• ফুটবল

কাতেনাচ্চিও থেকে জোনা মিস্তা: দ্য স্কুল অব কাউন্টার অ্যাটাক

পোস্টটি ২৫৫৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সময় বহমান, আপন গতিতে ছুটে চলে অবিরাম। সময়ের সাথে সাথে অবধারিতভাবে পরিবর্তিত হয় অনেক কিছু। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলও এর বাইরে নয়। দেড়শো বছরের পুরানো এই খেলাটির কৌশলে যুগে যুগে এসেছে বহু পরিবর্তন। অনেককিছু হারিয়েও গিয়েছে কালের বিবর্তনে। তবে এর মধ্যেই প্রভাবিত হয়েছে এমন কিছু দর্শন দ্বারা যা সমকালীন যুগ ছাড়িয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে রূপকথায়। বিংশ শতাব্দীর ইউরোপে এরকম এমনই দু'টি দর্শন তৈরী হয়েছিলো, যা এখনো ফুটবল-রোম্যান্টিকদের পাঠ্যসূচীর উপরের দিকে অবস্থান করে। 

আধুনিক ফুটবলের ভিত্তি হিসেবে সর্বপ্রথম যে ট্যাকটিক্সের আবির্ভাব হয়েছিলো তা হলো 'কাতেনাচ্চিও'। মূলত '৩০ এর দশকের ২-৩-৫ বা পিরামিড ফর্মেশন থেকেই উদ্ভব হয়েছিলো ইংরেজিতে 'Door-bolt' বা 'দরজার খিল' নামে পরিচিত এই ফর্মুলার। 

2-3-5_(pyramid).svg

 

'কাতেনাচ্চিও' শব্দটি ইতালিয়ান হলেও প্রথম এর ব্যবহার করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের আধা-পেশাদার ফুটবল দল সার্ভেটের অস্ট্রিয়ান কোচ কার্ল রাপ্পান। পিরামিড ফর্মেশন ভেঙ্গে রাপ্পান দুইজন হাফব্যাককে সার্বক্ষণিকভাবে ডিফেন্সে নিয়ে এসে তৈরী করেন ফোর-ম্যান ব্যাকলাইন যা ছিলো বর্তমান ফুটবলের সবচেয়ে প্রচলিত ৪-৪-২ বা ৪-৩-৩ ফর্মেশনের প্রাথমিক প্রয়োগ। রাপ্পানের ট্যাকটিক্সে চার ডিফেন্ডারদের মধ্যে তিনজনের দায়িত্ব ছিলো কঠোর ম্যান-টু-ম্যান মার্কিং এর মাধ্যমে নিজেদের গোল পোস্টের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বাকি একজন 'আক্রমণাত্মক' ডিফেন্ডার গোলকিপারের ঠিক সামনের অবস্থান থেকে বল দখলের মাধ্যমে সামনে থাকা দুই মিডফিল্ডারদের বলের যোগান দিয়ে দ্রুততম সময়ে আক্রমণ শুরু করতেন। দুই মিডফিল্ডার ও সামনে থাকা রাইট ও লেফট উইঙ্গারদের মাধ্যমেই মূলত আক্রমণ পরিচালিত হতো। দুই উইংয়ে থাকা ফুটবলারদের কাজ নির্ভর করতো বলের পজিশন থাকা বা না থাকার উপর। প্রতিপক্ষের পায়ে বল থাকলে তাঁদের মূল কাজ হতো বিপক্ষের উইঙ্গারদের মার্ক করে রাখা। এই সিস্টেমের মূল থিওরিই ছিলো ম্যান-টু-ম্যান মার্ক করে বিপক্ষ দলের আক্রমণকে প্রতিহত করা। ডিফেন্স ঠিক রেখে আক্রমণে ওঠার এই ট্যাকটিক্স দিয়ে বাজিমাত করেন রাপ্পান। সার্ভেটের হয়ে দুইবার ও পরবর্তীতে গ্রাসহপারের হয়ে পাঁচবার সুইজারল্যান্ডের ঘরোয়া লীগ জয় তাঁর ট্যাকটিক্সের সাফল্যের কথাই বর্ণনা করে। 

Karl Rappan Verru

রাপ্পানের এই ট্যাকটিক্সের ট্রাম্পকার্ড ছিলো গোলকিপারের সামনে অবস্থান করা সেন্টার-হাফ, যেই পজিশনকে সুইস ভাষায় বলা হতো 'ভেরু'। প্রতিপক্ষ রাইট বা লেফট উইং দিয়ে আক্রমণের সময় দুই উইংব্যাকের সাথে ডি-বক্সে থাকা ডিফেন্ডাররাও সামনে এগিয়ে আক্রমণ ঠেকাতে গেলে এই 'ভেরু' পজিশনের ফুটবলারের দায়িত্ব থাকতো ডিফেন্ডারদের ফাঁকা যায়গা কভার করা। অর্থাৎ নিজেদের গোল পোস্টকে যদি 'দরজা' হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাহলে 'ভেরু' পজিশনের খেলোয়াড়কে আক্ষরিকভাবেই 'দরজার খিল' এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হতো। রক্ষণের শেষ ভরসার পাশাপাশি আক্রমণ শুরুর প্রাথমিক ধাপও শুরু হতো এই পজিশন থেকেই। বলতে গেলে দলের সাফল্য, ব্যর্থতা অনেকাংশে 'ভেরু' পজিশনের ফুটবলারটির পারফরম্যান্সের উপরে নির্ভর করতো। 

 

এই ফর্মুলা পরবর্তীতে সোভিয়েত, স্পেন হয়ে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী রূপ পেলো ইতালিতে। ১৯৪৭-৪৮ সালে নেরিও রোক্কোর ১-৩-৩-৩ ফর্মেশনে কুইক কাউন্টার অ্যাটাকিং ফুটবল খেলে সিরি আ রানার্সআপ হয় ত্রিস্তিনা যা এখন পর্যন্ত দলটির ইতিহাসের সেরা সাফল্য। পরবর্তীতে '৬০ এর দশকে রোক্কোর অধীনেই সর্বজয়ী এক দলে পরিণত হয় এসি মিলান। দুইবার সিরি আ, তিনবার কোপা ইতালিয়া, দুইবার ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমানের চ্যাম্পিয়নস লীগ) সহ আরো বেশ কিছু শিরোপা জয় করে নিজেদের ইউরোপীয়ান জায়ান্ট হিসেবে গড়ে তোলে। 

তবে ইতালিয়ান কাতেনাচ্চিও সবচেয়ে পরিণত ও কার্যকর রূপ পায় এসি মিলানেরই চিরপ্রতিদ্বন্দী ইন্টার মিলানের মাধ্যমে। স্পেনের প্রায় সব বড় ক্লাবকে কোচিং করিয়ে ১৯৬০ সালে ইন্টারের কোচ হয়ে আসেন হেলেনিও হেরেরা। দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দুই মৌসুম চোখধাঁধানো আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলালেও দল শেষ পর্যন্ত ট্রফিলেস থাকে। ফলে নিজের চাকরি বাঁচানোর তাগিদেই ট্যাকটিক্সে পরিবর্তন আবার সিদ্ধান্ত নেন হেরেরা। আর তার এই পরিবর্তন থেকেই সে সময়ের ইন্টার মিলান পরিণত হয় 'গ্র্যান্ডে ইন্টারে'। 

Grande Inter

হেরেরা তাঁর দলের ডিফেন্সিভ শেপ ঠিক করার জন্য ৫-৩-২ ফর্মেশন ঠিক করেন। প্রতিপক্ষের আক্রমণকে ঠেকানোর জন্য থাকতেন চারজন ম্যান মার্কিং ডিফেন্ডার, যাদের মূল কাজ ছিলো ইন্টারসেপশন বা ট্যাকলের মাধ্যমে ডি-বক্সের সামনে থেকেই বিপদ সামলানো। সুইজারল্যান্ডে যে পজিশনের নাম ছিলো 'ভেরু' ইতালিতে তার নাম হয়ে যায় 'লিবেরো'। হেরেরার ট্যাকটিক্সে এই পজিশনে সুইপারের দায়িত্ব পালন করতেন আরমান্দো পিচ্চি। রক্ষণভাগকে বিপদ মুক্ত করার পাশাপাশি অসাধারণ লং পাসিংয়ের মাধ্যমে ফরোয়ার্ডদের বলের যোগান দেওয়ার কাজটিও করে যেতেন নিরলসভাবে।  ওভারল্যাপিং ফুলব্যাক জিয়াচিন্তো ফাচেত্তি ম্যান মার্কিং করার মূল দায়িত্বের সাথে কাউন্টার অ্যাটাকে গোল করারও এক বড় উৎসে পরিণত হন। সেকেন্ড স্ট্রাইকার সান্ড্রো মাজোলার সাথে ফাচেত্তি ও বার্গনিচের মত দুই ফুলব্যাকের কম্বিনেশনে ভয়ঙ্কর কাউন্টার অ্যাটাকিং দলে পরিণত হয় ইন্টার মিলান। ১৯৬২ থেকে '৬৬ এই চার মৌসুমে তিনবার সিরি আ এর পাশাপাশি টানা দুইবার ইউরোপীয়ান কাপ জিতে ইতিহাসের পাতায় এক আলাদা স্থান করে নেয় তারা। 

internazionale_champeones

সাফল্যমন্ডিত চার মৌসুম পর কাতেনাচ্চিওর খুঁত বের করার চেষ্টায় প্রথমবারের মত সফল হলো স্কটিশ ক্লাব সেল্টিক। ১৯৬৭ সালের ইউরোপীয়ান কাপ ফাইনালে কোচ জক স্টেইনের আক্রমণাত্মক  ট্যাকটিক্সে ইন্টারকে ২-১ গোলে হারানোর মাধ্যমে শুরু হলো ইউরোপে নতুন এক ফুটবল দর্শনের প্রারম্ভিক প্রয়োগ। কাতেনাচ্চিও সিস্টেমে আউটফিট প্লেয়ারদের প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট পজিশনে থেকে সেই পজিশনের অপজিট প্লেয়ারকে মার্ক করে রাখার দায়িত্ব পালন করতো। সেসময়ে একজন ফুটবলার তাঁর কোচের ঠিক করে দেওয়া প্লেয়িং এরিয়ার বাইরে সাধারণত খেলতেনই না বলে এই সিস্টেমে প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করা সহজেই সম্ভব হত।  ডাচ কিংবদন্তী রাইনাস মিশেলসের টোটাল ফুটবল থিওরির আগমন ঘটলে যখন দলগুলো ক্রমাগত পজিশন পরিবর্তন করা শুরু করলো তখন একজন ফুটবলার রক্ষণের পাশাপাশি আক্রমণেও উঠে আসতো। ফলে ম্যান-টু-ম্যান মার্কিং করতে গিয়ে কোনো সময় একটি পজিশনে কয়েকজন ফুটবলারকে মার্ক করতে হচ্ছিলা আবার কখনো একজনকে মার্ক করতে গিয়ে পিছনে ফেলে আসা ফাঁকা স্পেস কাজে লাগিয়ে বিপক্ষ দল সহজেই আক্রমণে উঠে আসছিলো। 

তোরিনোর কোচ লুইগি রাদিস ও জুভেন্টাসের কোচ জিওভান্নি ত্রাপোত্তনি সর্বপ্রথম এই সমস্যা সমাধানে কাতেনাচ্চিও ফর্মুলার আপডেটেড ভার্সন হিসেবে এক নতুন ট্যাকটিক্স তৈরী করলেন। জন্ম হলো কাউন্টার অ্যাটাকিং ফুটবল রেনেসাঁর, যার নাম জোনা মিস্তা। 

'জোনা মিস্তা' শব্দদ্বয়ের ইংরেজি অনুবাদ  'Mixed Zone'. ইতালির মানুষদের কাছে এটি 'Gioco all'italiana' বা 'The Game in the Italian Style' নামেও পরিচিত ছিলো। আক্ষরিক অর্থেই এই স্টাইলটি পরিণত হয়েছিলো ইতালিয়ান ফুটবলের মৌলিক সংস্কৃতি হিসেবে।

পুরো মাঠকে কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বা জোনে ভাগ করে প্রতিটি ডিফেন্ডার ও মিডফিল্ডারকে দেওয়া হলো নির্দিষ্ট জোনের দায়িত্ব। কোনো ফুটবলার যদি নির্দিষ্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসেন তবে তাঁর কাছাকাছি থাকা সতীর্থের কাজ থাকবে সেই জোন কভার করার। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে একজন ডিফেন্ডার যথারীতি সুইপার বা ফার্স্ট লাইন অব অ্যাটাকের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে যেটাকে 'জোন ১৪' বলা হয় সেই জায়গা কাভার করার দায়িত্ব ছিলো বাকি দুই সেন্টারব্যাকের। লেফট সাইডে কাতেনাচ্চিওর মতই একজন উইংব্যাক ডিফেন্স, অ্যাটাক দুইক্ষেত্রেই সমানভাবে ভূমিকা পালন করতেন। 

Zouna_mista

ত্রাপোত্তনি, রাদিসদের সবচেয়ে বড় আবিস্কার ছিলো ফুটবলের ‘ডার্টি আর্ট’, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশন উদ্ভাবন। লেফট উইংব্যাকের ফেলে যাওয়া স্পেস কভার করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের কাউন্টার ঠেকানোর গুরুভারও থাকতো এই পজিশনের ফুটবলারের উপর। একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, একজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার আর রাইট সাইডে একজন স্লাইড মিডফিল্ডারের মাধ্যমে পুরো মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কৌশলের ফলে একদিকে যেমন ডিফেন্সের নিরাপত্তা বৃদ্ধি হলো আবার ওভারল্যাপিং ফুলব্যাক ও ফরোয়ার্ডরা পেলো আক্রমণের পূর্ণ স্বাধীনতা। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনের পাশাপাশি ফুটবল বিশ্ব 'রেজিস্তা' বা 'নাম্বার টেন' রোলের ফুটবলারকেও অন্যরকম ভূমিকায় ব্যবহৃত হতে দেখলো। প্লে-মেকিং করে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ শেপ ভেঙ্গে দেওয়া, ফরোয়ার্ডদের ঠিকমতো বলের যোগান দেওয়া, সুযোগ পেলে নিজেও গোল করার মতো বহুমুখী দায়িত্বের পাশাপাশি কখনো নীচ থেকে গেম বিল্ডের কাজও করতে হতো রেজিস্তাকে। এককথায় রেজিস্তারা যেন পুরো দলের ইঞ্জিন হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। 

কাতেনাচ্চিও থিওরির ডাবল মার্কিং ডিফেন্সিভ ফর্মুলার সাথে একজন ফুটবলারকে বিভিন্ন পজিশনে পরিবর্তন করে খেলানোর টোটাল ফুটবল ফিলোসফি এক হয়ে জোনা মিস্তাকে করে তোলে সবচেয়ে সাফল্যময়। এমনকি ক্লাব ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই জোনা মিস্তার অর্জন অনেক ক্ষেত্রে এই দুই ট্যাকটিক্সকেও ছাপিয়ে যায়। ১৯৪৯ সালের সুপারগা বিমান দূর্ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ বহু ফুটবলারের মৃত্যুর পর ১৯৭৫-৭৬ মৌসুমে প্রথমবারের মত সিরি আ এর চ্যাম্পিয়ন হয় লুইসি রাদিসের তোরিনো। আর জিওভান্নি ত্রাপোত্তনি তো আরোহণ করেন সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায়। জুভেন্টাসকে রেকর্ড ছয়বার স্কুদেত্তো জেতানোর পাশাপাশি প্রথম দল হিসেবে সবধরণের উয়েফা টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন করানোর রেকর্ডও করেন এই বর্ষীয়ান কোচ। 

Juventus,_Coppa_dei_Campioni_1985

তবে এই ট্যাকটিক্স থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় ইতালি জাতীয় দল। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ইতালির মূল দলের প্রায় সকল ডিফেন্ডার ও মিডফিল্ডাররা ছিলেন জুভেন্টাস ও ইন্টার মিলানের। তৎকালীন ইতালি কোচ এনজো বিয়ারজোত এখান থেকেই তৈরী করলেন একটি সঠিক সমন্বয়। ডিফেন্সে 'লিবেরো' বা সুইপার পজিশনে জুভের গায়েতানো স্ক্রিয়া, সেন্টারব্যাক ডুয়ো ইন্টারের ফুলভিও কোলোভাতি ও জুভেন্টাসের টাফ ট্যাকলার ক্লদিও জেন্টাইল, লেফট উইংব্যাকে জুভের আন্তোনিও কাব্রিনির সাথে ইন্টারের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার গ্যাব্রিয়েল ওরিয়ালি মিলে গড়ে তোলেন এক দূর্ভেদ্য ডিফেন্স। ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারীতে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে এসে জুভেন্টাসের পাওলো রসির ব্রাজিলের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় এক পারফরম্যান্সে অণুপ্রানিত হয়েই কি না শেষ পর্যন্ত ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় আজ্জুরিরা, যা ছিলো ১৯৩৮ সালের পর প্রথম। 

Italy 1982 FIFA WC

হেলেনিও হেরেরার সর্বজয়ী 'গ্রান্ডে ইন্টার' যেমনিভাবে '৬৭ সালের ইউরোপীয়ান ফাইনালে সেল্টিকের কাছে হেরে কাতেনাচ্চিওতে পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করে ঠিক তেমনিভাবে '৮৩ সালে হামবুর্গের কাছে হেরে গিয়ে জোনা মিস্তাও বুঝতে পারে, ট্যাকটিক্স ক্রমাগত অভিযোজনশীল। তবে ইতালিয়ান স্কুলের সেই পাঠ কে ভিত্তি করেই তৈরী হয়েছে আধুনিক সময়ের ভয়ংকর সুন্দর কাউন্টার অ্যাটাকিং ফুটবলের নীলনকশা। কার্লো আনচেলত্তি, জোসে মরিনহোদের মত জিনিয়াসরা এই তথাকথিত ‘রক্ষণাত্মক’ ট্যাকটিক্সের সাথে হাই-প্রেসিং যুক্ত করে তাঁদের দলদেরকে করেছেন বিশ্বসেরা। লো-ব্লক ডিফেন্সিভ দলগুলো যেকোনো বড় দলের সাথে লড়তে গেলে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে এই ফর্মুলাকেই। 

ফুটবল খেলার সৌন্দর্যের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। বল পজিশন ধরে রেখে ধীর-স্থিরভাবে বারবার আক্রমণ করা বা প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে দ্রুততম সময়ে প্রতি-আক্রমণ করা, দুটিই ফুটবলের সৌন্দর্য। কালের বিবর্তনে এই সৌন্দর্য হয়তো বারবার পরিবর্তিত হয়। কিন্তু কার্যকারিতার মানদন্ডে কিছু নির্দিষ্ট সময়ের ফুটবল দল আর তাদের কৌশল মানুষের মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে চিরকাল। 

২০০৬ এর বিশ্বকাপ জয়ের পর ঘরোয়া লীগের সীমাহীন কেলেঙ্কারীতে একটা প্রজন্ম ইতালিয়ান ফুটবলের ব্যর্থতার চিত্রই কেবল দেখে এসেছে, যেই ব্যর্থতার চূড়ান্ত পরিণতি ছিলো ২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব থেকে বাদ পরা। সুইডেনের বিপক্ষে হেরে লজ্জাজনক সেই বিদায়ের পর রবার্তো মানচিনির অধীনে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে ইতালি। বিশ্ব ফুটবলের খোলনলচে পাল্টে দেওয়া দুই ট্যাকটিক্সের জন্ম যে দেশে তারা কি আবারও বড় মঞ্চে নিজেদের চেনাতে পারবে কি না তা এ বছরের ইউরো বা সামনের বছরের বিশ্বকাপেই হয়তো বুঝা যাবে। তবে ব্যর্থতার চোরাবালিতে ইতালিয়ান ফুটবল ডুবে গেলেও ওল্ড স্কুল ট্যাকটিক্স বিভিন্ন ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যে ঠিকই জেগে থাকবে, এ ব্যাপারে সংশয় সামান্যই।