• ফুটবল

বাসবি বেবস ও মিউনিখ এয়ার ডিজাস্টার

পোস্টটি ১১৫৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফুটবল খেলাটা যেমন কারো কারো কাছে সাময়িক সময়ের বিনোদন, তেমনি আবার কারো কারো কাছে এটি সকল ভালোবাসা ও আবেগের জায়গা। আবার কারও কারও কাছে এটিই জীবন, এটিই ক্যারিয়ার, এটিই সব আশা-ভরসা। ফুটবল শুধু খেলা না, খেলার চেয়েও বেশি কিছু।

ফুটবল আমাদের আনন্দ দেয়, তৈরি করে হাসি-কান্নার কত শত মূহুর্ত! কত শত জন এই ফুটবল থেকেই পায় বেঁচে থাকার প্রেরণা। এই খেলা দেখেই জেগে ওঠে জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া কত সৈনিক, আবারও উঠে দাঁড়ায় নতুন মনোবল নিয়ে।

কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যার ফলে ফুটবল জগতে নেমে আসে শোকের ছায়া। হুহু করে কেঁদে ওঠে অসংখ্য প্রাণ। সারা পৃথিবী হয়ে পড়ে নিস্তব্ধ। সেসব ঘটনা মনে করলে এখনও দূঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। নিরবে বর্ষিত হয় অশ্রু।

১৯৪৫ সাল। বর্তমানের অন্যতম শীর্ষ ধনী ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আর্থিক অবস্থা তখন একদম শোচনীয়। সে অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন এমন একজনকে, যে পারিশ্রমিক নিবে কম, সাফল্য এনে দেবে বেশি।

এমন একজন কে খুঁজে পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক চেষ্টার পর তারা পেয়ে গেল একজন কে। কিন্তু তিনি জুড়ে দিলেন বেশ কিছু শর্ত। কোন খেলোয়াড় কে খেলাবেন আর কাকে খেলাবেন না, সেই সিদ্ধান্ত তিনি একা নেবেন, অন্য কেউ নাক গলাতে পারবেনা। তাকে তার খেয়াল খুশিমতো যেকোনো খেলোয়াড় ক্র‍য় ও বিক্রয়ের অধিকার দিতে হবে, ক্লাব কর্তৃপক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা। আর শক্তিশালী দল গঠনের জন্য তাকে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় দিতে হবে।

নিরুপায় রেড ডেভিলস ম্যানেজমেন্টকে তাতেই রাজি হতে হলো। অতঃপর সেই অধঃপতিত দলের দায়িত্ব নিলেন সেই একরোখা ব্যক্তি, যার নাম ম্যাট বাসবি।

image_search_1618435239066
ইউনাইটেডের দায়িত্ব নিয়ে তিনি ডাকলেন সাবেক ওয়েস্ট ব্রোম ফুটবার জ্যাক মারফিকে। মারফিও তার আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৯৪৬ সালে চলে এলেন রেড ডেভিলস শিবিরে, দায়িত্ব নিলেন প্রধান কোচ ও সহকারী ম্যানেজারের।

দুই অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবার পূর্ণ উদ্যমে নেমে পড়লেন দল পুনর্গঠনের কাজে। তাদের জাদুর স্পর্শে চোখের পলকে যেন বদলে যেতে লাগলো ক্লাবটা। ধুঁকতে থাকা ইউনাইটেডে এল আমূল পরিবর্তন। ১৯৪৬-৪৭ মৌসুমেই লিভারপুলের পেছনে থেকে রানার্সআপ হিসেবে লিগ শেষ করলো তারা। এরপরের চারটি সিজনের মধ্যেও তিনটিতে রানার্সআপ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড! এর মাঝে ১৯৪৮ সালে ঘরে উঠলো এফএ কাপ টাও। অবশেষে ১৯৫২ সালে ৪১ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে লিগ শিরোপা জয় করে নেয় ম্যাট বাসবির ছেলেরা।

কিন্তু এরপর হঠাৎ করেই এক গুরুতর সমস্যার মধ্যে পড়ে যায় ইউনাইটেড। দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় ত্রিশের কোটা পেরিয়ে গিয়েছিলো। ফলে বুড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পারফর্মেন্সেও ভাটা পড়তে শুরু করে।

ঠিক এসময় এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন ম্যাট বাসবি। বেশি বয়সী বেশ কটি খেলোয়াড় একসঙ্গে ছেড়ে দিলেন দল থেকে। তাদের জায়গায় দলের একাডেমি থেকে নিয়ে এলেন ১৬-১৯ বছর বয়সী তরুণদের। এদের মধ্যে ছিলেন বিল ফোকস, মার্ক জোনস, জ্যাকি ব্লাঙ্কফ্লাওয়ার, আলবার্ট স্কানলোন, ডেভিড পেইগ, লিয়াম হুইলান প্রভৃতি। আবার বাইরে থেকেও টমি টেলর, হ্যারি গ্রেগ, জনি বেরি সহ বেশ কিছু তরুণ সাইন করান।

তবে একজনের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। তার নাম ডানকান এডওয়ার্ডস। তাকে সে সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাধর তরুণ হিসেবে ধরা হতো। যখন তার বয়স মাত্র ১৫, তখনই সুযোগ পেয়ে যান ইউনাইটেডের মূল দলে। এরপর সেসময়ের রেকর্ড গড়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে সুযোগ পান।

সাফল্য পেতে খুব বেশি অপেক্ষা কর‍তে হলোনা। কয়েক বছরের মধ্যেই আলো ছড়াতে শুরু করলো তরুণরা। দলের খেলোয়াড়দের গড় বয়স ছিলো মাত্র ২২ বছর। তাই সবাই আদর করে দলটির নাম দিয়ে দিলেন "বাসবি বেবস" বা বাসবির ছানাপোনা। ম্যানচেস্টার ইভিনিং নিউজ–র সাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক নিকলিন ১৯৫২ সালে প্রথম এই নামে দলটিকে সম্বোধন করেন। অচিরেই পুরো ইউরোপের নজর কাড়ে এই বাসবি বেবস।

image_search_1618434972271
অবশেষে ১৯৫৬ সালে এসে হারানো লিগ শিরোপা আবার পুনরুদ্ধার করে বাসবির ছেলেরা। পরের বছর আবারও লিগ জিতে লিগে আধিপত্য অব্যাহত রাখে।

ম্যাট বাসবির এ সাফল্যে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে ইউরোপের অন্যান্য বড় বড় ক্লাব। তৎকালীন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ তাকে ম্যানেজার হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তিনি সরাসরি নাকচ করে দেন সে প্রস্তাব। তাদের তিনি বলেন, ‘‘মাদ্রিদ মে বি প্যারাডাইজ, বাট ম্যানচেস্টার ইজ মাই হেভেন।’’

পরের সিজনে আরও বড় লক্ষ্য নিয়ে মিশন শুরু করে বাসবির ছেলেরা। এবারের মিশন ছিলো ঘরোয়া শিরোপার পাশাপাশি ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ঘরে তোলা।

অবশেষে ঘনিয়ে আসে সেই দিন। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৮। কেউ ভাবতেও পারেনি এদিন এমন এক ঘটনা ঘটতে চলেছে, যা স্তব্ধ করে দেবে পুরো ফুটবল বিশ্বকে। সুন্দর রৌদ্রজ্জ্বল সোনালী দিনটি মূহুর্তে পরিণত হবে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম কালো দিনে।

সার্বিয়ান ক্লাব রেড স্টার বেলগ্রেডের সাথে ইউরোপিয়ান কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ ৩-৩ গোলে ড্র করে দুই লেগ মিলিয়ে এগিয়ে থেকে সেমি ফাইনালে ওঠে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। খুশিমনে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ৬০৯ অ্যাম্বাসেডর বিমানে করে ম্যানচেস্টারের পথে রওনা দেয় তারা। পথিমধ্যে জ্বালানি নেওয়ার জন্য মিউনিখে যাত্রা বিরতি নেয়। জ্বালানি নেওয়ার পর কুয়াশার কারণে দু'বার টেক অফের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন প্লেনের পাইলট ক্যাপ্টেন জেমস থেইন এবং কেনেথ রেইমেন্ট। শিডিউলে পিছিয়ে পড়বেন বলে এক দিন দেরী করার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে ক্যাপ্টেন থেইন তৃতীয়বার প্লেন ওড়ানোর চেষ্টা করেন।

সেই তৃতীয় বার চেষ্টা করাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিমানটি মিউনিখ রানওয়ে পার হওয়ার আগেই বিধ্বস্ত হয়। বিমানে থাকা খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, সাংবাদিক মিলিয়ে ৪৪ জনের ২০ জনই মারা যান তৎক্ষণাৎ। বাজেভাবে আহত একজন মারা যান হাসপাতালে নেওয়ার পথে এবং হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান আরও দু'জন। অর্থাৎ ৪৪ জনের ২৩ জনই মারা যান এই বিমান দুর্ঘটনায়।

image_search_1618436059536
নিহত ২৩ জনের মধ্যে ছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মূল একাদশে নিয়মিত খেলা ৮ খেলোয়াড়। দলের সবচেয়ে বড় তারকা ডানকান এডওয়ার্ডস ১৫ দিন পর হাসপাতালে মারা যান। বলা হয়ে থাকে, ডানকান এডওয়ার্ডস বেঁচে থাকলে পৃথিবী ববি চার্লটনকে চিনত না! সেই সময় পুরো ইংলিশ ফুটবলের আইকন ছিলেন এডওয়ার্ডস। তাঁর ক্ষিপ্রতা, নিশানাভেদী শট, খেলা সবমিলিয়ে সেই যুগে তাঁর ধারেকাছেও কেউ ছিলেন না।

২১ জন যাত্রী বেঁচে গেলেও দুই বিখ্যাত ইউনাইটেড খেলোয়াড় জন বেরি এবং জ্যাকি ব্লাঙ্কফ্লাওয়ার এতোটাই বাজেভাবে আহত হন যে আর কোনদিন বুট পায়ে ২২ গজে নামতে পারেননি। বাসবি টানা ২ মাস হাসপাতালে ছিলেন। তিনি এই দুর্ঘটনায় এতোটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে ফুটবল থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর স্ত্রী সে সময় তাকে মনোবল জুগিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘’হারিয়ে যাওয়া ছেলেগুলো চায়, তুমি যেন থেমে না যাও।‘’

প্রায় ৫ মাস ম্যানেজার পদ থেকে দূরে ছিলেন বাসবি। এ সময়ে দলের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন মারফি। বেঁচে যাওয়া খেলোয়াড় আর যুব দল মিলিয়ে ভাঙ্গাচোরা দল নিয়ে আবার নতুন করে শুরু করেন পথ চলা। দলকে তোলেন ১৯৫৮ এফএ কাপ ফাইনালে। কিন্তু বোল্টন ওয়ান্ডারার্সের কাছে হেরে শিরোপা আর হাতে তোলা হয়নি।

এত বড় ট্রাজেডির পর দল টা একদমই ভেঙ্গে পড়ে। আবারও টেনে তোলার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু খেলোয়াড় দলে ভেড়ান মার্ফি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও গুছিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। দূর্ঘটনার পর পরবর্তী ১৪ লিগ ম্যাচের মাত্র একটিতে জয়ের দেখা পায় ইউনাইটেড। তারপরও ইউরোপিয়ান কাপে মিলানকে ঘরের মাঠে প্রথম লেগে হারিয়ে দেয় তারা। তবে ফিরতে লেগে ৪-০ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয় সে আসর থেকে।

১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে আবারও ফিরে আসেন ম্যাট বাসবি। আবার সুনিপুণ হাতে গড়তে শুরু করেন দল, দ্বিতীয় প্রজন্মের বাসবি বেবস। দূর্ঘটনার কবল থেকে ফিরে আসা ববি চার্লটন, হ্যারি গ্রেগ, বিল ফোকস...তাদের সাথে বাইরে থেকে নিয়ে আসেন ডেভিড হার্ড, আলবার্ট কুইক্সাল, ডেনিস ল। একাডেমি থেকে তুলে আনেন ডানকান এডওয়ার্ডসের যোগ্য উত্তরসূরী জর্জ বেস্ট কে। গঠন করেন আরেক দুর্ধর্ষ দল, "নিউ জেনারেশন অব বাসবি বেবস"।

image_search_1618435375828
ম্যাট বাসবির জাদুকরী হাতের ছোঁয়ায় এ দলটিরও সফলতা পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৬৩ সালে এফএ কাপ, ১৯৬৫ ও ১৯৬৭ সালে লীগ শিরোপা জয় করে ইউনাইটেড। ১৯৬৮ সালে লিগ শিরোপা হারালেও বেনফিকা কে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান কাপ জয় করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

বাসবি অবসর নেন ১৯৬৯ সালে, তবে ১৯৭০-৭১ মৌসুমে আবার এসেছিলেন এক মৌসুমের জন্য। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে ক্লাব প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন।

থিয়েটার অব ড্রিমসে এরপর সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য জাদুকরী মূহুর্ত, অসংখ্য তরুণ এখানে এসেছে, ছুঁয়েছে তাদের স্বপ্নকে। এখনও এখানে এসে জড়ো হয় হাজারো স্বপ্ন, সেসব ডানা মেলে ঐ আকাশে। কিন্তু এখনও ওল্ড ট্রাফোর্ডের পূর্ব দিকে তাকালে যখন চোখে পড়ে স্যার ম্যাট বাসবি ওয়ে, মনে পড়ে এই ওল্ড ট্রাফোর্ড একদিন মাতিয়ে রাখতো কিছু তরুণ, যারা হারিয়ে গেছে অকালে, মিশে গেছে ওই আকাশে। হয়তো সেখানে তারা হয়ে এখনোও জ্বলছে তারা, আর বলছে, "এই তো আমরা"।

image_search_1618435296990
ওল্ড ট্রাফোর্ড কখনো তাদের ভুলবেনা, ভুলবেনা এ ফুটবল বিশ্ব।