• ফুটবল

এই অবেলায় তোমারই আকাশে নিরব আপোষে ভেসে যায়!

পোস্টটি ৩০৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

এয়ারপোর্টে আপনি সাধারণত দুই ধরনের মানুষ দেখতে পাবেন। এক ধরনের মানুষ- যারা কেউকে বিদায় দিতে এসেছে। আরেক ধরনের মানুষ- যারা প্রিয়জনকে রিসিভ করতে এসেছে। দুই ধরনের মানুষের চোখেমুখে আপনি দু'ধরনের আলাদা প্রতিক্রিয়া দেখতে পাবেন। একদলের কষ্টে বুক ফেটে যায়, কান্নায় কাপড় ভিজে! আরেক দল প্রাণ খুলে হাসে, আনন্দে। 

 

যারা তাদের প্রিয়জন বিদায় দিতে যায়, তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন এই মূহুর্তটা কেমন লাগে। এই জিনিসটা আমার সাথে বেশ কয়েকবার হয়েছে, আমি জানি এর অনুভূতি কেমন। বিদায় জিনিস’টা প্রচন্ড খারাপ। বুক ফেটে কান্না আসে। 

 

ভিন্ন এক দৃশ্যপটে চোখ রাখা যাক। 

 

রোজারিও। মধ্য আর্জেন্টিনার এই অঞ্চলের গ্রোথ হরমোনের সমস্যায় ভোগা এক কিশোরের সাহায্য এগিয়ে এসেছিলো এফসি বার্সালোনা। নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজে খেলা এই কিশোরের পায়ে বিধাতা কি এক জাদু এঁটে দিয়েছেন, তা কেবল তিনিই জানেন! ১৩ বছরের ক্ষুদে মেসির পায়ে ফুটতো ফুটবলের অচেনা সব ফুল! মুগ্ধ হয়ে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে তাকা ছাড়া আর কি-ই বা করার থাকতো সবার। 

 

বার্সালোনা শহরে তার প্রথম পদরেখা পড়লো খুব সাদামাঠা'ভাবে। সোনালী চুলের বালকের সঙ্গী কেবল একটা স্যুটকেস। জানালার কাছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে যেকেউ ভাববে- হায়, এ শহরের আলোবাতাস, বিস্তীর্ণ নীল আকাশ- কেউই তো তাকে চেনে না। খানিক সন্তর্পণে মনের আঙ্গিনায় হয়তো একরাশ বিষণ্ণতায় নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে যাওয়ার পণ সেদিন নিয়েই নিয়েছিলো সে বালক! 

 

নয়তো, এ কেমন বিস্ময়ে মানুষ তাকিয়ে থাকে তার পায়ে! এ কেমন মোহ তার খেলায়? এই বালক তবে শহরের বিস্তীর্ণ আকাশের বিশালতাকে ছাপিয়ে পুরো বিশ্বে এক নামে নিজেকে প্রতিষ্টিত করে ফেলছে চায়?

 

বালক মেসির পরিণত মেসিতে রূপান্তরিত হওয়ার যাত্রাটা সরলতায় ভরপুর। ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা আর একাগ্রতা, মেধাকে কাজে লাগিয়ে তার ছুটে চলায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি কোনো কিছুই। মেসি যখন সবুজ ঘাসে ছুটে চলেন, তাকে চিতাবাঘ ভেবে ভ্রম হয় প্রতিপক্ষের। দিনকে দিন আগুনে পোড়া খাঁটি সোনার মতো নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিলেন মেসি। শ্রেষ্টত্ব তাই তার পায়ে এসে লুটে পড়ছিলো। সেসব সফলতার গল্প থাক। 

 

একজন ফুটবলার তার ক্যারিয়ারে ভুরিভুরি গোল দেয়া, শিরোপা জেতা কিংবা ব্যক্তিগত অর্জন ছাড়া আর কি-ই বা চাইতে পারেন! শুধুমাত্র পায়ের জাদুতে ক্লাবের সর্বকালের সেরা প্লেয়ার হয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়; এ জীবনে ক্লাব ক্যারিয়ারে তার অধরা কোনো কিছুই তো রইলো না। ব্যক্তিগত অর্জনে ক্যাবিনেট পরিপূর্ণ। ১৩ বছরের সে কিশোর বড় হতে হতে ক্লাবকে'ই বড় বানিয়ে দিচ্ছিলেন ইতিহাসের পাতায়। 

 

আধুনিক ফুটবলে টাকার ঝনঝনানিতে মূহুর্তেই বদলে যায় ড্রেসিংরুম। বদলে যায় মামুষের আশৈশব পুরোনো প্রাণের দল। নতুন পরিবেশ, নতুন আবহাওয়ায় অনেকেই মানিয়ে নিতে না পেরে ব্যর্থ হন নিজেকে প্রমান করতে- এমন উদাহরণ তো ফুটবলে হাজারো আছে।  

 

ইতিহাসে খুব কম প্লেয়ার'ই আছেন যারা আজীবন খেলে গেছেন একই ক্লাবে। রোমার ফ্রান্সিস্কো টট্টি কিংবা লিভারপুলের জেরার্ডের মতো প্লেয়াররা আজীবন খেলে, ভালোবেসে এক ক্লাবে কাটিয়ে দিয়েছেন পুরো ক্যারিয়ার। এই লিস্টে যোগ হতে পারে আরোও অনেক ফুটবলারের নাম। যোগ 'হতে পারতো' লিও মেসির নামও! বলছিলাম টাকার ঝনঝনানি'তে মূহুর্তেই বদলে যায় পছন্দের ঠিকানা। এ অবস্থার মুখোমুখি বেশ কয়েকবারই হতে হয়েছে মেসিকে। বেশ কয়েক বছর ধরে ট্রান্সফার উইন্ডো আসলেই মেসি'র ক্লাব পরিবর্তনের সংবাদে সয়লাব হতো বিশ্ব মিডিয়া। সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বরাবরই বার্সাতেই থেকে যেতেন মেসি। হাফ ছেড়ে বাঁচতেন বার্সা সমর্থকেরা।

 

বেশিদিন আগের কথা না, একটা সময় তো এমন প্রশ্নও উঠতো, 'মেসিকে কেনার মতো টাকা কোনো ক্লাবের আছে নাকি!' ভক্তদের এমন কৌতুহলোদ্ধীপ্ত প্রশ্ন গভীরতায় গ্রাস করতো। কেননা, সত্যিকার অর্থেই মেসিকে কেনার মতো অবস্থা যেকোনো ক্লাবের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এই অবস্থার পরিবর্তনেও বেশি সময় লাগলো না। যাকে একটা সময় কেনার মতো ক্ষমতা অনেকের ছিল না, সেই মেসি’ই ফ্রি এজেন্ট হয়ে গেলেন একটা সময়! অবশ্য, ধারণা করা হতো মেসি হয়তো ম্যাঞ্চেষ্টার সিটিতে মুভ করবেন, সে আশায় গুড়ে-বালি! খোদ মেসিই বারবার সবাইকে সর্তক করেছেন, বার্সা ছাড়ছেন না তিনি। 

 

২১ বছর। একই ক্লাবে, একই স্টেডিয়ামের আলোয় মেসি কাটিয়ে দিলেন গুনে গুনে পুরো ২১টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে কষ্মিনকালেও কেউ ভাবতে পারে নি মেসি তাদের ছেড়ে চলে যাবেন। মেসি নিজেও হয়তো ভাবেন নি এতো তাড়াতাড়ি তার বার্সা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। এটা যে আধুনিক ফুটবলের যুগ, চোখের পলকেই বদলে যায় ক্লাবের ঠিকানা। মেসির বেলায়ও তাই হলো।

 

২১ বছর আগে খালি হাতে এসেছিলেন এই লাস্যময়ী বার্সালোনা শহরে। ততোদিনে দু’হাত ভরে দিয়েছেন ক্লাব’কে। ফিরেও যাচ্ছেন খালি হাতে। মাঝখানের দুই দশকে কেবল স্মৃতি আর স্মৃতি। 

 

বিদায় বেলায় মেসি জানিয়ে গেলেন তার বেদনার কথা। থাকতে তো তিনি বরাবরই চেয়েছিলেন, এবার আর থাকা হলো না। এক বিদঘুটে সমীকরণে তাকে হেরে যেতে হলো, যে মানুষ’টা হারতে কখনোই পছন্দ করতেন না। শেষ প্রেস কনফারেন্সে কাঁদলেন মেসি, কাঁদালেন সমর্থকদের। এখনো অনেকে মেনে নিতেই পারছেনা তাদের লিটল ম্যাজিশিয়ানের বিদায়। বার্সা শহর আজ অজানা স্তবিরতায় আটকে গেছে কোনো এক মায়ার বেড়াজালে। মেসি’কে শেষ বারের মত দেখতে রাস্তায় হাজার হাজার সমর্থক, ভীড় করছেন তার গাড়িকে ঘিরে। বিদায় জানানোর ভাষা তাদের নেই। তারা যেন লেখার শুরুর এয়ারপোর্টে বুক ফেটে কান্না করতেব থাকা মানুষজন। 

 

 

 

বিদায় বড্ড কষ্টের। মেসির ক্লাব পরিবর্তনের বিদায় দিতে ফুটবল ভক্তদের এমন আকুতি, না জানি অবসর নেয়ার পর কি হবে! বিদায় দিতে কষ্ট হয়, তবু চলে যেতে দিতে হয়। যেখানেই থাকবেন, ভালো থাকবেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।

 

শিরোনামহীন আমার প্রচন্ড প্রিয় একটি ব্যান্ড। আজ তাদের একটি গানের দুইলাইন প্রচন্ড গাইতে ইচ্ছে করছে-

 

এই অবেলায়, তোমারই আকাশে, নিরব আপোষে ভেসে যায়; 

 

সেই ভীষন শীতল ভেজা চোখ কখনো দেখাইনি তোমায়!