নিরব প্রস্থান কি তবে এটাকেই বলে, আগুয়েরো?
পোস্টটি ১৭০৮ বার পঠিত হয়েছেম্যাচের বয়স তখন ৯০ মিনিট ছুঁইছুঁই করে। স্কোরকার্ডে স্পষ্ট ভাসছে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের মাহাত্ম্য। সিটির বিপক্ষে তারা এগিয়ে আছে ২-১ গোলের ব্যবধানে। ডাগআউটে রাগে ফুঁসছেন রবার্তো মানচিনি। তাকে দেখাচ্ছে ভেজা বারুদের মতো। সাবলীল খেলা খেলছে কুইন্স পার্ক, এ যেন নিত্যদিনের মতোই একটি সাধারণ ম্যাচ। অবশ্য তাদের হারাবারও কিছু ছিল না এ ম্যাচে। তবে জেতা’টা বোধহয় খুব প্রয়োজন সিটির- এ কথা যে কেউ বলে দিতে পারবে খেলার আবহ দেখলেই। জাবালেতা- কম্পানিরা উঠে এসেছেন এট্যাকে, থ্রো নিচ্ছেন জো হার্ট! নাসরি- সিলভা পরপর দুটো কর্নার নিলেন বটে, তবে তা ব্যর্থ হলো। তবু থেমে থাকলোনা সিটি, আক্রমনের মাত্রা বরং খানিকটা বাড়িয়েই দিলো।
সিলভা দাঁড়িয়ে আছেন কর্নার নেবেন বলে; একের পর এক আক্রমনে দিশেহারা কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স বক্সে যেকো’কে মার্কিং করতে ভুলে গেলো। যেকো ঝোপ বুঝে কোপ মারলেন। আনন্দে ভাসালেন পুরো স্টেডিয়াম। ধারাভাষ্যকারকে বলতে শোনা গেলো, 'হোয়াট আ গ্রেট হেডার, সিটি স্টিল এলাইভ!'
জ্বি, সিটি তখনো বেঁচে আছে।
তবে কঠিন সমীকরণের মুখোমুখি তারা। ম্যাচ জিততে পারলেই কেবল লীগ জেতা সম্ভব। সান্ডারল্যান্ড'কে মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে হারালো ম্যাঞ্চেষ্টার ইউনাইটেড, ৮৭ পয়েন্ট নিয়ে তখন তারা লীগ লিডার! এদিকে ইতিহাদে চলছে নীরব বিপ্লব। নাটকিয়তা মূহুর্তে মূহুর্তে। যেকো'র গোলে ২-২ এ সমতা আনার পরও যে অলীক কিছু বাস্তবে ঘটতে পারে তা অন্তত স্টেডিয়ামে বসে থাকা দর্শকদের হাবভাব দেখে বুঝা যাচ্ছিলোনা। তাদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে কাঁদছে, কেউ মাফলার খুলে ইচ্ছেমত চেয়ার পেটাচ্ছে! কেউবা আবার রাগে, ফ্রাষ্ট্রেশনে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দিচ্ছে। এখানে একজন তখন নিরব। হয়তো স্নায়ুযুদ্ধ চলছে তার রক্তের শিরায় শিরায়। তবে কে জানতো তার পায়ের দু'সেকেন্ডের এক জাদু ইতিহাস বদলে দিতে যাচ্ছে!
অতিরিক্ত সময় শেষ হতে এখনো বাকি আছে মিনিট তিনেক। লীগ শিরোপা জেতার জন্য প্রয়োজন ৩ পয়েন্ট। আর ৩ পয়েন্টের জন্য চাই আরেকটা গোল। সে সময়, গ্যালারিতে বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকা দর্শকদের মনের আকুতি প্রার্থনা হয়ে পৌছালো ঈশ্বরের দরবারে। প্রার্থনায় তোলা হাত তখনো নামেনি; বালোতেল্লি বক্সের বাইরে পড়ে গিয়েও যেন আলতো করে বলটা বাড়িয়ে দিলেন তার উদ্দেশ্য। সামনে থাকা ১ জন ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করলেন, আরেকজন! তারপর হাল্কা বাকনিয়ে যেই শুট করলেন; গ্যালারি কি ডাগআউট! ১২০ গজের পিচ কি পুরো ম্যাঞ্চেষ্টার শহর! আনন্দের এক গনজোয়ারের তোড়ে ভেজা বারুদ তখন শুকিয়ে স্ফুলিঙ্গ হয়ে ভাসছে ইতিহাদে! জার্সিটা তৎক্ষণাৎ খুলে ফেলে বুনো উল্লাসে মেতে উঠলেন তিনি। টিভিতে তখন কেবলই এক সুর- আগুয়েরোওওওওওওওওওওওওওওওওওও!
সেদিনের সে কাব্যগাঁথা রচনা করতে আগুয়েরো সময় নিলেন কয়েকটা সেকেন্ড, একটা দীর্ঘশ্বাস আর এক পলক চাহনি! যেখানে ম্যাঞ্চেষ্টার সিটি সময় নিলো দীর্ঘ ৪৪ টি বছর! ইতিহাদে এক মহানায়কের নাম পাকাপোক্তভাবে লিখে ফেলা হলো! মহানায়ক বলা'টা কি খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো? প্রশ্নটা সিটি ফ্যানদের করলে নিশ্চয়ই নিরাশার বাণী শুনতে হবে না। সেবারই প্রথম সিটিতে আসলেন সার্জিও কুন আগুয়েরো; সেবারই প্রথম ইপিএল শিরোপা। মহানায়কেরা এভাবেই আসেন, দেখেন, জয় করেন।
আমার দিব্যি মনে আছে ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকের কথা। ফাইনালে নাইজেরিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মতো জয় করে নিলো শিরোপা, গোল্ড মেডেল! রিকুইলিমে, মারিয়া- জাবাতেলা মেসিদের সাথে সেবার বুনো উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন ঠগবগে তরুণ আগুয়েরো। এরচেয়ে বেশি আনন্দিত তাকে লাগছিলো ২০০৭ অনুর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ ফাইনালের মঞ্চে! কি দুর্দান্ত পারফর্মেন্স-ই না করেছিলো আগুয়েরো। শিরোপার পাশাপাশি ভাগিয়ে নিয়েছিলো গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বল দুটোই!
যদিও তার পটেনশিয়ালিটি বুঝতে পেরে ন্যাশনাল টিম ম্যানেজমেন্ট তাকে সিনিয়র দলে খেলার টিকেট দিয়ে দিয়েছিলো ২০০৬ সালেই। অভিষক হয়েছিলো তাও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের সাথে। '০৫ সালে অভিষেক হয়েছিলো অনুর্ধ্ব-২০ দলে। সেবার বিশ্বকাপ জিতে নিজেকে প্রমান করার সুযোগটা যেন খুব সহজেই পেয়ে গিয়েছিলো সে। অবশ্য নিজেকে প্রমান সে বরাবরই করেছে। মাত্র ৯ বছর বয়সে তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে দলে টেনেছিলো স্থানীয় 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইয়ুথ টিম'। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হতো, তোমার জীবনের লক্ষ্য কি? আগুয়েরো হাত নেড়ে কথা বলার ফুলঝুরি উড়াতো আর বলতো, 'একদিন আমি আমার দেশের হয়ে খেলবো। ওপাশ থেকে হয়তো কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, অবশ্যই! একদিন তুমি এদেশের বড় তারকা হবে..
তারকা তো আগুয়েরো বছর পনের না পেরোতেই হয়ে গিয়েছিলো। প্রিমেরা ডিভিশনের সবচেয়ে কম বয়েসী প্লেয়ার হিসেবে তার অভিষেকটা তো তাই জানান দিলো। বুয়েন্স আইরেসে বেড়ে ওঠা ওই কিশোরের জন্য আর্জেন্টাইন প্রিমেরা ডিভিশনে খেলতে পারা নিশ্চয়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। সর্বকনিষ্ঠ প্লেয়ার হিসেবে যখন আগুয়েরো প্রিমেরা ডিভিশনে নাম লেখালো; বলে রাখা ভালো- তখন ১৯৭৬ সালে গড়া ম্যারাডোনার রেকর্ডটি কিন্তু সে ভেঙ্গে দিলো!
২০০৫-০৬ মৌসুমটা স্বপ্নের মতোই কাটলো আগুয়েরোর। মৌসুম শেষে ১৮ গোল ছিল বড় প্রাপ্তি; তবে তা যে স্পষ্টই ইঙ্গিত দিচ্ছিলো নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সে কথা বলাই বাহুল্য। সেবারের পারফর্মেন্স যথেষ্ট ছিল বড় কোনো ক্লাবের চোখে পড়ার। আতলেতিকো মাদ্রিদের মনে ধরলো আগুয়েরকে। এখানেও নিজেকে প্রমান করতে ব্যর্থ হলেন না তিনি। প্রথম মৌসুমের ৭ গোলের পর পরের মৌসুমে ১৯ গোলে নিজে হলেন লীগের ৩য় সর্বোচ্চ গোলদাতা; আর দলকে দেখালেন মর্যাদার চ্যাম্পিয়নস লীগের যাত্রা।
নিঃসন্দেহে ২০০৯-১০ সাল'টা আগুয়েরোর লাইফের অন্যতম সেরা সময়। সেবার আতলেতিকো মাদ্রিদের হয়ে ইউয়েফা ইউরোপা লীগের শিরোপা জিতলেন আগুয়েরো। ফাইনালে ফুলহামের বিপক্ষে দুটো গোলেই রাখলেন অবদান। পরের মৌসুমেও চিরচেনা আগুয়েরোকে দেখা গেলো মাঠে। আতলেতিকো অধ্যায়ের শেষটা স্মরণীয় করে রাখলেন হ্যাট্টিক করে। থাক সেসব কথা। এসব হিসেব নিকেষ আজ বড্ড নিদারুণ লাগে। তারচেয়ে বরং অন্য গল্প শোনা যাক।
২০১১ সালের ২৮ জুলাই। মেডিক্যাল ফিটনেস টেস্ট, প্রেস রিলিজ- সব আনুষ্টানিকতা সেরে সার্জিও কুন আগুয়েরো'কে নিয়ে যাওয়া হলো ইতিহাদে। স্ট্রাইপের একটা শার্ট, আর জিন্স পরে আছেন আগুয়েরো। হাস্যোজ্জ্বল দেখালো তাকে। কে একজন তার হাতে একটা জার্সি তুলে দিতেই সেটা পরে ফেললেন শার্টের উপর। আসমানি জার্সির প্রতি তার ভালোবাসার প্রথম সে মূহুর্ত। মিডিয়া এট্রাকশন হোক, আর স্বীয় ভঙ্গিমায় হোক; সবার সামনেই আলতো করে একটা চুমু লেপ্টে দিলেন জার্সিতে থাকা ছোট্ট লগোতে। মাঠ থেকে সোজা গেলেন ড্রেসিংরুমে। দেখলেন তার সতীর্থদের জার্সি ঝুলে আছে ওয়াড্রবের হুকে: ওয়ারড্রবের কার্নিশ বরাবর একটা লেখা দেখে হয়তো পুলকিতই হয়েছিলেন আগুয়েরো- 'প্যাশন'। এই একটি শব্দ।
জীবন যেখানে যেমন বলে একটা কথা আছে; আগুয়েরো বোধহয় সেটার চূড়ান্তটাই দেখে নিয়েছেন এক জীবনে। প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরুর পর তাকে পিছনে তাকাঁতে হয়েছে খুব কমই। অথচ ট্যাক্সি ড্রাইভার পিতা আর ১৮ বছর পেরোনো মায়ের দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে পৃথিবী আলোকিত করার আগেই বন্যার পানি তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেলো বহুদূর! পিতা লেওনেল ডেল ক্যাস্তেলো বহু গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র হারালেন পানির তোড়ে; হারালেন তাদের সব সম্পত্তিও! বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া দলিলাদির অভাবে জন্মের পর ছেলের নামটাও ঠিকঠাক রাখতে পারলেন না পিতামাতা। তাই সার্হিও নামটা মোটামুটি ভাড়া করেই আনা হলো, মায়ের শেষ নাম আগুয়েরো তার অফিসিয়াল নাম হিসেবে যুক্ত হলো।
আমার কেবল সিটির আগুয়েরোকেই নিয়েই মেতে থাকতে ইচ্ছে করে। সিটিতে তার এতো এতো স্মৃতি; মেসির খুব কাছেই এই বন্ধু অনেক কথাই অবশ্য খোলামেলা বলেছেন তার অটোবায়োগ্রাফি 'Born to Rise' বইয়ে। খুব তীতা একটা সত্যি কথা যদি বলি, সিটির প্রচুর টাকাপয়সা থাকতে পারে একালে এসে। হতে পারে তাদের বহুদিনের ইতিহাস। তবু তা যে খুব বেশি মর্যাদার- এ কথা অন্তত অনেকেই মানবে না। বর্তমানের সিটি আর অতীতের সিটির মধ্যে যে খুব বড় একটা তফাৎ তার উদাহরণ বহু দেয়া যাবে। আমি শুধু বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জয়ী উরুগুয়ান ফরোয়ার্ড ডিয়াগো ফোরলানের একটা উক্তি তুলে ধরি, ''আমি চার বছর ম্যাঞ্চেষ্টারে কাটিয়েছি। কিন্তু এই একই শহরে আরেকটি ক্লাব আছে আমি জানতাম-ই না।''
সিটিকে অপছন্দ করার বহু কারণ আছে ইংলিশ ফুটবল ফ্যানদের কাছে। একটা ঘটনা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ক্লাবের সাথে ঝামেলার জেরে আরেক আর্জেন্টাইন তারকা কার্লোস তেবেজের সাথে কি নেক্কারজনক কান্ডটাই না করেছিলো ক্লাবের ফ্যানরা। বলা চলে তেবেজকে মোটামুটি কিক মেরেই বিদায় করা হয়েছে। কিন্তু ভক্তরা যখন ঘোষনা দিয়ে স্টেডিয়ামের বাইরে রাখা ময়লার ট্রাকে তার নাম সম্বলিত সব জার্সি এনে ফেলে দিবে- এটা বোধহয় কেউ কল্পনাও করবেনা। একটা ফুটবলারকে কতটা ঘৃণা করলে একটা দলের সমর্থকরা এমন রুঢ় আচরণ করতে পারেন আমার ধারণা নেই। এই তেবেজের আগুন পারফর্মেন্সে একসময় উত্তাল ছিল সিটির গ্যালারি। অবশ্য, অতিরঞ্জিত করে দর্শকদের এখানে না টানাই সুবিধাজনক। সিটির যা দর্শক, করোনাকালে দেখা গেলো ভার্চুয়াল প্রজেক্টরে প্রেজেন্ট করা হচ্ছে দর্শকদের। সেখানে এক দর্শক অন্তত তিনবার ছিলেন বলে একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব প্রচার হয়! সেটা অন্য ব্যাপার। তেবেজের মতো ঘটনা না ঘটুক; আগুয়েরোর সাথে যা ঘটলো হঠ্যাৎ-ই তা একজন সিটি ফ্যান কিভাবে মেনে নিলো আমার বিস্ময় লাগে!
যে মানুষটা একটা ক্লাবকে দু'হাত ভরে উজাড় করে দিলো, সে ম্যাচ শেষে হতাশার সুরে এসে বলে 'তারা আমাকে পাস দেয় না!' এই সিজনে আগুয়েরো মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছেন খুব কমই। এদিকে ১০ বছরের চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়ে এসেছে। তাই বলে শেষের দিনগুলোতে এতো অবহেলা? এই অবহেলা কি আগুয়েরো আসলেই ডিজার্ভ করতেন? পুরো ম্যাচ যারা দেখেছেন তারা বলতে পারবেন ভালো, আগুয়েরো ইশারা দিচ্ছেন পাস দেয়ার জন্য। স্টার্লিংরা খুব ইগ্নোর করেই গেলেন পুরো ম্যাচ। এমনটা সত্যিই আনএক্সপেক্টেড ছিল সিটির মতো একটি দলের কাছ থেকে। খুব হতাশা নিয়ে কুন আগুয়েরো সিটির সাথে তার দীর্ঘ সম্পর্কের ইতি টানছেন। যদিও এমনটা হওয়ার কথা ছিল না..
প্রিয় আগুয়েরো,
বহু দিগন্ত, বহু প্রেরণার রাত্রি; বহু আক্ষেপের ঘনঘটার সাক্ষী রেখেছেন আমাদের। কত সোনালি সময়, কত আবেগমাখা সমীকরন! কত বিষাদের অশ্রু আর কত আনন্দে আত্মহারা মূহুর্ত! সব শেষে এমন প্রস্থান?
এটাকেই কি তবে নিরব প্রস্থান বলে, আগুয়েরো?
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য