রজার জেন্টেলম্যান ফেদেরার
পোস্টটি ১১৯০ বার পঠিত হয়েছেক্রীড়াজগতে যদি সবচেয়ে ভদ্র খেলোয়ারদের একটা তালিকা করা হয় মানুষটার নাম সবার উপরের দিকেই থাকবে। সুদর্শন এবং স্মীত হাসি যার ঠোটের কোণে সব সময় লেগেই থাকে।
কৈশোরের বদ মেজাজ,আলসেমি,খামখেয়ালিপনা ছেড়ে সময়ের ব্যবধানে যিনি পরিণত হয়েছেন একজন আদর্শ কিংবদন্তিতে।
শ্রদ্ধা কিংবা ভালোবাসার জায়গায় যাকে পরম মমতায় আগলে রাখে ক্রীড়ামোদীরা।
তার নাম :রজার ফেদেরার। টেনিস জগতের কিংবদন্তি।
টেনিস তো অনেকেই খেলে। অসামান্য সব খেলোয়ারদের খেলা দেখেই টেনিস খেলাটা আমাদের কাছে প্রিয় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু টেনিস খেলাটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন কয় জন?
প্রতিপক্ষের বুকে কাপন ধরিয়ে দেওয়া ক্ষীপ্রতা, ফোরহ্যান্ড কিংবা ব্যাকহ্যান্ডে দিয়ে বাতাসে বলের বাঁক খেয়ে ছুটে চলা,তীব্র গতির সার্ভিস দিয়ে বিপক্ষকে নিস্তেজ করে দেওয়ার মতো সব উপাদান টেনিস জগতে ফেদেরারের মতো করে আর কেউ পারেনি।
ছোটবেলা থেকেই ফেদেরার বিভিন্ন রকম খেলায় পারদর্শী। টেনিসের পাশাপাশি ব্যাডমিন্টন,বাস্কেটবল,ফুটবল খেলাটাও বেশ ভালোই খেলতেন। কিন্তু বরিস বেকার এবং স্টিফেন এডভার্গ কে আদর্শ মানা তরুন টেনিসেই নিজেকে পাকাপোক্ত করেন। টেনিসের জন্যই পড়াশুনাটা খুব বেশি আগায় নি,১৬ বছর বয়সেই পড়ালেখার সমাপ্তি টানেন।
২০০১ সালে মিলান ইনডোর ওপেনে জিতে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম শিরোপার স্বাদ পান ফেদেরার।
তবে তার ক্যারিয়ারে মোড় টা ঘুরিয়ে দে ২০০১ সালে উইম্বলডন চ্যাম্পিয়নশিপের চতুর্থ রাউন্ডে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল খেলোয়াড় পিট সাম্প্রাসের বিপক্ষে সেই জয়টা।
১৯ বছরের সোনালী চুলের একজন আনকোরা তরুন সাম্প্রাসের সেই সব সার্ভ ঠেকিয়ে দিচ্ছিলেন অবলীলায় যেই সার্ভ গুলো অপ্রতিরোধ্য ছিলো অন্য সবার কাছে। সাম্প্রাসের বিপক্ষে সেই ম্যাচ জিতে উইম্বলডন এর ইতিহাসে বড় ধরনের এক অঘটন ঘটিয়ে দিলেন তিনি! শৈশবের হিরোকে এভাবে হারানো টা অবিশ্বাস্য বটে! ফেদেরার নিজে কি তার জয় টা বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন?
সর্বকালের অন্যতম সেরা পিট সাম্প্রাসের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ জিতার মাধ্যমে ফেদেরার যুগের শুরু।
প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন প্রথম থেকেই, ১৬ বছর বয়সে জুনিয়র উইম্বলডন শিরোপা জেতার পরই তিনি পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে আত্বপ্রকাশ করেন।
ফেদেরার প্রতিভাবান,টেনিস জগতে একদিন রাজত্ব করবেন এরকম বিশ্বাস ছিলো সবার। তবে তার আলসেমি,হুটহাট মেজাজ হারিয়ে ফেলা,খামখেয়ালিপনা ক্যারিয়ারে সূর্যোদয়ের আগে সূর্যাস্তেরই আভাস দিচ্ছিলো।
তবে নিজেকে পরিবর্তন করেছেন ফেদেরার,হয়েছেন বিশ্বসেরা,কিংবদন্তির তালিকায় আছেন শীর্ষেতে,ক্যারিয়ারে সূর্যাস্ত টা তিনি আনতে দেননি। তৎকালীন কোচ পিটার কার্টার এর অধীনে নিজেকে আমূল পরিবর্তন করেছেন ফেদেরার।
কার্টারের অধীনে নিজেকে আস্তে আস্তে পরিণত করতে থাকেন।
কার্টারের অধীনে থাকা অবস্থায় ই সাম্প্রাসের বিপক্ষে সেই জয়,পরের বছর আবার হামবুর্গে প্রথম মাস্টার সিরিজ জিতে নেন ফেদেরার।
পরিবর্তনের ফল হাতেনাতেই পেতে থাকেন ফেদেরার।
২০০২ সালে র্যাংকিয়ে সেরা দশে জায়গা করে নেন।
পরের বছর ই ফাইনালে অস্ট্রেলীয় মার্ক ফিলিপৌসিসের বিরুদ্ধে সরাসরি সেটে জিতে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম গ্রান্ডস্ল্যামের স্বাদ পান। কোনো সুইস খেলোয়াড় হিসেবেও যেটা প্রথম।
দারুন ফর্মের সুবাধে ২০০৪ সালে নিজেকে র্যাংকিয়ের শীর্ষে আবিষ্কার করেন। সে বছর মারাত সাফিনকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া ওপেন ও জিতে নেন।
একই বছরে লেটন হিউইটকে ৬-০,৭-৬,৬-০ গেমে হারিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম ইউএস ওপেনের শিরোপা ঘরে তুলেন।
দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ফেদেরার ২০০৪ সালকে একদম নিজের বানিয়ে দেন।
২০০৪ সাল থেকেই টেনিস সার্কিটে ফেদেরার হয়ে উঠেন অপ্রতিরোধ্য। ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি টানা ১০ টি গ্রান্ডস্ল্যাম ফাইনাল খেলেন।
ছন্দপতনের শুরু ২০০৮ সালে,সেই বছরেই টানা দশ টি গ্র্যান্ডস্ল্যাম ফাইনাল খেলার পর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে উঠতে ব্যার্থ হন। সেমিফাইনলালে হেরে যান নোভাক জকোভিচের কাছে।
পরে ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালে উঠলেও টানা তৃতীয় বারের মতো হারেন নাদালের কাছে।
উইম্বলডন ফেদেরারের সবচেয়ে প্রিয় টুর্নামেন্ট হওয়ায় ভক্তরা আশা করেছিলেন অন্তত এই টুর্নামেন্ট টা এখন জিততেই পারেন ফেদেরার।
দারুন খেলে আশাও জাগিয়েছিলেন তিনি, প্রথম দুই সেট নাদাল জিতলেও পরের দুই সেটে ফেদেরার সুলভ খেলা খেলে ম্যাচে ফিরে আসেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, নাদালের কাছে ৯-৭ গেমে হেরে সেখানেও রানার্স আপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে ফেদেরারকে।
বলে রাখা ভালো, ফুটবলে যেমন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা,ক্রিকেটে যেমন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ গুলো যেভাবে উত্তাপ ছড়ায় টেনিস ব্যাক্তিগত খেলা হওয়া সত্ত্বেও ফেদেরার-নাদাল ম্যাচ ক্ষেত্র বিশেষে এর চেয়ে বেশি উত্তাপ ছড়ায়।
উইম্বলডন এ নাদাল-ফেদেরার এর এই ম্যাচ কে তো জন ম্যাকেনরো 'সর্বকালের সেরা ম্যাচ' হিসেবেই ঘোষনা দিয়েছেন।
২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে এককভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে দ্বৈতভাবে ওয়ারিংকাকে সাথে নিয়ে সুইজারল্যান্ড এর হয়ে প্রথম বারের মতো স্বর্ণপদক এনে দেন। বছরের শেষ দিকে ইউএস ওপেনে এন্ডি মারেকে ফাইনালে হারালে সেই বছর একটিমাত্র গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের স্বাদ পান।
অন্যান্য আসর গুলোতে ব্যর্থতার ফল স্বরুপ ২৩৭ সপ্তাহ র্যাংকিয়ের শীর্ষ স্থানে থাকার পর সেই জায়গাটি হারান।
ফ্রেঞ্চ ওপেনকে ফেদেরারের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হিসেবেই ধরা হতো,যেখানে ফেদেরার সুলভ কোনো পারফরমেন্স ই আসলে নেই। ফেদেরার সেই আসরকেই পরের বছর নিজেকে ফিরে পাওয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করেন। সেই আসরের ফাইনালে
রবিন সোদার্লিংকে হারিয়ে আবার রাজত্ব ফিরে পান এবং ছোয়ে ফেলেন সাম্প্রাসের ১৪ টি গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের রেকর্ড।
ধারাবাহিকতার পরিচয় দিয়ে বর্তমানে ফেদেরার ২০ টি গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ী একমাত্র টেনিস খেলোয়ার। সাম্প্রাস যখন ২০০২ সালে নিজের গ্রান্ডস্ল্যাম সংখ্যা ১৪ তে নিয়ে যান তখন অনেকেই ভেবেছিলো অন্তত সাম্প্রাসের এই রেকর্ডটা ভাংগার মতো কেউ টেনিস ইতিহাসে জন্মাবে না। এখন সেই সাম্প্রাস ফেদেরারে ২০ টি গ্র্যান্ডস্ল্যাম দেখে অবাক।
ফেদেরারের বয়স সংখ্যা এখন চল্লিশের আশেপাশে।
চল্লিশ শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই!!
বয়স টা যার কাছে একটা সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই না।
গতবছর হাটুতে দুটি অস্ত্রোপচার হয়েছিলো,র্যক হাতে ফিরেছিলেন ৪০৫ দিন পর কাতার ওপেনে কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে নিকোলাস বাসিলাভিলির কাছে হেরে যান। এরপরই কাতার ওপেন থেকে সরে দাড়ান এবং পরবর্তীতে হতে যাওয়া দুবাই ওপেনে এবং মিয়ামি ওপেনেও খেলবেন না বলে জানান। অনুশীলনে বাড়তি মনোযোগ দিতেই ফেদেরারের এই সিদ্ধান্ত।
অনুশীলনে বাড়তি মনোযোগ বলেই দিচ্ছে উইম্বলডন এবং টোকিও অলিম্পিককেই পাখির চোখ করে রেখেছেন রজার।
দীর্ঘসময় ধরে টেনিস কোর্টে রাজত্ব করা ফেদেরার আরো বেশি নিখুঁত ভাবে তৈরী হচ্ছেন র্যক হাতে শাসন করার জন্য।
নিজের সময়ে সেরাদের সেরা হয়েছেন তো বটেই জায়গা করে নিয়েছেন টেনিস ইতিহাসের কিংবদন্তিদের একদম উপরের তালিকায়।
বয়স তো চল্লিশের আশেপাশে, গ্র্যান্ডস্ল্যাম ও ২০ টি...
এখন কি তবে থামবেন ফেদেরার?
হাসিমুখে বলেন,এখনো বেশ ভালোই আছি,ফিটনেস টা ভালো,খেলাটাও বেশ উপভোগ করছি।
আমরাও চাই ফেদেরার ভালো থাকুন,খেলাটাও উপভোগ করুন।
সোনালী চুলের এই জেন্টেলম্যানের যে টেনিস কোর্টে র্যাকেট হাতে এখনো অনেক কিছু দেওয়ার বাকি । ।
- 0 মন্তব্য