• ক্রিকেট

আবির ও রাজ স্মরণে কৈশোর খাতার একটি পাতা

পোস্টটি ১৮৯৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

তখন শীতের প্রকোপ কমে এসেছে প্রায়। নতুন বছরে আতিথ্য গ্রহনে উপস্থিত জিম্বাবুয়ে। বর্ণবাদ ও দুষ্ট রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে ক্ষয়িষ্ণু ও অনভিজ্ঞ জিম্বাবুয়ের নেতৃত্বে টাটেন্ডা টাইবু; ভ্রম হতে পারে স্কুল পালানো কোনো ফাঁকিবাজ বালক বুঝি! বাংলাদেশ ক্রিকেটও নবীন-প্রাণে ভরপুর, তবু প্রতিপক্ষ বিবেচনায় ফেভারিটের তকমা সেঁটে গেছে আয়োজকদের কাঁধে। 

 

এনামুল হক অবসরে গেছেন, মোহাম্মদ রফিক খেলছেন তখনো। তবে বয়স হয়ে গেছে মোহাম্মদ রফিকের, তাঁর পরে স্পিন-দুর্গ সামলাবেন কে? বহু তরুণের বাঁহাত ঘুরছে, কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট নির্ভার করার মতো যোগ্য কাঁধ বা হাত পায়নি তখন পর্যন্ত। এনামুল জুনিয়রের ঘূর্ণিতে লা-জওয়াব জিম্বাবুয়ে, ঢাকা টেস্টে ১২ উইকেট প্রাপ্তিতে রেকর্ডবুকে কত আঁকিবুকি তাঁর। নাফিস ইকবালও পেয়েছেন সেঞ্চুরি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অলটাইম  ক্ল্যাসিকে ঢুকে গেছে যা - ক্ল্যাসিক ওয়ান টুয়েন্টি ওয়ান। নাফিস ও এনামুল জুনিয়র দু'জনেরই জুটে গেছে সিটিসেলের পূর্ব ঘোষিত গাড়ির মালিকানা। ওডিয়াই সিরিজেও নাফিসের ব্যাটে রান, আর মানজারুল ইসলাম রানার অনবদ্য বোলিং। দারুণ বোলিং অলরাউন্ডার রানা, নিপুণ বোলিংয়ের সঙ্গে ব্যাটিংটাও ভালো পারেন। তাহলে কি বাংলাদেশ পেয়ে গেছে রফিকের উত্তরসূরী? টেস্টে এনামুল হক জুনিয়র যদি সামলান, আর ওয়ানডে ক্রিকেটে মানজারুল ইসলাম রানা? নাফিস ইকবাল ওপেনিংয়ে চিরস্থায়ী সমাধান দেবেন বলেই বিশ্বাস। 

 

ঐতিহাসিক ওডিয়াই ও টেস্ট সিরিজ বিজয়ের মহা আনন্দমুখর সময়ের কোথাও শাহরিয়ার নাফিস ও আব্দুর রাজ্জাক নেই। অন্তত আমাদের কিশোর মননে ও ভাবনার দূর দিগন্তে তো নেই-ই। 

*****

 

আব্দুর রাজ্জাক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলেছিলেন, কিন্তু মনে রাখার মতো ছিলেন না। তারও আগের অভিষেকটাও এমন কিছু স্মরণীয় ছিল না। শাহরিয়ার নাফিস তো ছিলেনই না সেবার। তবে মাস কয়েক পর বিলেত সফরে সঙ্গী হলেন নাফিস। সেখানে আবার আব্দুর রাজ্জাক নেই। নাফিস ইকবালের ক্রমাগত ব্যর্থতায় তাঁর  স্থলাভিষিক্ত হলেন শাহরিয়ার নাফিস। নাফিসের অন্তর্ভুক্তির আরো একটি যুক্তি শোনা গিয়েছিল - বাংলাদেশ টপ ও মিডল অর্ডার জুড়ে কেবলই ডানহাতি ব্যাটসম্যান, কোনো বাঁহাতি নেই। বামহাতি শাহরিয়ার নাফিস ব্যাটিংয়ে বৈচিত্র্য আনয়নে কিঞ্চিৎ সহায়ক হবেন। আরো একটি যুক্তি শোনা যেত তখন, যা অপ্রীতিকর এবং শাহরিয়ার নাফিসের সামর্থ ও প্রতিভার জন্য বেশ অবমাননাকর। প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ সম্পর্কে খালাতো ভাই হন শাহরিয়ার নাফিসের। নির্বাচক হিসেবে ফারুক আহমেদ অনমনীয় চরিত্রের, তাই নানান তির্যক মন্তব্য বা উড়ো কথায় কান দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশে ও জাত চেনাতে নাফিসও সময় নেননি, দ্বিতীয় ম্যাচেই লি-ম্যাকগ্রা-গিলেস্পিদের সামলে ৫৭ বলে ৪৭ রানের চমৎকার ইনিংস, আশরাফুলের সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে প্রায় ছয় রান রেটে ৯০ রানের জুটি। যদিও মিডল অর্ডারের আচমকা কলাপ্স ও সায়মন্ডসের ক্ল্যু-হীন নিরীহ অফ স্পিনে নাকাল হয়ে এত চমৎকার জুটিটার কোনো মর্যাদা দিতে পারেনি বাংলাদেশ। ক্যারিয়ারের চতুর্থ ম্যাচেই প্রথম ফিফটি, সে-ই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ১১৬ বলে ৭৫ রান, ১৯/৩ এর ধ্বংসস্তুপ ও ৭৫/৫ এর মতো ধ্বসে পড়া যমীনে দাঁড়িয়ে। 

 

শাহরিয়ার নাফিস তারপর খুব দ্রুতই বাংলাদেশ ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হন। পরের বছর এক ক্যালেন্ডারে হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন। একাধিক সেঞ্চুরির মালিক বনে যান, যা বাংলাদেশ ক্রিকেটে একদা অচিন্তনীয় ছিল। শাহরিয়ার নাফিস এমন অনেক কিছুই বাংলাদেশ ক্রিকেটে উপহার দেন, যা আগে দেখেনি এই দেশের ক্রিকেট জনতা। ভাবেওনি কোনোদিন।

***** 

 

আব্দুর রাজ্জাক নিয়মিত হন ২০০৬ সালে। এনামুল জুনিয়র সুবিধা করতে পারেন না, রানাও শুরুর সেই ফর্ম ধরে রাখতে পারেন না, সবমিলিয়ে সুযোগটা সামনে চলে আসে আব্দুর রাজ্জাকের। সেই বছরের শীর্ষ উইকেট সংগ্রাহকদের একজন হয়ে যান তিনি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফাইফারও পেয়ে যান। রফিক-রাজ-সাকিব তিন বাঁহাতি ঘিরে বাংলাদেশ নতুন ব্র্যান্ড তৈরী করে। বাঁহাতি-ত্রয়ী হলেও, তিনজনের বোলিং তিন ধরণের। আব্দুর রাজ্জাক কিপ্টে বোলিংয়ে পৌঁছে যান অন্য চূড়ায়। ধীরে ধীরে ওয়ানডে ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হন। বিশ্বকাপগামী বিমানে তাঁর বদলে অন্য কাউকে ভাবতেই পারেননি নির্বাচক ও টিম ম্যানেজমেন্ট। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে শচীন টেন্ডুলকারের উইকেটের পর তাঁর উল্লাস, মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে তাঁর সেলিব্রেশন-নাচ, যা পুরো দলেরই নাচ বা সেলিব্রেশনের রকম ছিল সেবার - যেন চোখে ভাসে এখনো। সিরিয়াস, গম্ভীর ও মুডি চরিত্রের আব্দুর রাজ্জাক চিরচেনা সমস্ত আবরণ ছিঁড়ে যেন আরেক ঢঙে উদ্ভাসিত। ২০১১ বিশ্বকাপে, 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে'র পরের সপ্তাহে অসম্ভব আবেগঘন ও আনন্দমুখর শুক্রবারের সূচনায়, চট্টগ্রামে ম্যাট প্রায়রের হতবুদ্ধ হওয়া, মুশফিকুরের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের স্ট্যাম্পিং, রাজের উচ্ছ্বাস - সেও কি ভোলা যায়?

 

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক আছে তাঁর। যা কিনা দেশের মাটিতে কোনো বাংলাদেশীর প্রথম আন্তর্জাতিক হ্যাটট্রিক। তার আগে অলক কাপালির টেস্ট হ্যাটট্রিকে হেরেছিল বাংলাদেশ, শাহাদাত হোসাইনের প্রথম ওডিআই হ্যাটট্রিকেও ব্রেন্ডল টেলরের কাছে হারতে হয়েছিল। প্রথমবারের মতো কোনো হ্যাটট্রিকে জয় পায় বাংলাদেশ। প্রথম দুইশো উইকেটের মাইলফলকও তাঁর হাত ধরে। আরো কত প্রথমের সাক্ষী তিনি, রুপকার তিনি, বাংলাদেশ ক্রিকেটে আব্দুর রাজ্জাক রাজের রাজকীয় উপস্থিতিই ছিল একসময়।

***** 

 

ভুরি ভুরি বাঁহাতি স্পিনারের দেশে সুদীর্ঘ সময় দাপটের সঙ্গে খেলে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। দলে সাকিব আল হাসানের মতো অলরাউন্ডার থাকার পরও আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন দলের অপরিহার্য সদস্য। সাকিব বলতেন, তিনি মাঠে কোনো সমস্যা মনে হলে, পিচের আচরণ না বুঝলে কথা বলেন আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে। হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ আশরাফুল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম পর্যন্ত সকল অধিনায়কের অন্যতম ভরসা ছিলেন রাজ। পাওয়ার প্লে-তে বোলিং দরকার, স্লগ ওভারে দরকার, জুটি ব্রেকে দরকার, রান আটকাতে দরকার... যখন অধিনায়ক তাঁর পানে চেয়েছেন, বল তুলে দিয়েছেন, তিনি সামর্থ্যের সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন। বাঁহাতি স্পিনারের খনি যে বাংলাদেশ, সেখানে তিনি টানা খেলেছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে। তাঁর পরে অর্ধযুগ গত হলেও নির্ভর করার মতো কোনো স্পিনারে থিতু হতে পারেনি বাংলাদেশ। জেদ, পরিশ্রম ও নিবেদন - যা তাঁকে বাকি বাঁহাতি স্পিনার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। তিনি কিছুতেই হাল ছাড়ার মানুষ নন।

 

হাল না ছাড়া ও জেদী ক্রিকেটারের আদর্শ উদাহরণ শাহরিয়ার নাফিসও। রিচার্ড ম্যাকিন্স তাঁর গুরু ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গী হয়ে বাংলাদেশে আসেন ২০০৬ সালে। ফতুল্লা টেস্টের আগের দিন হোটেল লবিতে ম্যাকিন্সকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে যান নাফিস, পরদিন বিশ্বমানের বোলারদের সামলাতে হবে, গুরু থেকে যদি কিছু টিপস মেলে। নাফিসের হাতে নতুন বুটজোড়া দেখে ম্যাকিন্স বলেন, ওসব তেমন নতুনই রয়ে যাবে। 

ইঙ্গিতটা পরিষ্কার - বিশ্বের বাঘা বাঘা বোলারের সম্মুখে কতক্ষণই আর টিকবে, বাছা? জুতা পুরনো হওয়ার সুযোগ কই? তেতে উঠেন নাফিস। পরদিন রুপকথার মতো ১৩৮ রানের এক ক্ল্যাসিক উপহার দেন। ম্যাকগিল-ওয়ার্নদের গলির বোলার বানিয়ে ওভারপ্রতি প্রায় চার রান রেটে বাংলাদেশ প্রথমদিনেই পেরিয়ে যায় সাড়ে তিনশো! ম্যাকিন্স পরে জানিয়েছিলেন, নাফিস তাঁর হাতে গড়া। সুতরাং তিনি জানতেন কেমন খোঁচা বা বিদ্রুপে তেতে উঠেন নাফিস। জেদী শিষ্যের অমন লড়াকু জেদ দেখে নিশ্চিতভাবেই পুলক বোধ হয়েছিল ম্যাকিন্সের।

 

সে বছর নাফিসের ব্যাটে ছিল রানের ফল্গুধারা। বছরজুড়ে রানমেশিনের মতো রান করে যাওয়ার পুরষ্কারও জোটে, বর্ষসেরা ক্রিকেটারের খেতাব পান তিনি। স্ত্রী নিয়ে উপস্থিত হন সেখানে, আমরা হিসেব মেলাতে পারি না - সঙ্গীনীটি কে আসলে? অত অল্প বয়সে বিয়ে করেছেন তা বোঝার মতো মস্তিষ্ক ছিল না আমাদের। পরে নাফিসই বলেছেন, তাঁর ক্যারিয়ারে স্ত্রীর অনবদ্য ভূমিকার কথা। তাঁর জীবনে যত অর্জন, যত প্রাপ্তি, সমস্ত নাকি স্ত্রী-গুণেই সম্ভব হয়েছে।

***** 

 

আইসিএল-ঝড়ে লন্ডভন্ড বাংলাদেশ ক্রিকেট, যে কয়েকটি সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে সবচেয়ে অসহায় বোধ করেছিল, আর্তনাদ উঠেছিল হৃদয় গভীরে - শাহরিয়ার নাফিস তার মধ্যে একটি। অমন দুরন্ত সম্ভাবনাকে পায়ে মাড়িয়ে নিয়তির কোন অসম্ভব সুতোর টানে যে গিয়েছিলেন সেখানে, কে জানে! ২০০৭-এর বিশ্বকাপটাও কেমন রহস্যঘেরা। রান করাটাকে জগতের সবচেয়ে সহজ করে নেওয়া নাফিস, ব্যাটিংয়ে একদম নবিস বনে গেলেন। ফলে সহ-অধিনায়কত্ব চলে যায়, জাতীয় দলের ভবিষ্যৎ নেতাও হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। কেমন একটা দিশেহারা অবস্থা - শুধু নাফিসের মধ্যে নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের নেতৃত্বেও। আইসিএল থেকে ফিরে সেই দাঁতে দাঁত চাপা লড়াকু নাফিসের দেখা মিললেও তা ছিল অনিয়মিত, কদাচিৎ। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯৭ রানের ইনিংসটা তো এখনো যেকোনো তরুণ বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের জন্য এক উজ্জ্বলতর শিক্ষা। অবশ্য পাঠ্য। টেস্ট কীভাবে খেলতে হয়, বিশ্বমানের বোলিং সামলাবে কী করে, প্রতিকূল পরিবেশে যত ঝড়ঝাপটা সামলে লক্ষ্য অবিচল থাকার কঠিন শিক্ষা সেই ইনিংসে বিদ্যমান। বিপিএলে সেঞ্চুরিটা হয়ে আছে আদর্শ বিজ্ঞাপন - কোনো অবস্থাতেই নিজেকে হারতে দেয়া চলবে না। লড়াইটা নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, লোকে যা-ই বলুক হার মানা যাবে না।

 

আব্দুর রাজ্জাকও ছিলেন হার মানতে নারাজ। ঘরোয়া ক্রিকেটে দিনের পর দিন পারফর্ম করে গেছেন। বুড়িয়ে যাওয়ার অপবাদ গায়ে মাখেননি। পাল্লা দিয়ে লড়েছেন তরুণদের সঙ্গে। তাঁর দুর্দান্ত ধারাবাহিকতার প্রতিদান স্বরুপ টেস্ট দলে ডাকও পান তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ছয় শতাধিক উইকেট, সর্বোচ্চ ফাইফার ও ম্যাচে দশ উইকেট; বাংলাদেশে তাঁর কাছাকাছিও নেই আর কেউ। সত্যিকার অর্থেই তাঁর লড়াইটা আসলে ছিল নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার।

*****

 

আব্দুর রাজ্জাকের বিদায় ব্যথিত করে, বিরক্তিও দেয়, হতাশও করে। এই বয়সেও যেমন খেলছিলেন, চাইলে আরো খেলে যেতে পারতেন নিশ্চয়। ভিনদেশী অনেককে দেখা যায়, চল্লিশ পেরিয়েও খেলছেন স্বচ্ছন্দে, অনেকে থামেন না পঞ্চাশেও। রাজের রাজত্ব চাইলে আরো বিস্তৃত করা যেত। সাতশো-আটশো বা হাজার উইকেট? হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি জানি, খটখট করে লেখা যেমন সহজ, বাস্তবতা তেমন নয়। তবু একজন হাজার উইকেটধারীর স্বপ্ন যদি কেউ দেখিয়ে থাকেন তিনি আব্দুর রাজ্জাকই। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে সিরিয়াসলি নিয়ে পেশাদারিত্বের সঙ্গে লড়াইটা চালিয়ে যাওয়াও শিখিয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক। মুশফিকুরের 'বল লালা বল' মিস করি সেই কবে থেকে, এখন থেকে মিস করবো তাঁর পর্বত-ছোঁয়া সমস্ত অর্জন। 

 

আব্দুর রাজ্জাক তবু সামর্থ্যের প্রকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন, অথচ শাহরিয়ার নাফিস শুরুর সেই সম্ভাবনা কতটাই বা অনূদিত করেছেন পরে? তাঁর ক্ষেত্রে কী হয়েছেন বা কতটা করেছেন তারচেয়েও বড় প্রশ্ন - কতটা যেতে পারতেন, কী করতে পারতেন! দুর্ভাগ্যটা নাফিসের নয় কেবল, পুরো বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই। তামিমকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে, একযুগেরও বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে একজন যোগ্য ওপেনিং সঙ্গীর অভাব কতটা বোধ করেছেন তিনি। বিশ্বের তাবৎ জাঁদরেল ব্যাটসম্যানদের ঘোল খাওয়ান শেন 'দ্য ম্যাজিশিয়ান' ওয়ার্ন, আর শাহরিয়ার নাফিস সেই ওয়ার্নকেই ঘোল খাইয়ে ছিলেন আশ্চর্য সাবলীলতায়। হায় আফসোস, তেমন একজন ব্যাটসম্যানের সক্ষমতার সম্পূর্ণ প্রকাশ আমরা দেখতে পারিনি!

*****

 

আমাদের কৈশোরে নানান মন খারাপের মুহূর্ত - হয়তো ব্যাকরণ বইয়ের ভেতর লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়তে গিয়ে মায়ের কাছে বকা খেয়েছি, বা বিকেলের সবকটা ম্যাচ হেরেছি, বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া, বোনের সাথে মান-অভিমান; অনেক সময় সেসব ভোলার উপায় হয়েছিলেন আব্দুর রাজ্জাক বা শাহরিয়ার নাফিস। বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটু একটু করে দিন বদলের দারুণ দুই কুশীলব কত সময় রাঙিয়েছেন আমাদের! কত স্বপ্ন, কল্পনার কত আঁকিবুঁকি, অঙ্ক খাতায় নিজের মতো করে গড়া একাদশ বা স্কোয়াড... কত কিছুর সাক্ষী দুইজন! সেই তাদের বিদায়, আচমকা যেন মনে করিয়ে দেয় কৈশোরের দিনগুলি এই সেদিন নয়, পেরিয়ে এসেছি বহু বছর হয়ে গেছে! 

 

আব্দুর রাজ্জাক রাজ! ক্রিকেট ক্যারিয়ারের মতোই নতুন দায়িত্বেও আপনার রাজ বিরাজমান হোক।

শাহরিয়ার নাফিস আবির! আপনার ব্যাটিংয়ে যেমন মুগ্ধতার আবির ছড়াতেন, তেমনই আবির ছড়িয়ে দিন নতুন পরিচয়েও। 

আপনাদের দু'জনের জন্যেই শুভকামনা। অনাগত আগামী, নতুন দায়িত্ব ও পরিচয়ে রঙিন হোক আরো।