মা, তোমার ছেলে আজ লড়তে জানে
পোস্টটি ১৪৬০ বার পঠিত হয়েছে
ট্রাউজার'টা ভাঁজ করে আবার জায়গা মতো রেখে দিলেন মেলানি। আর তারপর শুষ্ক এক হাসি।
ব্যাপার'টা চোখ এড়ালো না ক্যাথের। ক্যাথ এই দোকানে চাকরি নিয়েছে মাস দুয়েক হলো। এরই মধ্যে ঘটনাটা তিনবার ঘটলো। তার বুঝতে বাকি রইলোনা মহিলা নিশ্চয়ই আর্থিক সংকটে আছেন। নয়তো লাল চকচকে ট্রাউজারটা এতোদিনে কিনেই ফেলতেন! বেচারির জন্য মায়া হলো ক্যাথের; হায় ঈশ্বর, এভাবে প্রিয় জিনিসটা অনেক সময় টাকার অভাবে অন্যের হয়ে যায়!
অবশ্য মেলানি এবার সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছিলেন। পকেটে পয়সা যা ছিল তাতে এটার দাম চুকে যাওয়ার কথা। বেচারা মার্কাস হয়তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঘরবাড়ি চেঁচিয়ে উঠতো! ভাবতেই মায়ের কোমল হৃদয়ে গভীর দুঃখবোধের জন্ম দিলো। খানিকের জন্য নিজেকে এ পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ মা বলেও জাহির করতে তার কুণ্ঠাবোধ হলো না।
ঘরে ফেরার পথে তাই এ মাসের মাইনের শেষ এক তৃতীয়াংশ দিয়ে খাবার কিনে ফেললেন মেলানি। জানেন, এই খাবারটুকু ফুরিয়ে গেলে তার ঘরে আর খাবার খাওয়ার উপায় থাকবেনা। বড্ড বেশি চিন্তিত দেখালো তাকে। মেলানি বরং কাজ খুঁজতে থাকেন। পেয়েও গেলেন, ২ জায়গায় ২ ধরনের কাজ- মোটে ৩ টি! বাচ্চাগুলার মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য তাকে হাসিমুখে এই সংগ্রামটুকু করতেই হয়!
ওদিকে মার্কাস বড় হচ্ছে অযত্নে, অবহেলায়। জন্মদিনে তার জন্য খেলনার সেট নিয়ে না আসায় মোটেও ক্ষুব্ধ নয় সে। মা তো কষ্ট করে হলেও ফুটবল'টা এনে দিয়েছেন, আর কি চাই মার্কাসের! দৌড়ে গিয়ে কালো মার্কার এনে নতুন বলে মার্কাস গুটিগুটি অক্ষরে লিখে ফেললো, 'মার্কাসের বল'।
সেই বল দিয়ে ঘরে খেলার সময় নিতান্ত প্রয়োজনীয় একসেট কাপ-পিরিচ ভেঙ্গে ফেলার পরও মায়ের শুধু শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য দেখে মার্কাস অবাক হয়ে গিয়েছিলো! গার্ডেন কি ঘরের মেঝে, গ্যারেজের ছাদ কি রাস্তায়- মার্কাসের ফুটবল খেলার নেশা দিনদিন আসক্তিতে রূপ নিচ্ছে এটা মেলানি বুঝতে পারছিলেন বটে। তবু মার্কাস মা'কে কোনোভাবেই আকৃষ্ট করতে পারছিলো না- তাকে ফুটবল ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দেয়ার বন্দনায়।
বছরখানিক পরেই হাজার চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেবার যখন সে সুযোগ'টা এলো, তখন ঘটলো অন্য বিপত্তি! ট্রেনিং করতে যাওয়া আসার যাতায়াত খরচ বহন করার সামর্থ্য যে নেই মার্কাস ফ্যামেলির!
যদিও ফুলটাইম মেলানি'কে কাজ করতে হতো, তবু মার্কাসের ভাইবোনদের না খেয়ে অপেক্ষা করতে হতো মায়ের। তিন বেলা খাবার মুখে তুলতে পারাটাই তখন সংগ্রামের। মার্কাস তো অকপটে স্বীকার করে, 'যদি টেবিলে খাবার থাকতো, তাহলে খাবার আছে, যদি না থাকতো তাহলে আমাকে আমার বন্ধুদের ঘরে যেতে হতো। সেই সব বন্ধুদের কাছে, যারা সত্যিই আমার অবস্থা বুঝতো।'
সংসারে বাবা নেই। মায়ের কঠিন কাজ। ভাইবোন'দের কাজের বয়স হয়নি তখনো। ঈশ্বরের এক অলৌকিক শক্তিতে চলছে ছ'জন মানুষের সংসার। মার্কাসেরা দেখে তাদের মা কাজে যান। আসলে মেলানি যান রণক্ষেত্রে। ঘামে বিপর্যস্ত তার মুখটা দেখায় সদ্য যুদ্ধ ফেরত তুখোড় কোনো গেরিলার মতো। দিনের পর দিন সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের বিদ্রোহ চালিয়ে যান মার্কাসের মা, একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে নতুন সূর্য উদয় হবে বলে।
-
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজ আকাশে নতুন সূর্য উঠেছেও একদিন। মার্কাস এখন ইংরেজ প্রিন্স। নামের শেষে MBE উপাধি। খেলে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে, প্রতিনিধিত্ব করে জাতীয় ফুটবল দলের! গ্যারেজে তার প্রিয় সব গাড়ির বাহার। ৮ লক্ষ পাউন্ডের বাড়ি তার পছন্দ হচ্ছিলো না বলে নিজের কাষ্টমাইজকৃত ১.৮৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বাড়িতে উঠেছে সে। মাঝেমধ্যে মার্সিডিজ বেঞ্জ পাশে সরিয়ে রেখে উঠে পড়ে চপারে। প্রাইভেট জেট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ভ্যাকেশন কাটায় সুন্দরতম সব স্থানে।
তবে এসবের কিছুই ছিল না তার। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আসার পূর্বে তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জীবন কাটাতে হয়েছে। ১০ বছর বয়সে মেলানির কঠিন এক সিদ্ধান্তে মার্কাসের স্থান হয়ে যায় ইউনাইটেডের স্কুলবয় স্কলার্স স্কিমে। তবে তার জন্য ইউনাইটেডের কাছে সহানুভূতি চাইতে হয়েছে মা'কে। মেলানি যেন রেহাই পেলেন, ঘরে এখন একজনের খাবার কম লাগবে!
তখন, খাবারের টেবিলে মার্কাস না থাকলেও সে ছিল মায়ের প্রার্থনায়। মায়ের বোবাকান্না অশ্রুর ঢল- সেতো সে কখনো দেখেনি! ইউনাইটেডের ট্রেইনিংয়ে সুযোগ পাবার পর নিজ হাতে লেখা 'ফিউচার অ্যান্ড এইমস' এর কথাটা মা'কে কখনো জানায়নি মার্কাস। সে লিখেছিলো- আমার ভবিষ্যতের জন্য একটাই লক্ষ্য তা হচ্ছে প্রফেশনাল ফুটবলার হওয়া, এবং আশা করি সেটা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেই'।
অর্থসংকটে ছেলের জন্য প্রিয় ট্রাউজার কিনতে না পারা মেলানি''কে আমরা বহুদিন পর আবার দেখতে পাই বিবিসির পর্দায়! ততদিনে তিনি এক গর্বিত জননী। তবু চোখেমুখে তার এতটুকু অহংকার নেই। তার সেসব দিনের আত্মত্যাগ আজ যেন স্ফুলিঙ্গ হয়ে প্রচার হচ্ছে টিভিতে টিভিতে। 'মাঝেমাঝে আমাদের এমন দিনও গেছে, ব্রেড কেনার পর্যন্ত অবস্থা ছিল না!' মেলানি একটু সময় নেন, কান্না থামিয়ে আবার বলতে শুরু করেন আবার। 'হ্যাঁ, এটা লজ্জাজনক ব্যাপার, তবু বলছি- ব্রেড কিনে খাওয়ারও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিলাম আমরা।'
সাক্ষাৎকার নয়, সহজ স্বীকারোক্তি দিতে আসা এক গর্বীত মায়ের গল্প এটি। যে মায়ের কনিষ্ট সন্তান আজ হাজারো কিশোরের জন্য অনুপ্রেরণা; যাকে নিয়ে ভাবে পুরো এক জাতি। ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে উঠে আসা সে কিশোর ইংলিশ ফুটবল ইতিহাসের এক অনন্য উদাহরণ- জিরো থেকে হিরো হয়েছে যারা।
গল্পের এই হিরোর নাম মার্কাস। মার্কাস রাশফোর্ড; তরুণ ইংরেজ সেনসেশন। চিনতে ভুল হয়?
তবে এই হিরো হওয়ার আগে ও পরে তার কত কি অর্জন; কতসব সুন্দর স্মৃতি, গভীরতম আনন্দের বহু ক্ষণ কিংবা মা'কে তার গর্বিত করার সেসব মূহুর্ত! কিচ্ছু নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমি শুধু এক সংগ্রামী মায়ের গল্পে মেতে থাকতে চাই, যার সংগ্রাম, বিদ্রোহ- আত্মত্যাগ আর প্রার্থনায় কেবল ছিল সন্তান। যে গর্বিত সন্তান নক্ষত্র হয়ে মায়ের পুরো আকাশ'টাই ঢেকে ফেলেছে। মার্কাস সত্যিই আজ লড়তে জানে...
মেলানি'র মতো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব মায়েকে মা দিবসের শুভেচ্ছা। মায়েরা কখনো হারেন না, তারা হেরে গিয়ে হলেও জিতিয়ে দেন সন্তানদের। তাদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য