• ফুটবল

ক্যালসিওপোলি : ইতালিয়ান ফুটবলের কলঙ্কিত অধ্যায়

পোস্টটি ২১৬৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ইউরোপীয় অঙ্গনে ইতালির সফলতম ক্লাব নিঃসন্দেহে এসি মিলান। সাতবার ইউরোপসেরার মুকুট মাথায় পরেছে রোজোনেরিরা। কিন্তু যদি ইতালির ঘরোয়া ফুটবলের দিকে তাকানো যায়, জুভেন্টাসের আশেপাশেও কাউকে পাওয়া যাবেনা। এখন অবধি ৩৬ টা সিরি আ শিরোপা ঘরে তুলেছে তুরিনের বুড়িরা, যেখানে কিনা যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে থাকা মিলান ও ইন্টারের সিরি আ জয়ের সংখ্যা ১৮ টি করে, জুভেন্টাসের ঠিক অর্ধেক।

ইতালিয়ান ফুটবলের ইতিহাসে বেশিরভাগ সময়ই আধিপত্য বজায় রেখেছে জুভেন্টাস। আর একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই আধিপত্যকে অনেকটা একক আধিপত্যে রূপ দিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু ভাবতে পারেন, এই পরাক্রমশালী জুভেন্টাসকে ২০০৬-০৭ মৌসুম কাটাতে হয়েছিলো ইতালিয়ান ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর সিরি বি তে?

গোড়া থেকেই তাহলে শুরু করা যাক।

২০০৪ সাল। তখনও সিরি আ তে রাজত্ব করছে জুভেন্টাস। সেসময় দলে তারকারও অভাব ছিলোনা। সাদাকালো জার্সি গায়ে তখন মাঠ মাতাতেন বুফন, কিয়েলিনি, থুরাম, ক্যানাভারো, নেদভেদ, ভিয়েরা, ইব্রাহিমোভিচ, ত্রেজেগে, দেল পিয়েরোদের মতো সব কিংবদন্তী ফুটবলাররা।

image_search_1619608888167

হঠাৎ ইতালির ফুটবলে ছোটখাটো বিভিন্ন রকম গুজব ছড়াতে শুরু করে। এর মধ্যে দুইটি গুজব বেশ জোরালো ভাবেই কানে আসতে থাকে। একটি হলো খেলোয়াড়দের ডোপিং নিয়ে, আর অন্যটি ছিলো রেফারিদের ঘুষ দিয়ে জুভেন্টাসের ম্যাচ গুলোর ফলাফল নির্ধারণ নিয়ে।

দ্বিতীয় অভিযোগটি নিয়ে তদন্ত করতে ইতালির বেশ কিছু ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। কিন্তু তারা গন্ডগোল খোঁজার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কিছুতেই যথাযথ প্রমাণ হাতে আসছিলো না। শেষ পর্যন্ত তারা অভিযোগ টা কে ভিত্তিহীন ধরে নিয়ে তদন্ত বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আর ঠিক তখনই টাস্ক ফোর্সের হাতে আসে বেশকিছু কল রেকর্ড, যা মূহুর্তেই ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এসব কল রেকর্ড ছিলো ইতালির ক্লাবগুলোর শীর্ষস্থানীয় কিছু ম্যাচ অফিসিয়ালসের।

টাস্ক ফোর্স সিদ্ধান্ত নেয় এসব প্রমাণ নিয়ে তারা ফুটবল কর্তৃপক্ষের কাছে যাবেন। কিন্তু এর পরের তদন্তে যা বের হয়, তাতে তারা নিজেরাই বোকা বনে যান। যে কর্তৃপক্ষের কাছে তারা যেতে চেয়েছিলেন, সেই কর্তৃপক্ষই যে জড়িত এ কেলেঙ্কারির সাথে!

তার উপর ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং এসি মিলান ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ও মালিক সিলভিও বার্লুস্কোনি এই তদন্তের পক্ষে ছিল না। তিনি চাচ্ছিলেন না যে এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো তদন্ত হোক। কারণ অভিযোগের তীর তার ক্লাব এসি মিলানের দিকেও ছিল। বাধ্য হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা তখন নিজেদের হাতে থাকা প্রমাণ নিয়ে যান মিডিয়ার কাছে। আর মূহুর্তের মধ্যে সব জাতীয় পত্রিকার মূল শিরোনাম হয়ে যায় সেটি, "ক্যালসিওপোলি স্ক্যান্ডাল"।

image_search_1619609825133

রেকর্ডেড ফোনকল গুলো থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সব তথ্য। দেখা যায়, তৎকালীন জুভেন্টাস ক্লাব প্রেসিডেন্ট লুসিয়ানো মজ্জি সিরি আর রেফারি নির্ধারকদের সাথে মিলে নিজের সুবিধামত রেফারি বেছে নিচ্ছেন, মাঠে যাদের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই জুভেন্টাসের পক্ষে যেত। শুধু তাই নয়। জুভেন্টাসের ম্যাচগুলোর রেফারি বেছে নিয়েই থেমে থাকেননি মজ্জি, অন্যান্য দলের মূল খেলোয়াড় যেন জুভেন্টাসের সাথে ম্যাচে সাসপেন্ড থাকে, তারও ব্যবস্থা করতেন। এমনকি সিরি আ ফিক্সচার তৈরিতেও প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি!

এ ফোনকল গুলো থেকে একটি বিরাট নেটওয়ার্ক টের পাওয়া যায়, যার সাথে জড়িত ছিলো ম্যাচ অফিসিয়ালদের সাথে বেনামি ব্যাংক একাউন্ট থেকে বিরাট অঙ্কের লেনদেন ও ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য তাদের দেওয়া প্রচুর অর্থের কুপ্রস্তাব। কিন্তু ফোনকলগুলো বেশিরভাগই ছিলো বেনামি ও বেওয়ারিশ। ফলে কোনোভাবেই এর সাথে মজ্জির জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিলোনা।

১৯ মে, ২০০৬। বিশ্বকাপ শুরু হতে বাকি মোটে আর তিন সপ্তাহ। সেসময় ট্রাইবুনালে ম্যাজিস্ট্রেটদের মুখোমুখি হন ইতালি জাতীয় দলের কোচ মার্সেলো লিপ্পি। লিপ্পি সেখানে স্বীকার করেন যে মজ্জি তাকে বারবার চাপ দিচ্ছিলো যেন জুভেন্টাস থেকে জাতীয় দলে কম খেলোয়াড় নেওয়া হয়। কারণ এতে জুভেন্টাসের খেলোয়াড়দের ইঞ্জুরিতে পড়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।

image_search_1619609755993

কথায় আছে, সব অপরাধীই কিছু না কিছু ভুল করবেই, অপরাধের কোনো না কোনো ক্লু রাখবেই। মজ্জিও ভুল করে ফেলেছিলেন। তিনি ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন ইতালিয়ান ন্যাশনাল রেফারিস এসোসিয়েশনের প্রধান পিয়েরলুইজি জিজি পেইরেত্তো এর সাথে। তার সাথে আলোচনা করে নির্ধারণ করতেন ম্যাচের রেফারি। আর তাদের মধ্যেকার বেশ কিছু কলরেকর্ড থেকে বেরিয়ে আসে সত্যিটা। সেই সাথে পাওয়া যায় নানারকম চমকপ্রদ তথ্য। সেসবের মধ্যে কয়েকটি কলের কথা উল্লেখ না করলেই নয়।

২০০৪ সালের ১১ আগস্ট। একদিন আগে ছিলো জুভেন্টাসের তৃতীয় রাউন্ডের কোয়ালিফাইং ম্যাচ। সেদিনের ফোনকলে মজ্জি বলেন সেই ম্যাচের রেফারিকে জুভেন্টাসের কোনো ম্যাচে যেন অনুমোদন না দেয়া হয় কারণ সেই রেফারি জুভেন্টাসের একটি গোল বাতিল ঘোষণা করেছিল।

তার ১২ দিন পর। পরেরদিন জুভেন্টাসের সাথে ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্টে ম্যাচ ছিলো জুগার্ডিনের। ম্যাচের আগেই পেরেইত্তো মজ্জিকে বলেন জুভেন্টাস ম্যাচটি ৪-১ গোলে জিতবে এবং তাই হয়।

পরের ফোনকলটি হয় জুভেন্টাস বনাম মিলান ম্যাচের রেফারি কে হবে তা নিয়ে। কলে মজ্জি তিজিয়ানো পিয়েরিকে রেফারি হিসেবে চাচ্ছিলেন। সেই ম্যাচে পিয়েরিই ম্যাচ অফিশিয়াল ছিলেন।

ঠিক এক সপ্তাহ পর পেইরেত্তো মজ্জিকে কল করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জুভেন্টাসের উদ্বোধনী ম্যাচ নিয়ে কথা বলেন। ম্যাচটি ছিল আয়াক্সের বিপক্ষে আমস্টারডামে। পেইরেত্তো মজ্জিকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি উরস মায়ারকে আমস্টারডামে পাঠাবেন ম্যাচ পরিচালনার জন্য। এবং প্রত্যাশিত ভাবেই সেই ম্যাচে উরস মায়ারই ছিলেন রেফারি।

image_search_1619609325995

মজ্জি এতকিছু করেও থেমে থাকেননি। ইতালির সবচেয়ে বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার ফ্যাবিও বালডাসের সাথে তিনি ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। মজ্জি বুঝতে পেরেছিলেন যে মাঠের বাইরের লাখ লাখ দর্শকের চোখে যদি রেফারিকে খারাপ দেখানো যায়, তাহলে এরপর থেকে রেফারিরা সহজে তাদের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দিতে চাইবেনা। তাই বালডাস আর মজ্জি সব ম্যাচের আগে একসাথে আলোচনায় বসতেন রেফারিকে নিয়ে কখন কি বলা হবে তা ঠিক করতে।

ম্যাচের মধ্যে বালডাস যখন দেখতেন যে রেফারির সিদ্ধান্ত জুভেন্টাস দলের বিপক্ষে যাচ্ছে, বালডাস তখন রেফারিং নিয়ে এমন মন্তব্য করতেন যা শুনে মনে হত জুভেন্টাসের বিপক্ষে রেফারি বায়াসড সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। বাস্তবে কিন্তু হতো তার উল্টোটা। কিন্তু এতে বালডাসের লাভটা কি? মজ্জি ছিলো তৎকালীন ইতালির শীর্ষস্থানীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার বিশাল নেটওয়ার্ক থাকার কারণে প্রায়ই বিভিন্ন কাজে তার সাহায্য নিয়ে নিজের কাজ হাসিল করতো বালডাস।

ফোনকলগুলো আরও কিছু ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যায়। দেখা যায় শুধু মজ্জিই নন, মিলান, লাৎসিও ও ফিওরেন্টিনাও বেশ কিছু ম্যাচে রেফারি নির্ধারণ করেছে।

এখন স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন মাথায় আসে। রেফারিরা কেন এই অবৈধ পথ বেছে নিতেন? তারা কি যথেষ্ট অর্থ পেতেন না যার ফলে তাদের এ অবৈধ পথে রোজগার করতে হতো? কারণটা ছিলো একটু ভিন্ন। তখন ইতালিয়ান ফুটবলের অন্যতম কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন মজ্জি। তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হলো চাকরি হারানো। তাই সে ভয়ে কেউই তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সাহস পেতোনা।

image_search_1619610197458

অবশেষে আসে শাস্তির পালা। সব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে প্রমাণের ভিত্তিতে পাঁচটি ক্লাব কে শাস্তি দেওয়া হয়।

জুভেন্টাসের ৩০ পয়েন্ট কেটে নেওয়া হয় ও তাদের নামিয়ে দেওয়া হয় সিরি বি তে৷ পরে জুভেন্টাস আপিল করলে কর্তন পয়েন্ট কমিয়ে ৯ এ আনা হয়৷ আগের মৌসুমের চ্যাম্পিয়নের তকমা তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

ফিওরেন্টিনার ১২ পয়েন্ট কেটে নিয়ে তাদেরও সিরি বি তে নামিয়ে দেয়া হয়। ২০০৬-০৭ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করা হয়।

লাৎসিওর সাত পয়েন্ট কেটে নিয়ে তাদেরকেও সিরি বি তে নামিয়ে দেয়া হয়। উয়েফা কাপ থেকে তাদের নাম বাতিল ঘোষণা করা হয়।

এসি মিলান কোনোরকমে রেলিগেশনের হাত থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। তাদের মোট ১৫ পয়েন্ট কেটে নেয়া হয় এবং ২০০৫-০৬ মৌসুম তারা শুরু করে -৩০ পয়েন্ট নিয়ে।

রেজিনা ক্লাব ১৫ পয়েন্ট কর্তনের পাশাপাশি এক লক্ষ পাউন্ড জরিমানা দেয়।

প্রত্যাশিত ভাবেই সবচেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয় জুভেন্টাসের। পয়েন্ট কর্তন এবং রেলিগেশনের পাশাপাশি তাদের ২০০৪-০৫ এবং ২০০৫-০৬ শিরোপা ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং ২০০৫-০৬ এর শিরোপাজয়ী দল ঘোষণা করা হয় ইন্টার মিলানকে। তবে পরবর্তীতে নেপলসের ট্রাইবুনাল এই মর্মে রায় দেয় যে ২০০৪-০৫ মৌসুমটি কোনো অবৈধ কার্যকলাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়নি এবং এর ফলাফল সম্পূর্ণভাবে বৈধ। এর ফলে ২০০৪-০৫ মৌসুমের শিরোপা ফিরে পায় জুভেন্টাস।

image_search_1619608903444

তাতে জুভেন্টাসের ভাঙন ঠেকানো যায়নি। ক্লাব ছেড়ে যান থুরাম, ক্যানাভারো, ভিয়েরা, ইব্রাহিমোভিচদের মতো তারকা ফুটবলাররা। ক্যালসিওপোলির মূল হোতা মজ্জি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে মজ্জিকে ফুটবল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালত একটি ১৫০-পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট প্রকাশ করে ক্যালসিওপোলি স্ক্যান্ডাল নিয়ে। সেখান পরিষ্কারভাবে বলা হয় যে মজ্জির অন্যায্য কার্যকলাপ শুধু ইতালির ফুটবলই নয়, বরং ইতালির সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

ক্যালসিওপোলি স্ক্যান্ডালের পর কেটে গেছে ১৫ টি বছর। ইতালির ফুটবল দেখেছে অসংখ্য চড়াই-উতরাই। এসব ভাঙাগড়ার খেলার মধ্যে এখনও আধিপত্য বজায় রেখেছে জুভেন্টাস। কিন্তু কলঙ্কের কালো দাগ যদি একবার লেগে যায়, তা কি কখনো মুছে ফেলা যায়?