ক্রিকেট মাঠের আগুন-গদ্য : ০১
পোস্টটি ১৪৭৩ বার পঠিত হয়েছেক্রিকেট মাঠে ফুল ফোটে। জানেন?
উঁহু, মোটেও ভুল বুঝবেন না, প্লীজ! ঠিকমতো পরিচর্যার অভাব হলে মাঠগুলোয় কেমন বর্ষার কাদাপানি জমে থাকে, শিম-বেগুন-ফুলকপির মতো সব্জী তরতর করে বেড়ে উঠে, তা আমরা দেখেছি। সে আমাদের দূর্ভাগ্য কিংবা অন্য অর্থে সৌভাগ্য বলতে পারেন। এমন দুর্লভ দৃশ্য দর্শনের সুযোগ তো আর পৃথিবীর সব দেশে, সবখানে মেলে না!
তাই বলে ক্রিকেট মাঠে উল্লেখিত প্রস্ফুটিত ফুল কিন্তু তেমন পরিচর্যা বা অবহেলার ফল নয়, বরং তা সুন্দরতম পরিচর্যায় সর্বোচ্চ উপস্থাপনার উদাহরণ।
মাহেলা জয়াবর্ধনে, আজহারউদ্দীন, ভিভিএস লক্ষ্মণ কিংবা হাল আমলের লিটন দাস; তারা এই ফুল ফোটানোয় মালীর দায়িত্ব পালন করেন। পেলব কব্জীর মোচড়, রাজার আভিজাত্য নিয়ে করা কাভার ড্রাইভ, আলতো টোকার ফ্লিক— সুন্দরতম একটি ফুল যেমন সমস্ত পাপড়ি মেলে সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে হাসে, অনেকটা তেমন যেন! ক্রিকেট মাঠে কখনো কখনো সুনিপুণ চিত্রশিল্পীর দেখা মেলে। মনে আছে নিশ্চয়, টন্টনের ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে ইয়ান বিশপের সেই ভরাট কন্ঠের মুগ্ধতা মেশানো উত্তেজনা— ‘লিটন দাস পেইন্টিং এ মোনালিস হেয়ার!’
ক্রিকেট মাঠে ছন্দোবদ্ধ কবিতারও দেখা পাবেন আপনি। চতুর্দশপদী কবিতার মতো দুর্বোধ্য কিন্তু আনন্দদায়ক ব্যাপার ঘটে। ক্যারিবিয়ানের একজন রাজপুত্র হাই ব্যাকলিফটে যে ড্রাইভ খেলতেন— তা কোনোভাবেই পদ্যের চেয়ে কিছু কম নয়! বাইশ গজের আয়ত-অঞ্চলে দেখবেন ম্যাজিকও। ক্রিস অ্যাঞ্জেল হয়ে কেউ কেউ আপনাকে অবাক কোনো জগতে পরিভ্রমণে বাধ্য করবেন। বিভ্রম, মোহ, ধাঁধা; আদতে যে কী, বোঝা যায় না তা! শেন ওয়ার্ন, মুরালিধরন, আব্দুল কাদির এক-একজন মস্ত জাদুকর। বোকা বানানোর জাদুকর। মুহূর্তের ম্যাজিকে চোখ-মুখ ছানাবড়া করে হাত সাফাইয়ের সর্বোত্তম পারদর্শীতা দেখিয়ে ছাড়বেন!
ক্রিকেটের সবুজ উদ্যান, কাষ্ঠের টোকাটুকি, ছ’আউন্সের চর্মগোলক, আর আছে মাঠজুড়ে বিচরণ করা কুশীলবের দল; আপনাকে জগতের সুন্দর ও বিচিত্র, আনন্দদায়ক ও মুগ্ধকর, অবাক ও অসাধারণ সব মুহূর্তের সম্মিলনে অনবদ্য ও অনন্য অনুভূতির যোগান দিতে সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন।
তবে এসবের বাইরে আরও এক প্রকার সৌন্দর্যের সন্ধান পাবেন আপনি। ফাস্ট বোলিং। যেন ছুটন্ত আগুন! পোড়ায়, জ্বালায়, ছারখার করে; তবুও, মানুষ ভাবতে বাধ্য হয়, বলতে আনন্দ পায়— ধ্বংসও কখনো কখনো কতই না সুন্দর!
ওয়াকার ইউনুস, মাইকেল হোল্ডিং, শোয়েব আকতার, অ্যালান ডোনাল্ড, ডেনিস লিলি, মিচেল জনসন... আরো কত কত নাম! আকাশ হতে নেমে আসা বজ্রপাতের মতো চারপাশ কাঁপিয়ে দেবে, তোলপাড় তুলে জানিয়ে দেবে আগমণ তার। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে শাসানো, মস্তক তাক করে ছুঁড়ে দেয়া বাউন্সারের হুঙ্কার, শর্ট বলের যন্ত্রণা, ইয়র্কারের ত্রাস, গতির তুফান-ঝড়; আপনাকে উচ্ছ্বাসে আতঙ্কিত করবে, আনন্দে অস্থির হবেন আপনি, উত্তেজনায় কাঁপবেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ আপনাকে ছটফট-করা বিনোদন দেবে; খুনে মেজাজে, বুনো আগ্রাসনে আপনি উচ্ছ্বসিত হবেন। এ এক আনন্দ ও মুগ্ধতার অন্যরকম জগৎ। ক্রিকেট মাঠের আর কোনোকিছুর সঙ্গেই তুলনীয় নয় তা। বুকের ভেতর বিমুগ্ধ চিত্তের বিনোদনমুখর কোলাহল, সাহস ও আক্রমণের দর্শনীয় প্রদর্শনী উপভোগের কল্লোল...। উঁহু! এ আনন্দের সৃষ্টি অব্যখ্যায় কোনো জগতে, অভাজন এক কলমচির পক্ষে তার সুনিপুণ প্রকাশ অসম্ভব।
ক্রিকেট মাঠে কবিতা হয়, চিত্রাঙ্কন হয়, ফুলও ফোটে, আবার কখনো কখনো আগুনে গদ্যও ঝংকার তোলে। যেনো কোনো কোনো কলাম— প্রতি বাক্যে, প্রতি ছত্রে যাতে থাকে সিস্টেমের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ। যেনো কোনো কোনো বক্তৃতা— যাতে প্রতিটি কথায় বক্তা আগুন মিশিয়ে দেন। শ্রোতামন্ডলী কেঁপে উঠে থরথর। শিহরিত হয় রক্তকণিকার ছুটন্ত প্রাবল্যে। বিদ্রোহী কবি যেমন বলেছিলেন— ‘বিদ্রোহী মানে কাউকে না-মানা নয়, বিদ্রোহী মানে হলো যা বুঝি না, মাথা উঁচু করে তা বুঝি নাই বলা।’
এমন কোনো কোনো বিদ্রোহীর দেখা মেলে ক্রিকেট মাঠে। যারা ব্যাটসম্যান শাসিত সমাজে একরোখা, গোঁয়ারের মতো দাঁড়িয়ে যান। ক্রিকেট মাঠে এইরকম দাঁড়িয়ে যাওয়া, এমন আগুনে ঝংকার হতে কত কত ইতিহাস, কত কিংবদন্তি!
ফ্রেডরিক স্পফোর্থ— যার মাথায় রক্ত চড়ে গেলে ব্যাটসম্যানের ধংস হয়ে পড়ত অনিবার্য। যার খুনে মেজাজময় একটি মুহূর্তের হাত ধরে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ঝাঁজালো, প্রাচীন ও বনেদি প্রতিদ্বন্দ্বীতার সূচনা। দ্য এ্যাশেজ—ছাইভস্ম, স্পফোর্থের আগুনে গদ্যের পরিণতি। অস্ট্রেলিয়ান গ্রীষ্মে সুর তুলে কোরাস— কিল লিলি কিল। ক্লাইভ লয়েডের পেস লাইক ফায়ার— যেন সবুজ উদ্যানে চারটি ক্ষুধার্ত নেকড়ের ছোটাছুটি। ডোনাল্ডের জিঘাংসা, তার সামনে ব্যাটসম্যান হ্যালমেট ছাড়া দাঁড়িয়ে, যেন বোলারের পৌরুষত্বে বা সক্ষমতায় সরাসরি আঘাত, অতঃপর ডোনাল্ডের রক্তঝরা বাউন্সার। শোয়েবের তেজস্বীতায় সৌরভের পাজর চেপে ধরে শুয়ে যাওয়া। অ্যামব্রোসের আর্মব্যান্ড খুলতে বলে ডিন জোন্সের অনুতাপ, অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের অভিব্যক্তি— পাগলটাকে আর্মব্যান্ড খুলতে বলে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার কুবুদ্ধিটা ছিল কার?
কত কত কান্ড, কত কত স্পেল, কত কত সুইং-পেস আর চোখ রাঙানির উপাখ্যান! যদি ক্রিকেট মাঠের সবচেয়ে উপভোগ্য দৃশ্যের কথা বলতে হয়, জানি অনেকেই বলবেন এইরকম আগুনে-গদ্যের বহু উপাখ্যান!
*****
বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমন আগুনে গদ্য হাতে গোণা। আগুনে গদ্যের জন্য যেমন তেজস্বী ও মেজাজ প্রয়োজন, তা খুব একটা আসেনি বাংলাদেশ ক্রিকেটে। মাশরাফি মর্তুজা টেস্ট ক্রিকেট ছেড়েছেন একযুগ প্রায়, অথচ এখনো তিনিই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বাধিক উইকেট পাওয়া ফাস্ট বোলার। সবুজ-সুফলা শস্য-শ্যামলা, নদীমাতৃক বাংলাদেশ। এই অঞ্চলে নরম ও কোমল প্রাণ-ই স্বাভাবিক, বাঘের মতো হুঙ্কার দেয়া ফাস্ট বোলার কিঞ্চিৎ অতি-প্রত্যাশা বৈকি!
তারপরও যে কটি আগুনে গদ্যের সৃষ্টি হয়েছে এই দেশের ক্রিকেটে, সেখান হতে কয়েকটির আলোচনাই আজকের আলেখ্যের মূল লক্ষ্য। আশ্চর্যজনকভাবে বাছাইকৃত চারটি স্পেল দুটি টেস্ট হতে, বাকি দুটি ওডিয়াই। পুরোটাই কাকতাল। নেহায়েৎ ব্যক্তি পছন্দ। আপনার সঙ্গে না-ও মিলতে পারে, অন্য যে কারো দ্বিমত থাকাটা স্বাভাবিক। তবে এই চারটি স্পেল বাছাইয়ে বাংলাদেশের জয়ের সঙ্গে প্রতিপক্ষ-স্থান-কাল-প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তো নেয়া হয়েছেই, আরো একটা ব্যাপার কাজ করেছে তা হচ্ছে— বারুদ কতটা ছিল, দর্শক, দল, পরিবেশ ও বোলারের মধ্যে আগুন কেমন ছিল।
মাশরাফির আবির্ভাব ছিল বারুদে ঠাসা। ডিওন ইবরাহিমকে করা বোল্ড এখনও অনেক ক্রিকেট রোমাঞ্চিকের কাছে আলোচনার প্রিয় মুহূর্ত। তারপরে আরো বহু উইকেট, বহু ম্যাচজয়ী স্পেল আছে তার, কিন্তু যেইরকম আগুন নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই, তেমন খুঁজে পাইনি। হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে, অথবা বিবেচনাবোধে আমরা-ই পারঙ্গম নই। এই পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটে আবির্ভুত হওয়া সবচেয়ে তেজস্বী ফাস্ট বোলারের নাম— মাশরাফি মর্তুজা। অথচ এই আলোচনায় তিনিই অনুপস্থিত, ব্যাপারটা স্বস্তির নয়। কিন্তু কী আর করা!
*****
পরের দুইটি পর্বে দুইটি-দুইটি করে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চারটি আগুন-গদ্য নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।
- 0 মন্তব্য