁকজমক করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালায় তারা। শাকিরার কণ্ঠে মার্কিন জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হয় ম্যাচ। এরপর হাফটাইমে শো পরিচালনা করেন ওয়াইক্লেফ জিন। সে ম্যাচের ব্র‍্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে রাখা হয়েছিলো ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলে কে। সর্বোপরি সার্বিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমেই যাত্রা শুরু করে নিউইয়র্ক রেড বুল।
 
তবে নিউইয়র্ক রেড বুল গত এক দশকে কনফারেন্স পাঁচবার জিতলেও এখন অবধি কোনো এমএলএস কাপ ঘরে তুলতে পারেনি। ২০০৯ সালে হয় রানার্সআপ, একইভাবে ২০১৭ সালে ইউএস কাপের ফাইনালে গিয়ে পরাজিত হয়। সেই সাথে টানা দুইবার কনকাকাফ চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমি ফাইনালে গিয়ে ফিরে আসতে হয়।
 
image_search_1612093778686
 
তবে নিউইয়র্ক রেডবুলের সাফল্য না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো জার্মানিতে লিপজিগের উত্থান। লিপজিগের উত্থানের পরপরই রেড বুল এই ক্লাবটিতে পূর্ণ মনোযোগ দেয়। ফলে নিউইয়র্ক অনেকটা পরিণত হয় লিপজিগের একাডেমীতে। ২০১৮ সালে নিউইয়র্কের হেড কোচ জেসে মার্শ নিউইয়র্ক ছেড়ে জার্মানি তে চলে আসেন ও অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচ হিসেবে যোগ দেন। আরও আসেন ২০ বছর বয়সি মার্কিন তরুণ প্রতিভা টাইলার এডামস, যোগ দেন লিপজিগে। 
 
রেড বুলের প্রধান লক্ষ্য সবসময়ই ছিলো জার্মান বুন্দেসলিগা। অবশেষে ক্লাব অধিগ্রহণের জন্য ডিএফবির অনুমতি পাওয়ার পরে সেই লক্ষ্য অর্জন একদমই সহজ হয়ে যায়।
 
অবশেষে জার্মান ফুটবলের পঞ্চম স্তরের দল এসএসভি মার্ক্রানস্তাদের মালিকানা অধিগ্রহণ করে রেড বুল কোম্পানি। সেই সাথে ক্লাবের আগের অস্তিত্ব মুছে ফেলে ২০০৯ সালের ১৯ মে দলটিকে পূর্ণাঙ্গ ভাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়। লিপজিগ শহর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার পশ্চিমে হওয়ায় সে শহরের নামেই ক্লাবের নামকরণ করা হয়। দলটির নাম রাখা হয় আর বি লিপজিগ।
 
কিন্তু এবারেই সবচেয়ে বেশি সমালোনার মুখে পড়ে রেড বুল।
 
বুন্দেসলিগায় বেশ কিছু আইন প্রচলিত আছে। সে অনুযায়ী কোনো ক্লাবের মালিকানা ৪৯% এর বেশি কোনো একক ব্যক্তি অথবা একক কোম্পানির নামে থাকা যাবেনা। কোনো ক্লাবের নামের সাথে কোনো স্পনসর নাম থাকতে পারবেনা এবং লোগোর মাঝেও কোনো স্পনসর এর লোগো নিষিদ্ধ। 
 
কিন্তু এসব নিষিদ্ধ সবকিছুই আর বি লিপজিগ করেছে আইনের ফাঁক-ফোকর কে কাজে লাগিয়ে। ক্লাবের নাম রেখেছে রেড বুলের আর বি ব্যবহার করে, কিন্তু এর অফিসিয়াল নাম হচ্ছে রাসেনবলস্পোর্ত, যার অর্থ দাঁড়ায় “ঘাসের ওপর বলের খেলা”। ক্লাবের লোগোটিও রেড বুল কোম্পানির লোগোর সাথে মিল করে বানানো হয়েছে এবং মালিকানার বিষয়টি সলভ করার জন্য আলাদা একটি হোল্ডিং কোম্পানি বানানো হয়েছে যেই কোম্পানির মেম্বার্সরা হচ্ছে রেড বুল এর লোকজন। লিপজিগ জার্মানির একমাত্র ক্লাব, যেখানে সমর্থদের প্রত্যক্ষ কোনো ভোটাধিকার নেই।
 
image_search_1612093529551
 
এতে রেড বুল ক্লাবের সবকিছুর সাথে কানেক্টেডও থাকতে পারছে, আবার আইনও ভঙ্গ হচ্ছেনা। কিন্তু এভাবে আইন এর চোখকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও মানুষের চোখ কে তো আর ফাঁকি দেওয়া যায়না। আর সেজন্যই সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পুরো জার্মানিতেই ব্যাপক সমালোনার মুখে পড়ে লিপজিগ।
 
সে সমালোচনা অতি তীব্রতা ধারণ করে যখন বুন্দেসলিগায় প্রোমোশন পায় এবং সেখানে আধিপত্য বিস্তার করে চ্যাম্পিয়নস লিগেও জায়গা করে নেয়। বুন্দেসলিগার চিরাচরিত রীতি ভঙ্গের অভিযোগে শুরু থেকেই জার্মানির সর্বত্র লিপজিগের বিরুদ্ধে প্রটেস্ট গড়ে ওঠতে থাকে। 
 
তবে দলের উন্নয়নের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে সমর্থকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে গোড়া থেকেই। ২০০৬ সালে সূচনালগ্নে যেখানে গড় দর্শক ছিলো ২,১৫০ জন, ২০১৬ সালে বুন্দেসলিগায় প্রোমোশন পাওয়ার পর সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১,৪৫৪। 
 
কিন্তু তারপরও সমর্থকদের মনে অসন্তুষ্টি থেকেই যাচ্ছিলো। কারণ অন্যান্য ক্লাবের সমর্থকরা ক্লাবে যতটা ভূমিকা রাখতে পারতো, লিপজিগ ফ্যানরা তা পারতোনা।
 
তবে শুধু লিপজিগই জার্মানির একমাত্র ক্লাব নয়, যাদের মালিকানা কোনো কোম্পানির হস্তগত। বায়ার লেভারকুসেন পুরোপুরি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি বায়ার এর মালিকানাধীন। ভল্ফসবুর্গও গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি ভক্সওয়াগন এর সাথে সংযুক্ত। কিন্তু এ উভয় ক্লাবই স্থানীয় কমিউনিটির সাথে জোরালোভাবে কানেক্টেড।
 
তবে ক্রমান্বয়ে লিপজিগও বুন্দেসলিগার অন্যান্য ক্লাবগুলোর মতো হয়ে উঠছে। বর্তমানে তাদের "দ্য রেড এইসেস" নামে নিজস্ব আল্ট্রাস সমর্থক গ্রুপও রয়েছে।
 
উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে ক্লাবের কোচ হিসেবে নিয়ে আসা হয় জুলিয়ান নাগলসম্যান কে। আর তার হাত ধরে গত সিজনে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমি ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিলো লিপজিগ। এমনকি বুন্দেসলিগাতেও বায়ার্ন মিউনিখের একক আধিপত্য ঘুঁচিয়ে লিগ জয়ের দিকেও অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু শেষদিকে গিয়ে বেশকিছু অঘটনের শিকার হয়ে তা আর হয়ে ওঠেনি।
 
image_search_1612093497951
 
ফুটবলে বর্তমানে বেশকিছু শক্তিশালী কোম্পানির আগমন ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে সিটি গ্রুপ, রেড বুল প্রভৃতি। কিন্তু অন্যান্য কোম্পানির সাথে রেড বুল এর কার্যগত বেশকিছু পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন, সিটি গ্রুপের আন্ডারে বর্তমানে ম্যানচেস্টার সিটি, নিউইয়র্ক সিটি, মেলবোর্ন সিটি, জিরোনা সহ বেশ কিছু দল আছে। কিন্তু কাজের পলিসির দিক থেকে রেড বুল থেকে তারা একদমই আলাদা।
 
সিটি গ্রুপের দলগুলোর পলিসি হলো প্রচুর পরিমাণে ইনভেস্টমেন্ট এবং দ্রুত উন্নতি লাভ। কিন্তু রেড বুল এর কাজগুলো সব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনামাফিক। তারা সারা বিশ্ব থেকে খাঁটি জহুরীর মতো প্রতিভা বেছে আনে। অতঃপর তাদের সার্বিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আস্তে আস্তে তারকা তৈরি করে। আর ফুটবলের সার্বিক অগ্রগতির জন্য এটি অপরিহার্য। রেড বুল এর ফুটবলে বিপ্লব সাধনের পেছনে এই কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
 
রেড বুল এর হাত ধরে ইতিমধ্যেই অসংখ্য তারকা ফুটবলার তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে জশুয়া কিমিচ, সাদিও মানে, আর্লিং হাল্যান্ড, নাবি কেইতা, টিমো ভার্নার, দায়োত উপামেকানো প্রভৃতি। আরও অসংখ্য তরুণ প্রতিভা নিয়ে কাজ করছে তারা, যারা হয়তো অদূরেই তারকা বনে যাবে।
 
রেড বুল ফুটবলে একটা সুগন্ধি ফুল, যেটা কেবল ফুটতে শুরু করেছে। আর তাদের যে সুষম পরিকল্পনামাফিক কর্ম বিন্যাস, তাতে অচিরেই বিশ্ব ফুটবলের সবখানে সৌরভ ছড়াবে এই রেড বুল।