বাংলার ফুটবল মুক্তির ৬-দফা (৪র্থ পর্ব); প্রীতি ম্যাচে কিসের ভয়? ভয়ের পরে আছে জয়;
পোস্টটি ৭৩৯ বার পঠিত হয়েছে
ইউরোপের ব্যস্ততম ক্লাব মৌসুমের মাঝেই প্রতি মাসের বেঁধে দেয়া আন্তর্জাতিক বিরতির জানালা ধরে জাতীয় দলগুলো নেমে পড়ে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের লড়াইয়ে। বৈশ্বিক মহামারীর নতুন পরিস্থিতিতে সবকিছুর মত ফুটবল দুনিয়াতেও ঘটেছে নানা পরিবর্তন। লীগ ও অন্যান্য প্রতিযোগীতার ব্যস্ত মৌসুম শেষে বিশ্ব মহামারীকে সামলে নিতে এক বছর পিছিয়ে যাওয়া দুই দুইটি মহাদেশীয় আসর হয়ে গেল সমহিমায়। তাই এবারের মৌসুমে খেলোয়াররা নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাননি। তার মাঝেও বন্ধ ছিলনা প্রীতি ম্যাচের আয়োজন। বাধ্যবাধকতা না থাকলেও মহামারী ঠেকাতে নিশ্ছিদ্র জৈব সুরক্ষা বলয় তৈরি করে, বিমান চলাচলের বিধি নিষেধের সাথে খাপ খাইয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খেলোয়ার জড়ো করতে অনেক বেশি বেগ পেতে হলেও নির্ধারিত সময়ে এসব ঐচ্ছিক প্রীতি ম্যাচ থেকে পিছু না হটে শীর্ষ দেশগুলো প্রমাণ করেছে নামে “প্রীতি ম্যাচ” হলেও এসব আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ম্যাচকে কতটা গুরুত্ব দেয় তারা। প্রতিযোগীতামূলক ম্যাচের মত না হলেও ফিফার কাছেও এসব ম্যাচের গুরুত্ব আছে। তাই প্রীতি ম্যাচের ফলাফলও ফিফার র্যাংকিং এ প্রভাব রাখে। এ সুযোগে ইউরোপের দুর্বল দেশগুলোও প্রচুর ম্যাচ খেলছে রীতিমত ইউরোপ তথা বিশ্ব জায়ান্ট দলগুলোর সাথে। এইতো ইউরো প্রতিযোগীতা শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে র্যাংকিং এ বাংলাদেশের আশে পাশে থাকা লাটভিয়া খেলেছে চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানীর সাথে। তার কয়েকদিন আগেই ফিফা র্যাংকিং এর সবচেয়ে নীচে থাকা স্যান ম্যারিনো আর বাংলাদেশের ঠিক এক ধাপ উপরে থাকা লিখটেনস্টাইন খেলেছে যথাক্রমে চারবারের অপর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইটালি আর র্যাংকিং এ শীর্ষ দশে থাকা পরাশক্তি সুইজারল্যান্ডের সাথে। বলাই বাহুল্য অতীতের মত সাম্প্রতিক সময়ের এসব প্রীতি ম্যাচেও ফুটবলের ছোট দেশগুলো বেশ বড় ব্যবধানেই হেরেছে অসম প্রতিপক্ষের সাথে।
চিত্রঃ ইউরো ২০২০ এর ঠিক আগের শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি নিতে চার বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইটালি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ফিফা র্যাংকিং এর সবচেয়র দুর্বল দল স্যান ম্যারিনোর। সেই ম্যাচের একটি মূহুর্ত।; Image Source: AP
শুধু ইউরোপেই নয়, ছোট বড় দেশের অসম লড়াইয়ের এই চল আছে এশিয়াতেও। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ খেলতে নামার আগে নিজেদের ঝালিয়ে নিয়েছিল সাবেক এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন ইরাকের সাথে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলে। অথচ বাংলাদেশ প্রীতি ম্যাচের সু্যোগ তৈরি করতে না পেরে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগীতার প্রস্তুতি সেরেছে স্থানীয় ক্লাব আর কাতারের দ্বিতীয় স্তরে খেলা ক্লাব দলের সাথে।
শক্তিশালী দেশগুলোর বিপক্ষে পাওয়া আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলার সুযোগ নিঃসন্দেহে দুর্বল দলগুলোর জন্য বিশেষ পাওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ছোট দেশগুলোকে উন্নতির সুযোগ দিতে বড় দেশগুলো কেন খেলে এসব ম্যাচ? কথায় আছে কারণ ছাড়া গাছের পাতাও নড়েনা। আর এতো রীতিমত ফুটবল যুদ্ধ! কারণ আছে বৈকি। ছোট দেশগুলোর মত না হলেও এসব ম্যাচ থেকে বড় দেশগুলোরও প্রাপ্তি রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জাতীয় দলকে আলাদা প্রস্তুতি ছাড়াই আন্তর্জাতিক ম্যাচ আবহে এক সূতায় গাঁথতে, দলের কম্বিনেশন পরখ করে নিতে, তরুণ প্রতিভাকে চাপমুক্তভাবে নিজেদের প্রমাণের সুযোগ করে দিতে ছোট দেশগুলোর চেয়ে ভাল প্রতিপক্ষ আর কি হতে পারে? বড় দেশগুলো তাই জাতীয় দলের বেঞ্চের শক্তি পরখ করে নিতে, সঠিক ফর্মেশনের খোঁজে, ভবিষ্যতের খেলোয়ারদের জাতীয় দলের সাথে পরিচয় করে দেয়ার মত নানাবিধ যৌক্তিক কারণে ছোট প্রতিপক্ষ খুঁজে নেয়।
অন্য যে কোন খেলার মত ফুটবলের উন্নতির অন্যতম প্রধান ও মৌলিক শর্ত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে যত বেশি সম্ভব ম্যাচ খেলা। বাংলাদেশ ছাড়া প্রতিবেশী সব ছোট শক্তির দেশ তা জানে। বাংলাদেশ কি কখনো জাপান, কোরিয়া বা ইরানের সাথে খেলেছে? সময় সুযোগ মিলিয়ে এসব বড় প্রতিপক্ষের সাথে নিয়মিত ম্যাচ আয়োজনের চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে। সেই চ্যালেঞ্জটা নেয়ার সদিচ্ছা কি বাফুফে কখনো দেখিয়েছে? বাফুফে চাইলে তো পৃথিবীর উল্টো দিকের ল্যাটিন পরাশক্তি আর্জেন্টিনা আর আফ্রিকান সুপার ঈগল নাইজেরিয়াকেও উড়িয়ে নিয়ে আসতে পারে, আমরা চাক্ষুষ দেখেছি। বাফুফের সভাপতিতো প্রায়ই সগর্বে এএফসির শীর্ষ দেশগুলোর ফুটবল প্রধানদের সাথে তার সুসম্পর্কের কথা জানান দেন। সেই সুসম্পর্ক ধরে হোক, অথবা এএফসির নির্বাচনে বাংলাদেশের মূল্যবান ভোটটির বিনিময়ে বছরে একটি প্রীতি ম্যাচের শর্তজুড়ে হোক, কিংবা আরব দেশগুলোর সাথে কুটনৈতিক সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে হোক, এশিয়ান পরাশক্তি দেশগুলোর সাথে নিয়মিত হোম কিংবা এওয়ে প্রীতি ম্যাচ আয়োজন অসম্ভব নয়। বড় দলগুলোর সাথে খেলা আয়োজনের পেশাদারিত্ব দেখাতে হলে বড় দলের বাৎসরিক সূচীর সাথে খাপ খাইয়ে প্রায় বছর খানেক আগে থেকেই সূচী প্রস্তুত করে রাখতে হয়। এসব পেশাদারিত্ব থেকে বাফুফে আপাতত মঙ্গল গ্রহের দূরত্বে আছে। তাই বিশ্বকাপ বাছাইয়ের মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে কোচের কাছ থেকে শোনার পর তাদের বোধদয় হয় বিশ্বকাপ বাছাইয়ে নামার আগে প্রস্তুতির জন্য প্রীতি ম্যাচের দরকার। এত কম সময়ে শক্তিশালী দেশতো দূরে থাকুক, সাধারণ মানের কোন দেশকেও আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের জন্য রাজি করা সম্ভব নয়। বাফুফে অভ্যন্তরীণ সূচীই যেখানে অনেক সময় আগে থেকে ঠিক করতে পারেনা, আন্তর্জাতিক ম্যাচতো অনেক পরের ব্যাপার। তাই স্থানীয় দলের সাথে আর বিদেশের দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরের আধা-পেশাদার বা অপেশাদার ক্লাব দলের সাথে ম্যাচ খেলেই বড় প্রস্তুতি সারতে হয় আমাদের। তবে বাফুফে অবশ্য বলতে পারে, কোভিড-১৯ বিশ্ব মহামারীর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পৃথিবীর কিছুই যেখানে স্বাভাবিক সূচীতে চলতে পারছেনা, তখন আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ না করতে পারার জন্য তাদের দায় কতটুকু? হয়তো খুব বেশি না। কিন্তু কোভিড মহামারীর পূর্ববর্তী সময়েও বাফুফে কি কখনো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলতে নামার উদ্যোগ নিয়েছিল? সমস্যা শুধু পেশাদারিত্বের নয়, মানসিকতারও। এশিয়ার পরাশক্তিদের সাথে ম্যাচ আয়োজনের সৎ সাহস আমাদের কখনোই ছিলনা। ৮-০ গোলে ম্যাচ হেরে লোক হাসিয়ে এবং অনর্থক ফুটবলানুরাগীদের সমালোচনার সুযোগ করে দিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারার মত বোকা অন্য দেশগুলোর ফেডারেশন হতে পারে, বাংলাদেশের নয়। বাফুফে তাই ভাবে, ভয়ের পরে আছে জয়, এসব কথা বোকা বাক্সের বিজ্ঞাপনেই মানায়।
প্রীতি ম্যাচ যে একেবারেই খেলেনা বাংলাদেশ, তা নয়। বাড়ির পাশ থেকে নেপাল, ভুটানদের সাথে মাঝে মধ্যে প্রীতি ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করে বাফুফে। তবে বড় ম্যাচের কঠিন প্রতিপক্ষর সাথে লড়াই করার মানসিকতা ভুটানের মুখোমুখি হয়ে পাওয়া যায়না।
চিত্রঃ বাংলাদেশ বনাম নেপাল, আন্তর্জাতিক প্রীতি ফুটবল ম্যাচ, ঢাকা, বাংলাদেশ; নভেম্বর ১৭, ২০২০; Image Source: UNB
বড় দলকে আমন্ত্রণ জানাতে এতটাই অনীহা বাফুফের, যে ঘরের মাঠে জাতির জনকের নামে আয়োজিত দেশের সেরা আন্তর্জাতিক প্রীতি টুর্ণামেন্টেও তাদের চোখ থাকে দুর্বল প্রতিপক্ষের সন্ধানে। নামে আন্তর্জাতিক হলেও প্রায়ই এশিয়ার মধ্যম শক্তির কিছু দেশের বয়সভিত্তিক দলকে ডেকে আনা হয়। নিজেদের জাতীয় দল নামিয়ে এদের হারিয়ে টুর্ণামেন্ট জিতে এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের আশায়। প্রথম পাখি জাতির জনকের নামে ট্রফি জিতে সরকারের সন্তুষ্টি অর্জন। দ্বিতীয় পাখি, ফুটবলপ্রেমী দেশবাসীকে মিথ্যে উন্নতির বিজ্ঞাপন প্রদর্শন। বয়সভিত্তিক দলের অংশগ্রহণের কারণে সেইসব আসরে না থাকে ফিফার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, না পাওয়া যায় বিশ্বমানের দলের সাথে লড়াই করার অভিজ্ঞতা। এমনকি এসব করে আন্তর্জাতিক মহলে আসরটির গুরুত্ব কমতে কমতে এমন জায়গায় উপনীত হয়েছে যে এশিয়ার দুর্বল প্রতিপক্ষ যোগাড় করতে ব্যর্থ হয়ে বাফুফে সর্বশেষ আসরে হাজার মাইল দূরের আফ্রিকা থেকে উড়িয়ে এনেছিল সিশেলস এর মত কম্মিনকালেও না শোনা নামের দেশকে। ফিফা র্যাংকিং এ যাদের অবস্থান সর্বশেষ কাতারে। বেড়াল ছানারা নিজেদের মধ্যে খেলাচ্ছলে লড়াই করে করে ইঁদুর শিকাড় করা শিখলেও সেই বিদ্যায় বাড়ির এলসেশিয়ানটিকে ঘাঁটাতে যায়না। বড় দলের সাথে নিয়মিত মোকাবেলা ছাড়া ফুটবলে উন্নতি স্রেফ অসম্ভব। তাই বিশ্বকাপ বা এএফসি কাপের বাছাইয়ে কয়েক বছর পর পর অনেকটা বাধ্য হয়েই এশিয়ার পরাশক্তিদের সাথে খেলতে হয় আমাদের। মুখে স্বীকার না করলেও সেইসব ম্যাচে নামার আগে আমাদের অবস্থা হয় অনেকটা চিড়িয়াখানায় বাঘের খাচায় ছেড়ে দেয়া জীবন্ত খরগোশ ছানার ছেঁড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচির মত। বড় প্রতিপক্ষের সাথে মাঠে নেমে নতুন কিছু হারানোর নেই, জানা সত্ত্বেও নিজেদের সেরা খেলাটাতো দূরেরে ব্যাপার, স্বাভাবিক খেলাটাও খেলতে পারেনা বাংলাদেশ। এ দায় আমাদের খেলোয়াড়দের নয়, নীতি নির্ধারকদের। এশিয়ান জায়ান্টদের সাথে খেলার মনস্তাতিক চাপ সামলাতে হলে আগে ফুটবল অভিভাবকদের নিজেদের ইনফেরিওর কমপ্লেক্স কাটিয়ে উঠতে হবে।
চিত্রঃ বিশ্বসেরা লিওনেল মেসি বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, বাংলার মাটিতে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে চলছে আর্জেন্টিনা বনাম নাইজেরিয়া প্রীতি ম্যাচ। অথচ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক টুর্ণামেন্টে দল না পেয়ে আনতে হয় সিশেলসের মত নাম না জানা দেশকে। Image Source: YouTube
যদি কখনো বাংলাদেশ সদিচ্ছা আর চ্যালেঞ্জ নেয়ার সাহস সঞ্চার করে সত্যিই প্রতি মাসের আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের জন্য বরাদ্দকৃত সপ্তাহে একটি করে এশিয়া বা আফ্রিকার শক্তিশালী প্রতিপক্ষর সাথে ম্যাচ আয়োজনের সুযোগ নিতে পারে, তবে তা হবে সত্যিকার উন্নতির পথে হাঁটা এক চমৎকার পদক্ষেপ। বছরের ৭-৮টি বড় ম্যাচ ঘিরে ১২ মাস ধরে জাতীয় দলকে অনুশীলনে রাখার পরিকল্পনা এক ধাক্কায় আমাদের অনেকটা এগিয়ে নেবে। এফএফসির বিশ্বকাপ আর মহাদেশীয় প্রতিযোগিতার বাছাই পর্বে বড় প্রতিপক্ষর মুখোমুখি হলে তখন আর ম্যাচ শুরুর আগেই মনস্তাতিকভাবে ভেঙ্গে পড়বেনা বাংলাদেশ। মধ্যম শক্তির দেশগুলোর সাথে বুক চিতিয়ে লড়াই করার রসদ আর অঘটন ঘটানোর স্বপ্ন দেখার ঘাটতি হবেনা জাতীয় দলের হয়ে নিয়মিত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মোকাবেলা করা খেলোয়াড়দের। আর যেকোন মহান কিছুর শুরুটাতো হয় স্বপ্ন দেখার সৎ সাহসের মধ্য দিয়েই।
Special thanks to Freeflagicons.com for allowing me to use the wonderful thumbnail in this blog article
- 0 মন্তব্য