• ফুটবল

দ্রগবা যেভাবে যুদ্ধ থামালেন!

পোস্টটি ১৮৭৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

প্রেসিডেন্ট লওরেন্ট গাব্বো তার গম্ভীরতার চূড়ান্ত দেখালেন। ক্যাবিনেট, আমলাতন্ত্র, পার্টি- কিছুই যেন তাকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। দেশের এই দূর্দিন আসবে সেটা তার কল্পনারও বাইরে ছিলো। বিস্তৃত কালো মেঘে ঢেকে গেছে পুরো দেশ। প্রেসিডেন্ট গাব্বো দিনদিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন বিদ্রোহী'দের কাছে। 

 

দক্ষিণে গাব্বো সাহেবের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার বিপরীতে উত্তরে আপামর বিদ্রোহীদের নেতা 'গুইলামো সরো' আছেন বেজায় খুশ মেজাজে। সরোর নেতৃত্বে 'নিউ ফোর্সেস অব আইভরিকোষ্ট' দিন দুপুরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনানিতে। দেশের অধিকাংশ ভূমি-ই তাদের দখলে। আবিদজান কব্জা করতে পারলেই নিরঙ্কুশ বিজয়, গুইলামো সরো অন্তত তাই মনে করেন। তবে সেটি সম্ভব হচ্ছে না প্রেসিডেন্ট গাব্বো'র ক্ষমতায় ঠিকে থাকার লড়াইয়ে। 

 

সবচেয়ে বিপাকে আছে দেশের সাধারণ জনগণ। না আছে খাদ্যের নিশ্চয়তা, না আছে জীবনের নিরাপত্তা। বিদ্রোহীদের সাথে সরকারী বাহিনীর লড়াইয়ে তারা যেন নিরব শ্রোতা ও দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। আড়াই কোটি জনসংখ্যার দেশে গৃহযুদ্ধ'টা হিংস্রতার দিকে যাচ্ছিলো দিনকে দিন! 

 

অথচ সেসময়ের আইভরিকোষ্ট'কে আলাদা করে চেনার প্রয়োজন ছিল না কারো। এইসব গৃহযুদ্ধ, দাঙ্গাহাঙ্গামা কতোই তো লেগে আছে বিশ্বে। তবে আলাদা করে চেনার যা ছিল, তা এই দেশের ফুটবল তারকা'রা। বলা হয়ে থাকে ফুটবলে এটাই আইভরিকোষ্টের 'গোল্ডেন জেনারেশন'। এর আগে এতো তারকা কখনো খেলেন নি জাতীয় দলে। 'দিদিয়ের দ্রগবা, এনামুয়েল ইবোয়ো, কলো তোরে, দিদিয়ের ঝকোরা, ইয়া ইয়া তোরে-' এদের সবাই তখন ইউরোপে ১ম সারির ফুটবল খেলছেন। গোল্ডেন জেনারেশন তো বটেই! 

 

কখনোও বিশ্বকাপ না খেলা আইভরিকোষ্টের সামনে তখন বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। ২০০৫ সাল। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সমীকরণ খুব সহজ। ক্যামেরুন- মিশরের ম্যাচে ক্যামেরুনের চাই জয়। সুদান- আইভরিকোষ্টের ম্যাচে জিততেই হবে 'দ্যা এলিফ্যান্ট'দের। এমন অস্থির সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে সুদানের আল- মেরিখ স্টেডিয়াম। আল- মেরিখ যদিও বিশ্বের নামকরা কোনো মাঠ না, তবু 'রেড ক্যাসেল' হিসেবে তার পরিচিতি পুরো সুদানে। 

 

৩-০ তে ম্যাচ জিততে থাকা আইভরিকোষ্টের সাথে ঠিক পাল্লা দিয়ে উঠতে পারলো না সুদান। শেষ মূহুর্তে গোল দিলো ঠিকই, তবে তা কেবলই শান্তনা। রেড ক্যাসেলের এই বিজয়ের পরও আইভরিকোষ্ট নিশ্চিত না বিশ্বকাপ খেলতে পারবে কিনা! ১৬০০ মাইল দূরের ইউয়ান্দে'তে তখন ভিন্ন এক গল্প লিখছে ক্যামেরুনীয়'রা। মাত্র ২০ ম্যাচের মিনিটেই চালকের আসনে তারা। তবে তা ধরে রাখতে পারলোনা, মোহাম্মদ শাওকির অনবদ্য এক গোল ৭৯ মিনিটে স্তব্ধ করে দিলো ক্যামেরুন শিবির! এদিকে প্রত্যেকটা সেকেন্ড অস্থিরতায় কাটছে আইভরিকোষ্ট প্লেয়ারদের। তারা তখনো ড্রেসিংরুমে। সবাই জড়ো হয়ে রেডিও'তে শুনছেন ধারাভাষ্য। আর প্রত্যেকটা মূহুর্ত কাটাচ্ছেন শঙ্কায়। 

 

ভাগ্যটা ক্যামেরুনের পক্ষে না বিপক্ষে ছিল তা বলা মুশকিল। অতিরিক্ত সময় শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পূর্বে ডি-বক্সে ফাউল করে বসেন মিশরীয় ডিফেন্ডার। পেনাল্টি পায় ক্যামেরুন! দপ করে যেন নিভে গেলো আইভরিকোষ্টের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন! কিন্তু না, স্বপ্ন যে বাস্তবতা'কে হার মানায় তা আরেকবার সত্যি হয়ে দেখা দিলো। পেনাল্টি মিস করে বসলেন পিয়েরে উম! হতাশায় জার্সি খুলে মুখ ঢেকে কান্না করে দিলেন তার সতীর্থরা। ১৬০০ মাইল দূরে আইভরিকোষ্ট শিবিরে তখন আনন্দের বন্যা! কি অসম্ভব সুন্দর হতে পারে ফুটবল। এক দলের হারে অন্য দলের বিজয় খুব অপ্রতুল, তাও যদি হয় বিশ্বকাপ মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ করার! 

 

সেদিন, সেসময়ে দিদিয়ের দ্রগবা সমস্ত আলোটুকু কেড়ে নিলেন নিজের দিকে। বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয়ারর আনন্দ ভাগাভাগি করতে দারুণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন মূহুর্তেই। ডেকে আনলেন মিডিয়া। সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার। সমবেত সবার সামনে হ্যান্ড মাইক হাতে তুলে নিলেন দ্রগবা। তারপর যা বললেন, তাতে থেমে গেলো পুরো একটা যুদ্ধরূপ অবস্থা! 

 

লেখার শুরুতে বলেছিলাম আইভরিয়ানদের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট লওরেন্ট গাব্বো বেশ চিন্তিত আছেন বিদ্রোহীদের নিয়ে। আরোও বলেছিলাম গুইলিয়াম সরো বেজায় খুশ মেজাজে আছেন দেশের অর্ধাংশ দখল করে নিতে পেরে। তখন প্রচন্ড রকমের সংকটে দিন কাটাচ্ছিলো আইভরিয়ানরা। দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে ২০০২ সাল থেকে। রক্ত, লাশের স্তুপ- এখন এসব তাদের খুব স্বাভাবিক লাগে। সবকিছু একটা স্থবিরতায় থমকে গিয়েছে। ২০০২ সাল থেকে চলমান সে গৃহযুক্ত ২-৪ কথায় থামিয়ে দিলেন একজন দিদিয়ের দ্রগবা, 'দ্রগবাজুকা' নামে সবাই যাকে আদর করে ডাকে। 

 

অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় দ্রগবা বলতে শুরু করলেন, 'নারী কিংবা পুরুষ, উত্তর কি দক্ষিন, পূর্ব কি পশ্চিম; সব আজ এক হয়েছে। এবং এটাই প্রমাণ করেছে একাগ্রতা ও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদেরকে বিশ্বকাপের জন্য মনোনীত করেছে। আমরা একসাথে বিশ্বকাপ খেলবো। একবার থেমে দ্রগবা দুইভাগে বিভক্ত হওয়া দেশের দুই প্রধান নেতার উদ্দেশ্যে আরোও বললেন-  'আমরা কথা দিয়েছিলাম আমাদের জয়োল্লাস সবাইকে একত্রিত করবে। আমি হাতজোড় করি, আপনারা দয়া করে আগ্নেয়াস্ত্র নামিয়ে রাখুন। আফ্রিকার একটি দেশ যাতে প্রচুর সম্পদ আছে, তারা যুদ্ধে নামবে না। দয়া করে আপনাদের অস্ত্র রাখুন এবং নির্বাচনের আয়োজন করুন। আমরা অনন্দ করতে চাই, দয়া করে গোলাগুলি বন্ধ করুন।'

 

মিনিটখানেক সময়ের এই বক্তৃতা তাকে জাতীয় ভাবে খ্যাতি এনে তো দিলোই, বিশ্বব্যাপি ফলাও করে প্রচার করলো এই সংবাদ। আইভরিকোষ্টে সেদিন পুরো দিন-রাত টিভিতে কেবল চলতে থাকলো এই ভিডিও। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কোনো চাপ ছাড়াই আলোচনায় বসতে রাজী হয়ে গেলেন বিদ্রোহী নেতা ও প্রেসিডেন্ট! সমঝোতা স্মারকে সই করতে করতে এক গাল হেসে নিলেন একই রক্তের দুই পৃথিবীর দুই ভিন্ন মানুষ! ফুটবল কেবল হাসাতে আর কাঁদাতে জানে না, ফুটবল প্রশান্তি বয়ে দিতে যুদ্ধ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে জানে। 

 

তবে যুদ্ধটা এখানেই থেমে গেলো না। 

 

২০০৬ বিশ্বকাপে দুই জয় নিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিলো আইভরি কোষ্ট। সার্বিয়া- মন্টেনেগ্রোকে হারাতে পেরেই আনন্দিত এলিফেন্ট'রা। সে বছর বর্ষসেরা আফ্রিকান ফুটবলারের তকমা'টা নিজের করে নিলেন দ্রগবা। 

 

এদিকে বছর যেতেই আবারো সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে উঠলো সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী দল। আবারো অস্থিরতা বিরাজ করলো পুরো আভরিকোষ্টে। আবারো শঙ্কার ছায়া নেমে এলো জনজীবনে। এবারও শান্তির দূত হিসেবে আবির্ভাব হলো দিদিয়ের দ্রগবার। চমৎকার এক প্রস্তাব রাখলেন টেবিলে। ব্যাপারটা মনে ধরলো দুই প্রধান নেতার। 

 

এবার একটি ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের ঘোষণা দিলেন দ্রগবা, যা রাজধানী আবিদজানে নয় বরং বিদ্রোহীদের শহর বাউকে'তে অনুষ্টিত হবে। কঠিন সিদ্ধান্ত, তবু প্রেসিডেন্ট গাব্বো এটাকে সমর্থন জানালেন। মাদাগাস্কারের সাথে ম্যাচ খেলতে বাউকে'তে যখন পৌঁছাচ্ছিলেন দ্রগবা'রা, তাদের সামনে পিছনে সারি সারি সেনাবাহিনী! পুরো মাঠ পাহারা দিলো দুই পরাশক্তি বাহিনী। মাঠে বসে খেলা দেখলেন দুই প্রধান নেতা। দেখলেন পুরো জাতি কিভাবে এক হয়েছে ৯০ মিনিটের জন্য! ৫-০ গোলের জয়ের ম্যাচে শেষ গোল'টা দ্রগবা'ই করলেন। খেলা শেষের বাঁশি বাজতেই আনন্দে আত্মহারা আইভরিয়ানরা নেমে পড়লো মাঠে। সেনাবাহিনী ব্যস্ত হয়ে পড়লো দ্রগবাদের নিরাপত্তায়। তবে তিনি বরং হাত নেড়ে অভিবাদন জানালেন সমবেত সাধারণ জনগণকে। এ যেন পুরো আইভরিয়ান জাতি সব দ্বিধাদ্বন্ধ ভুলে চলে এসেছে ফুটবলের মুগ্ধতা উপভোগ করতে। সেদিন চিরতরের জন্যই বন্ধ হয়ে গেলো গৃহযুদ্ধ!

 

images (8)

 

ক্ষমতার অপব্যবহার আর রাজনৈতিক বহু সমালোচনার মুখে ২০১১ সালে আটক হন প্রেসিডেন্ট গাব্বো। ততোদিনে দ্রগবা কেবল একজন তারকা'ই না, এরচেয়ে বেশি কিছু বলে গেছেন আইভরিকোষ্টে। রাস্তায় রাস্তায় তার পোস্টার, দেয়াল চিত্রে ভেসে গেছে। এই দেশের মানুষ তাকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসে। বলছিলাম, কিভাবে যুদ্ধ বন্ধ করে দিলেন দিদিয়ের দ্রগবা!