স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন : দ্য বস অব ওল্ড ট্রাফোর্ড
পোস্টটি ১৪১১ বার পঠিত হয়েছেদ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন, দ্য গডফাদার, দ্য ইনসেপশন প্রভৃতি সিনেমা আমরা পর্দায় দেখি, আর এসব সিনেমার প্লট, ধারাবাহিকতা, নাটকীয়তা, শিল্পীদের নান্দনিক কাজ দেখে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই। নিজেদের অজান্তে আপনমনেই হঠাৎ বলে উঠি, "চমৎকার!"
কিন্তু পর্দায় আমরা যাদের দেখি, তাদের পেছনেও একজন থাকেন, যিনি এই চমৎকার শিল্পের পেছনের মাস্টারমাইন্ড। তিনিই এর স্রষ্টা। তার হাতেই তিলে তিলে গড়ে ওঠে এইসব শিল্প। তিনি হলেন সিনেমার ডিরেক্টর, যিনি থাকেন পর্দার আড়ালে।
ফুটবল মাঠে কোচ বা ম্যানেজার হলেন সেই "ডিরেক্টর"। একটি দল যখন ফুটবল মাঠে খেলতে নামে, তাদের কাজ হলো নব্বই মিনিট ধরে লড়াই করে প্রতিপক্ষের নিকট থেকে জয় ছিনিয়ে নেওয়া। এ জয়ের কৃতিত্ব অবশ্যই সেসব ফুটবলারদের, যারা দেড় ঘন্টা ধরে মাঠে লড়াই করে। তবে ডাগআউটে যিনি দাঁড়িয়ে থাকেন, সেই কোচের কৃতিত্বও কোনো অংশে কম নয়। বরং মাঠের একজন ফুটবলারের চেয়ে তার ভূমিকাই অনেক সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
ফুটবলে কোচের ভূমিকা অপরিহার্য ও অপরিসীম। ফুটবলের সূচনালগ্ন হতে আজ অবধি অসংখ্য কোচ দায়িত্ব পালন করে গেছেন ও এখনও করছেন। তাদের মধ্যে অল্প কিছু কোচ আছেন, যিনি শৈল্পিক দক্ষতা ও সাফল্যে নিজেকে নিয়ে গেছেন আকাশচুম্বী উচ্চতায়। ফুটবল ইতিহাসে তাদের নাম লেখা হয়েছে স্বর্ণালি হরফে। এমনই একটি নাম "স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন"। তর্কসাপেক্ষে যাকে বলা হয় ফুটবল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম কোচ।
ফুটবলে তার আগমন ঘটেছিলো ফুটবলার হিসেবেই। ১৬ বছর বয়সে স্কটল্যান্ডের প্রাচীনতম ও অখ্যাত ক্লাব কুইন্স পার্কের জার্সিতে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা শুরু করেন ফার্গুসন। সেখানে তিন বছরে ৩১ ম্যাচে করেন ২০ গোল। অতঃপর সেখান থেকে পাড়ি জমান সেইন্ট জনস্টোনে। এখানে নিয়মিত গোল করলেও একাদশে জায়গা মিলছিলোনা। হঠাৎ একদিন স্কটিশ জায়ান্ট রেঞ্জার্সের বিপক্ষে হ্যাট্রিক করেন ফার্গি। সেই সাথে নজর কাড়েন বেশ কিছু ক্লাবের। সেই ম্যাচের পর তিনি যোগ দেন ডানফার্মলাইন অ্যাথলেটিক ক্লাবে। এই ক্লাবের মাধ্যমেই তিনি পেশাদার ফুটবলে আত্মপ্রকাশ করেন।
ডানফার্মলাইন তখন স্কটিশ লিগে বেশ ভালো অবস্থানে ছিলো। সেবার লিগ শিরোপাও প্রায় জয় করেই ফেলেছিলো, কিন্তু মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য শেষমেশ হাতছাড়া হয়ে যায়। স্কটিশ কাপ ফাইনালে সেল্টিকের কাছে তারা হারে ৩-২ গোলে। তবে সেবার ফার্গির পারফর্মেন্স ছিলো নজরকাড়া। ৩১ গোল করে বনে যান লিগের টপ স্কোরার। তাতে মুগ্ধ হয়ে রেকর্ড ৬৫ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে তাকে সাইন করায় ইতিহাসের সফলতম স্কটিশ ক্লাব রেঞ্জার্স।
রেঞ্জার্সে তিনি দুই সিজন কাটান। তাদের হয়ে ৪১ ম্যাচ খেলে গোল করেন ২৫ টি। তবে সেখানে তার সময় একদমই ভালো যাচ্ছিলোনা। স্কটিশ কাপের ফাইনালে হারের জন্য তাকে দায়ী করা হয়। সেখান থেকে ১৯৬৯ সালে যান ফালকার্কে। সেখানে চার বছর কাটানোর পর এয়ার ইউনাইটেডে কাটান এক বছর এবং ১৯৭৪ সালে এখানেই খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার সমাপ্ত করেন।
অতঃপর সেবছরই কোচিং ক্যারিয়ারে পদার্পণ করেন। শুরুটা হয় অখ্যাত ক্লাব ইস্ট স্টার্লিংশায়ারের মাধ্যমে। ৩২ বছর বয়সের তাদের কোচিং এর দায়িত্ব কাঁধে নেন ফার্গুসন। সেখানে অবশ্য বেশিদিন থাকতে হয়নি। সেবছর অক্টোবরেই তিনি যোগ দেন একই লিগের আরেক দল সেইন্ট মিরেনে। সেখানে চার বছর কোচের দায়িত্ব পালন করেন ফার্গি। এর মধ্যে ১৯৭৭ সালে তারা প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়। তারপর বেশ কিছু ছোটখাটো কারণ দেখিয়ে ১৯৭৮ সালে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
এরপর তিনি দায়িত্ব নেন স্কটিশ জায়ান্ট আবির্দিনের। সেখানে প্রথম সিজনে লিগে চতুর্থ হয়ে শেষ করার পর দ্বিতীয় সিজনে লিগ কাপে রানার্সআপ হয় আবির্দিন। এর পরের মৌসুমে সবাইকে তাক লাগিয়ে সেল্টিক-রেঞ্জার্সের ১৫ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে স্কটিশ লিগ জিতে নেয় ফার্গির আবির্দিন। লিগ জেতার পর তিনি বলেন, "এটি এমন এক এচিভমেন্ট যা আমাদের একতাবদ্ধ করেছে। অবশেষে খেলোয়াড়রা আমার প্রতি আস্থাশীল হয়েছে।"
পরের মৌসুমে বিভিন্ন ক্লাবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আবির্দিনেই থেকে যান ফার্গি। কারণ তখনও যে অনেক চমক দেখানো বাকি। সেবার কাপ উইনার্স কাপে বায়ার্ন, টটেনহ্যাম কে হারানোর পর ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ কে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে আবির্দিন। পরবর্তীতে ইউরোপিয়ান সুপার কাপ ও স্কটিশ লিগ কাপও ঘরে তোলে তারা।
এর পরের সিজন আবির্দিনে তার ভালো কাটেনি। লিগে চতুর্থ হয় তার দল। ব্যর্থতার দায় নিয়ে দায়িত্বে ইস্তফা দেন ফার্গি। এরপর কিছুদিন স্কটল্যান্ড জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু স্কটিশরা বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পেরোতে ব্যর্থ হওয়ায় সেখানেও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।
অবশেষে আসে ১৯৮৬ সাল। ফার্গুসনের জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অবস্থা তখন টালমাটাল। লিগের ২২ টি দলের মধ্যে ২১ নাম্বারে ধুঁকছে রেড ডেভিলরা। রন অ্যাটকিনসন দায়িত্বে অব্যাহতি দিয়েছেন। ঠিক সেই সময় ইউনাটেডের নতুন কোচ হিসেবে ঘোষণা করা হলো ফার্গুসনের নাম।
ইউনাইটেড তখন ছিলো সমস্যায় জর্জরিত। একে তো দল চলে গেছে রেলিগেশন জোনে, ওদিকে দলের অন্যতম কিছু খেলোয়াড় ছিলো হতাশাগ্রস্ত ও মাদকাসক্ত। ওল্ড ট্রাফোর্ডে এসেই তাদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন ফার্গি। আস্তে আস্তে দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। সেবার লিগ শেষ করেন ১১ নম্বরে থেকে।
দ্বিতীয় সিজনে চমক দেখিয়ে রানার্সআপ হয়ে লিগ শেষ করে ইউনাইটেড। কিন্তু পরের সিজনে আবার লিগ শেষ করতে হয় ১১ নম্বরে থেকে। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমও বাজেভাবে শেষ হয়। কোনোরকমে এফএ কাপ জিতে সে যাত্রায় চাকুরী বাঁচান ফার্গি।
১৯৯২-৯৩ মৌসুমে ফ্রেঞ্চ ফরওয়ার্ড এরিক ক্যান্টোনা কে দলে ভেড়ায় ইউনাইটেড। সেবার ২৬ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ফিরে আসে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। এরপর তার হাত ধরে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে চারটি লিগ জয়ের কীর্তি গড়ে রেড ডেভিলরা।
১৯৯৮-৯৯ ছিলো তার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠতম মৌসুম। সেবার প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের মাধ্যমে ট্রেবল জিতে নেয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তার এ সাফল্যে ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথ তাকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করে। তার নামের সাথে যুক্ত হয় "স্যার" উপাধি। তখন থেকেই তাকে ডাকা হয় "স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন" নামে।
১৯৯৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত টানা লিগ জয়ের মাধ্যমে হ্যাট্রিক লিগ শিরোপা জয়ের রেকর্ড গড়ে ইউনাইটেড। কিন্তু ২০০২ সালে দলে নেমে আসে বড় ধস। দলের সিনিয়র খেলোয়াড়রা অবসর নেওয়া ও ক্লাব ছাড়া শুরু করে। ফলে দল পুনর্গঠনে হাত দেন ফার্গি। ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পুরো দল আস্তে আস্তে ঢেলে সাজান তিনি। এ সময়ে তিনি ইউনাইটেডে নিয়ে আসেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, রুড ফন নিস্টলরয়, রিও ফার্ডিনান্ড, ওয়েইন রুনি, নেমানিয়া ভিদিচ, এডউইন ফন ডার সার, মাইকেল ক্যারিক, প্যাট্রিস এভ্রাদের মতো তরুণ প্রতিভাবানদের। অবশেষে এই তরুণদের নিয়ে ২০০৬-০৭ মৌসুমে জিতে নেন নবম লিগ শিরোপা।
২০০৮ সালে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ইউনাইটেডের হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বাদ পান। ২০০৮-০৯ মৌসুমে লিগ জয়ের মাধ্যমে দ্বিতীবারের মতো হ্যাট্রিক লিগ শিরোপা জয়ের গৌরব অর্জন করেন, যা এখন পর্যন্ত একবারই করে দেখাতে পারেনি আর কেউ। সেবার শিরোপা জয়ের মাধ্যমে লিভারপুলের ১৮ টি লিগ জয়ের রেকর্ডে ভাগ বসায় ইউনাইটেড।
সিজন শেষে ফার্গুসন বলেছিলেন আরেকবার লিগ শিরোপা জিততে চান তিনি। কারণ আরেকটি লিগ জয় করলেই লিভারপুল কে পেছনে ফেলে ইউনাইটেড হয়ে যাবে প্রিমিয়ার লিগের সর্বাধিক শিরোপাধারী দল। এক মৌসুম বাদে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়। ২০০৯-১০ মৌসুমে স্যার ম্যাট বাসবি কে পেছনে ফেলে ইউনাইটেডের সবচেয়ে দীর্ঘদিন সার্ভিস দেওয়া ম্যানেজার হন ফার্গি। অবশেষে ২০১২-১৩ মৌসুমে ইউনাটেডের বিংশ ও নিজের ত্রয়োদশ লিগ টাইটেল জয় করে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি।
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ছিলেন ফুটবলের এক মহান শিক্ষক। তিনি খেলোয়াড়দের তার ছাত্রদের মতোই স্নেহ করতেন, শাসন করতেন। তিনি ছিলেন ফুটবল নামক শিল্পের এক মহান কারিগর। ঠিক যেন এক বিখ্যাত সিনেমার মহান ডিরেক্টর। ফুটবল নামক শিল্পটাকে তিনি বুকে ধারণ করেছিলেন। ফুটবলও তাকে নিয়েছিলো আপন করে। আর ফলস্বরূপ সব সাফল্য এসে ধরা দিয়েছিলো তার কাছে।
২৬ বছর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডাগআউটে কাটিয়েছেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। চৌদ্দশোরও বেশিবার দাঁড়িয়েছেন সেখানে। আর সেখানে দাঁড়িয়ে চুইংগাম চিবানোকে পরিণত করেছিলেন তাঁর ট্রেডমার্কে। দলের ট্রফি কেসে এনে দিয়েছেন ৩৮ টি ট্রফি। সব মিলিয়ে পুরো কোচিং ক্যারিয়ারে তিনি জয় করেন ৪৯ টি ট্রফি। তার আন্ডারে ১৩ বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় ইউনাইটেড, পাঁচবার রানার্সআপ, তিনবার তৃতীয়। ইংলিশ ফুটবলে তিনিই একমাত্র ম্যানেজার, যার দল টানা ২০ মৌসুম শীর্ষ তিনে থেকে লিগ শেষ করেছে। কোচ হিসেবে তেরবার জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, ইতিহাসে অন্য কোন কোচ যার অর্ধেকও জিততে পারেনি।
ফুটবলে অনেক কিছুর সাথে চিরতরে জড়িয়ে গেছে তাঁর নাম। বিখ্যাত হয়ে আছে তাঁর হেয়ারড্রাইয়ার ট্রিটমেন্ট। ইঞ্জুরি টাইমে জয়সূচক গোল করে অসংখ্যবার তাঁর দল ম্যাচ জেতায় ওই টাইমটার নাম হয়ে গেছে ফার্গি টাইম। তাঁর নামে ওল্ড ট্রাফোর্ডে একটি স্ট্যান্ডের নামকরণ করা হয়েছে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন স্ট্যান্ড। তিনিই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একমাত্র ম্যানেজার, যার জীবদ্দশাতেই তার নামে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে।
তার সাফল্যের মূলে ছিলো বেশ কিছু বিষয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো তার দূরদর্শিতা। তিনি ছিলেন খাঁটি জহুরি। বড় বড় খেলোয়াড়ের পেছনে টাকা ব্যয় না করে তিনি তরুণ প্রতিভাবানদের দিকে সবসময় বেশী মনোযোগ দিতেন। তাই তার হাত ধরেই তৈরি হয়েছিলো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো অসংখ্য তারকা ফুটবলার।
বিশ্বফুটবলে ফার্গুসন অধিষ্ঠিত হয়েছেন শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ কোচ, একজন মহান শিক্ষক, এক প্রতিভাবান শিল্পী, এক দূরদর্শী জহুরি এবং সর্বোপরি একজন আদর্শ মানুষ। বিশ্ব ফুটবলে তার নাম অমলিন হয়ে থাকবে চিরকাল।
- 0 মন্তব্য