• ফুটবল

ম্যারাডোনাঃ ফুটবলের বিদ্রোহী কবি

পোস্টটি ১৩৫০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

“আমি দুর্বার,

আমি ভেঙে করি সব চুরমার!

আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!

আমি মানি না কো কোনো আইন,

আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!

আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর

আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর!”

আজ থেকে অনেক বছর আগে, বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই যুগান্তকারী, বিস্ফোরক পংক্তিমালা মুখে বা হাতে-কলমে না হলেও বল পায়ে সবুজ গালিচায় বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন ফুটবলের বিদ্রোহী কবি, ডিয়েগো ম্যারাডোনা। একবার নয়, বারবার। সূর্যসম কিংবদন্তি পেলের বন্দনায় যখন ফুটবলবিশ্ব মগ্ন, তখনই ক্ষণস্থায়ী কোনো কালবৈশাখী ঝড়ের মত নতুনের কেতন উড়িয়ে এসেছিলেন কোঁকড়া, রেশমি চুলের অধিকারী এই ‘পেলুসা’, ঘোর আঁধারে বিদ্যুতের মত চমকিয়েছিলেন, সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন নাটকীয়তা আর বিপ্লবে ভরা এক অমর, বর্ণময় মহাকাব্য।

১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের প্রান্তসীমার ফাইওরিটা নামের এক দরিদ্র শহরতলীতে জন্মানো ম্যারাডোনা ছিলেন জনমদুঃখী। বাড়িতে মাত্র তিনটি ঘর ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে ছোট ঘরটাই ছিল ম্যারাডোনা আর তাঁর অন্য সাত ভাই-বোনের জন্য বরাদ্দ। যে শৈশব আনন্দে, হেসেখেলে কাটানোর কথা, সেই শৈশবেই দূর-দূরান্ত থেকে বিশ লিটার তেলের ক্যানে বাড়িতে বয়ে আনতেন পানি, যে পানিতে সম্পন্ন হত রান্না-খাওয়া-গোসল-ধোয়ামোছার কাজ। বর্ষায় ছাদের ফুটো দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ত পানি, যা থেকে বাঁচতে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করতে হত ম্যারাডোনা ও তাঁর পরিবারকে। দারিদ্র্য আর অভাব-অনটনের নাগপাশ তাঁকে চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেও মুক্ত হতে পারেন নি ফুটবলের মায়া থেকে। তাই তো ছোটবেলায় বাবা-মা খেলতে যেতে না দিলে ততক্ষণ পর্যন্ত পাগলের মত চিৎকার করে কাঁদতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের মন না গলে যায়!

(১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মাত্র ১৬ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে ম্যারাডোনার।) 

সেই কয়লার খনির গভীর থেকেই হীরকখণ্ডের মত উঠে এসেছিলেন ডিয়েগো, শোভা পেয়েছিলেন ফুটবল-দেবীর কণ্ঠহারে, দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন বিশ্বের বিখ্যাত সকল স্টেডিয়ামে। স্বভাবে, চলনে-বলনে, খেলার স্টাইলে খানিকটা বিদ্রোহীই ছিলেন ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানো ফুটবল-মহাকাব্যের এই মহানায়ক। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা সামনে চীনের প্রাচীর তৈরী করে দাঁড়িয়ে থাকলেও কারো কোনো আদেশ বা শাসন না মেনে বুলডোজারের মত তা গুঁড়িয়ে দিয়ে দুর্বার গতিতে ড্রিবলিং করে যেতেন তিনি। কোনো বাধা, কোনো বিপত্তি টিকতে পারত না তাঁর সামনে। নিজের ক্যারিয়ারে খেলা ম্যাচগুলোর মাত্র ৪২% এ গোল করলেও তিনি সবসময়ই সর্বকালের সেরাদের একজন হিসেবেই বিবেচিত হন, নিঃসন্দেহে। কেন? ফুটবল যে শুধুই গোলের খেলা নয়, এ কথা তাঁর আগে কেই-ই বা প্রমাণ করেছে?

ফুটবল-সম্রাট পেলের মত আভিজাত্য, গরিমা হয়তো তাঁর চরিত্রে ছিল না। মাঠ ও মাঠের বাইরে অনেকবারই ছেলেমানুষি কাণ্ড ঘটিয়ে নিন্দুক-সমালোচকদের হাসির পাত্র হয়েছেন। কিন্তু তাঁর ছিল অতুলনীয় তেজ, অদম্য মানসিকতা। মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হাত দিয়ে করা গোলটি সমালোচিত হোক বা বিতর্কিত, এটা তাঁর অন্তরে লুক্কায়িত সেই বিদ্রোহেরই একপ্রকার প্রদর্শন নয় কি? আর পরেরটা? যেটাকে বলা হয় “গোল অব দ্য সেঞ্চুরি?” সেটা তো যেন কাজী নজরুল ইসলামের রচিত “বিদ্রোহী” কবিতার লাইনগুলোরই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ! এই তেজ, এই মানসিকতা তিনি বারবার দেখিয়েছেন সমগ্র বিশ্বকে, ১৯৯০ বিশ্বকাপে ফাইনালে পরাজয়ের পর আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়েও ফিরে এসেছেন, বাছাইপর্বে খাবি খেতে থাকা নিজের দেশকে তুলেছেন ১৯৯৪ বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে। যদিও ডোপ টেস্টে বাদ পড়ে শেষরক্ষা করতে পারেন নি আর্জেন্টিনাকে।

 

শুধু কি সবুজ মাঠের বিদ্রোহীই ছিলেন তিনি? মোটেই নয়, বরং জীবনরূপী ময়দানেও তাঁর বিপ্লবের পরিচয় পাওয়া যায় বারবার। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর তাঁর কথায় ফুটে উঠেছিল সেই নিখাদ দেশপ্রেমেরই উচ্ছ্বাস, “আমার এমন লাগছিল যেন আমি কোনো ফুটবল দলকে নয়, হারিয়ে দিয়েছি গোটা এক দেশকেই!” নিজেকে যুক্ত করেছিলেন অনেক জনহিতকর কর্মসূচিতে, বারবার দাঁড়িয়েছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত-নিষ্পেষিত মানুষের পাশে। ফুটবল দিয়েই মুক্তিকামী মানুষের মনে স্বাধীনতা, স্বাধিকার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনাকে জাগ্রত করতেন এই বিপ্লবী, যেমন স্বরচিত গান-কবিতা দিয়ে করতেন বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

২০২০ সালের নভেম্বরে বিশ্বের সকল ফুটবলানুরাগীকে অশ্রুতে ভাসিয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে জীবন-নদীর ওপারে চলে যান আর্জেন্টিনার এই গণনায়ক। আজ, ৩০ অক্টোবর, ২০২১-ফুটবলের এই বিদ্রোহী কবির ৬১তম জন্মদিন, আর মৃত্যুর পর প্রথম। কিন্তু আদৌ কি মৃত্যু হয়েছে তাঁর? বিপ্লবের কি সত্যিই মৃত্যু আছে? নাকি তিনি মিশে আছেন প্রতিটি আর্জেন্টাইন, প্রতিটি ফুটবলপ্রেমীর অন্তরে?

নাকি ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনাকে কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতানোর নায়ক যারা, তাদের আত্মায়, তাদের সত্ত্বায়?