• ফুটবল

একজন পার্ফেক্ট মিডফিল্ডারের উপাখ্যান

পোস্টটি ১৫২৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফুটবল মাঠে সবকয়টি পজিশনেরই আছে বিশেষ তাৎপর্য। একটি বিশ্বমানের দল গড়তে হলে সব পজিশনকেই সমান ভাবে গুরুত্ব দিতে হয়। হ্যাঁ, লাইমলাইট পাওয়ার ক্ষেত্রে হয়তো বরাবরই দেখা যায় ফরওয়ার্ডরা এগিয়ে থাকে, কারণ তাদের নামের পাশে থাকে অসংখ্য গোল ও এসিস্ট। তাদের তুলনায় অন্যরা, বিশেষভাবে ডিফেন্সিভ মিডরা একটু অন্ধকারেই থেকে যায়। কারণ তারা যেমন ফরওয়ার্ডদের মতো গোল এসিস্ট করেনা, তেমনি গোলকিপার এর মতো দারুণ সেইভ দিয়ে নজর কাড়তেও পারেনা। ফলে পরিসংখ্যান এর খাতায় তারা কখনোই তেমন দীপ্তি ছড়ায় না।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাঠের খেলায় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ভূমিকা অপরিসীম। তারা একটি দলের ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করে। খেলার কন্ট্রোল সবচেয়ে বেশি থাকে ডিফেন্সিভ মিডদের হাতে। ডিএম ছাড়া দল অনেকটা মাঝি বিহীন নৌকার মতো। অসংখ্যবার নিশ্চিত গোলের হাত থেকে দলকে রক্ষা করা থেকে শুরু করে নিখুঁত গোলের সুযোগ তৈরির সূচনা, সবই সৃষ্টি হয় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের পা থেকেই।

বিশ্ব ফুটবল এখন অবধি অসংখ্য কিংবদন্তি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এর দেখা পেয়েছে। ফুটবলের সর্বকালের সেরা ফুটবলারের ছোট তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে অনেকে। তবে সর্বকালের সেরা ডিফেন্সিভ মিড খুঁজতে গেলে বরাবরই একটা নাম অগ্রাধিকার পায়। তার নাম "লোথার ম্যাথিউস"।

১৯৬১ সালের ২১ মার্চ পশ্চিম জার্মানির ব্যাভারিয়ার ছোট শহর এরলানজেনে জন্মগ্রহণ করেন লোথার। তার বাবা হেইঞ্জ ম্যাথিউস জন্মেছিলেন সাবেক সিলেসিয়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জার্মানি চলে আসেন ও ক্যান্টিন ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। লোথারের মা ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পিউমা তে কাজ করতেন।

ছেলের ছোটবেলাতেই ফুটবলের প্রতি আগ্রহ খেয়াল করেন বাবা হেইঞ্জ। তাই শুরুতেই লোথার কে স্থানীয় ক্লাবে ভর্তি করে দেন তিনি। নুরেমবার্গ শহরের কোলে গড়ে ওঠা ছোট্ট ক্লাব হার্জোগেনাউরাখ এর যুব টিমের মাধ্যমে ফুটবলে যাত্রা শুরু করেন লোথার। ১৯৬৯ সালে ১৮ বছর বয়সে জার্মানির অন্যতম সেরা ক্লাব বরুশিয়া মনশেনগ্লাডবাখের জার্সিতে শুরু হয় তার পেশাদারী ক্যারিয়ার। মনশেনগ্লাডবাখ তখন দুর্দান্ত ফর্মে। ৭০ এর দশকে তারা জিতেছিলো পাঁচটি লিগ শিরোপা।

image_search_1635676881748
প্রথম মৌসুমেই দলের নিয়মিত খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন লোথার। লিগের সবকটি ম্যাচই সেবার খেলেছিলেন তিনি। কিন্তু দলের পারফর্মেন্স আশানুরূপ ছিলোনা। সে মৌসুমে লিগ শেষ করতে হয়েছিলো সপ্তম স্থানে থেকে। তবে তৎকালীন ইউয়েফা কাপে (বর্তমান ইউরোপা লিগ) আসে সাফল্য। প্রথম রাউন্ডে নরওয়ের দল ভাইকিংস কে হারানোর পর তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে ৪-৩ গোলে হারিয়ে বিদায় করে ইতালিয়ান জায়ান্ট ইন্টার মিলান কে। এরপর একে একে হারিয়ে দেয় রোমানিয়ার ক্রাইওভা ও ফ্রেঞ্চ জায়ান্ট সেইন্ট এতিয়েন কে, পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে।

সেমিতে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে আসে আরেক জার্মান ক্লাব স্টুটগার্ট। প্রথম লেগে প্রতিপক্ষের মাঠে হেরে বসে বরুশেনরা। ফলে ফাইনালে যাওয়ার জন্য পরের লেগে কঠিন সমীকরণ দাঁড়ায় তাদের সামনে। কিন্তু কথায় আছে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে। নিজের জাত চেনানোর জন্য এই রাত টা কেই বেছে নেন লোথার ম্যাথিউস। পুরো ম্যাচে দলের রক্ষণভাগের দুর্দান্ত প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সাথে ম্যান মার্কিং এ পুরো নাজেহাল করে দেন প্রতিপক্ষের কি ম্যান হ্যান্সি মুলার কে। অবশেষে ২-০ গোলের অসাধারণ জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে দল, ম্যাথিউসরা পৌঁছে যান ফাইনালে।

তখনকার ইউয়েফা কাপ ফাইনাল ছিলো দুই লেগে। এইন্ট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টের বিপক্ষে অল জার্মান ফাইনালের প্রথম লেগে ছিলো বরুশিয়ানদের ঘরের মাঠে। শক্তির বিচারে দুই দলই তখন সমানে সমান। খেলাও হচ্ছিলো উত্তেজনাপূর্ণ। শুরুতেই গোল করে এগিয়ে যায় ফ্রাঙ্কফুর্ট। তবে সমতায় ফিরতে দেরি করেনি বরুশিয়া। কিন্তু ৭০ মিনিটে আবারও এগিয়ে যায় ফ্রাঙ্কফুর্ট। অতঃপর বাঁ পায়ের দারুণ এক শটে বল জালে জড়িয়ে দলকে সমতায় ফেরান লোথার ম্যাথিউস। এরপর ক্রিশ্চিয়ান কুলিকের গোলে ৩-২ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বরুশিয়া মনশেনগ্লাডবাখ।

দ্বিতীয় লেগেও দুই দলই মাঠে নেমেছিলো সমান সম্ভাবনা নিয়ে। আগের লেগ জেতায় মনশেনগ্লাডবাখের শিরোপা জয়ের জন্য ড্র হলেই চলতো। ফ্রাঙ্কফুর্টের দরকার ছিলো জয়। সেদিন পুরো ম্যাচে আগুনঝরা পারফর্ম করেন লোথার ম্যাথিউস। গতিময় ড্রিবলিং, দুর্ধর্ষ ট্যাকলিং, অসাধারণ পাসিং...এক কথায় সেদিন একা হাতে দলকে সামলাচ্ছিলেন লোথার। কিন্তু দূর্ভাগ্য, ম্যাচের ১০ মিনিট বাকি থাকতে গোল খেয়ে বসে বরুশিয়ানরা। সেই সাথে এগ্রিগেটে সমতার পর অ্যাওয়ে গোলে এগিয়ে থাকায় সেদিন ট্রফি ঘরে তোলে এইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট। ম্যাথিউসদের ফিরে আসতে হয় খালি হাতে।

শিরোপা জিততে না পারলেও তার দুর্ধর্ষ পারফর্মেন্স সেদিন নজর কেড়েছিল সবার। আর সেই সুবাদে ১৯৮০ সালের ইউরোতে জার্মান জাতীয় দলে ডাক পান লোথার ম্যাথিউস।

image_search_1635681053001
জাতীয় দলের হয়ে শুরুটা একদিক দিয়ে দারুণ ছিলো। তার অভিষেক টুর্নামেন্টেই ইউরোপ সেরার শিরোপা ঘরে তোলে পশ্চিম জার্মানি। কিন্তু এতে তার অবদান সামান্যই বলা চলে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এক ম্যাচে শুধু কয়েক মিনিটের জন্য সাব হিসেবে নেমেছিলো লোথার। পুরা টুর্নামেন্টে তার খেলা ওইটুকুই।

এদিকে মনশেনগ্লাডবাখের ফর্ম দিন দিন ড্রপ করতে শুরু করে। তাদের হয়ে মোট চার মৌসুম খেলেছিলেন লোথার, এই সময়ে মিস করেছিলেন শুধু দুটি ম্যাচ। বরুশেনদের হয়ে ১৬২ টি ম্যাচ খেলে ৩৬ টি গোল পান লোথার ম্যাথিউস।

এরপর ঘনিয়ে আসে জার্মানির হয়ে তার অভিষেক বিশ্বকাপ। ১৯৮২ সালের সেই টুর্নামেন্ট পশ্চিম জার্মানি শুরু করেছিলো ফেভারিট তকমা নিয়েই। পল ব্রেটনার, হ্যান্সি মুলার, কার্ল হেইঞ্জ রুমিনিগেদের নিয়ে গড়া দলটি ছিলো আগাগোড়া তারকায় ঠাসা। তবে এবারও দলের জন্য তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি লোথার। পুরো টুর্নামেন্টে একটা ম্যাচে শুধু পুরো সময় খেলেছিলেন, আর সাবস্টিটিউট হিসেবে নেমেছিলেন একটায়। সেবার ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। এরপর ১৯৮৪ সালের ইউরোতেও টাইম পাননি তেমন, জার্মানি দলও ছিলো ছন্নছাড়া। পর্তুগাল ও স্পেনের কাছে হেরে সেবার বিদায় নিতে হয় গ্রুপ পর্ব থেকেই।

১৯৮৪ সাল টা তার ক্যারিয়ারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পুরো মৌসুম অসাধারণ খেলেও গোল ব্যবধানে পিছিয়ে থাকায় বুন্দেসলিগা হাতছাড়া হয় বরুশিয়া মনশেনগ্লাডবাখের। এরপর আসে পোকাল কাপের ফাইনাল, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ছিলো বায়ার্ন মিউনিখ। ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে হঠাৎ লোথার ঘোষণা দেন এই মৌসুম শেষে বায়ার্ন যাচ্ছেন তিনি। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে দলের সেরা খেলোয়াড় ঘোষণা দিলেন সিজন শেষে তিনি নাম লেখাবেন সেদিনের প্রতিপক্ষ দলে, স্বাভাবিকভাবেই এ ঘোষণার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে দলের সবার মনোবলের ওপর। নির্ধারিত সময় সমতায় শেষ হওয়ার পর খেলা পেনাল্টি শুট আউটে গড়ালে প্রথম শট নিতে আসেন লোথার ও মিস করে বসেন। অবশেষে ৮-৭ ব্যবধানে জিতে সেবার পোকাল কাপ নিজেদের করে নেয় বায়ার্ন। এখনও অসংখ্য বরুশিয়া ফ্যান বিশ্বাস করেন, লোথার ম্যাথিউসের সেই পেনাল্টি মিস ছিলো ইচ্ছাকৃত।

বায়ার্নের হয়ে তার যাত্রার সূচনা টা দারুণ ভাবেই হয়েছিলো। পুরো বায়ার্ন মিডফিল্ডের কন্ট্রোলার ছিলেন লোথার। পুরো দলে তার মতো কার্যকরী খেলোয়াড় ছিলোনা আর কেউ। প্রথম তিন ম্যাচে ব্যাভারিয়ানদের হয়ে ১১৩ ম্যাচ খেলে করেন ৫৭ গোল। পোকাল কাপও জিতেছিলেন তাদের হয়ে। তবে ইউরোপিয়ান সাফল্য তেমন ধরা দিচ্ছিলো না। ফলে বায়ার্ন মিউনিখ বেশ সমালোচনার মুখেও পড়েছিলো।

১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে ইউরোপিয়ান কাপে শুরু থেকেই দারুণ পারফর্ম করতে থাকেন লোথার ম্যাথিউস। মাঠের শুরুর লাইন থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত কন্ট্রোল করতে থাকেন তিনি। তার একক কন্ট্রোলে দারুণ গঠনমূলক খেলতে থাকে দল। তার অনবদ্য পারফর্মেন্সে ভর করে ভিয়েনা ও আন্ডারলেখট কে উড়িয়ে দিয়ে সেমি ফাইনালে পৌঁছে যায় বায়ার্ন।

সেমি তে তারা মুখোমুখি হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের। সেই ম্যাচ যেন ছিলো একদম "লোথার ম্যাথিউস শো"। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনবরত চোখধাঁধানো পারফর্ম করেছিলেন লোথার। যেন একা হাতে কন্ট্রোল করেছিলেন পুরো ৯০ মিনিট। দুইবার পেনাল্টি পেয়ে দুইবারই স্পট কিক থেকে গোল করেন লোথার। সে ম্যাচে ৪-১ গোলের অসাধারণ এক জয় তুলে নেয় ব্যাভারিয়ানরা। এরপর মাদ্রিদে এসে ১-০ গোলে হারলেও ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের।

image_search_1635676954068
ফাইনালে "তুলনামূলক সহজ" প্রতিপক্ষ পোর্তোর মুখোমুখি হয় বায়ার্ন। মাদ্রিদ কে উড়িয়ে দেওয়া বায়ার্ন কে সবাই ম্যাচের আগেই চ্যাম্পিয়ন ধরে নিয়েছিলো। বায়ার্ন খেলছিলোও ফেভারিট এর মতোই। ৮০ মিনিট পর্যন্ত তারা এগিয়ে ছিলো ১-০ গোলে। এরপর হঠাৎ যেন ঘটে গেল এক অদ্ভুত নাটক। শেষ দশ মিনিটে "ফেভারিট" বায়ার্নের জালে পরপর দুটি গোল করে বসে পোর্তো। শিরোপা ঘরে তোলে পোর্তো, সেই সাথে লোথার ম্যাথিউসের আরো একটি স্বপ্নভঙ্গ।

বায়ার্নের হয়ে এই স্বপ্নভঙ্গের একবছর আগে আরও একটি স্বপ্নভঙ্গের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তাকে। সেটা ছিলো ১৯৮৬  সালের বিশ্বকাপ। দলের গৌণ সদস্য হিসেবে আগের তিনটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলার পর এবারই প্রথম দলের অন্যতম প্রধান সদস্য হিসেবে যাত্রা শুরু করেন লোথার। টুর্নামেন্ট জুড়ে অনবদ্য পারফর্মেন্স এর পাশাপাশি মরক্কোর বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে করা গোল ও মেক্সিকোর বিপক্ষে শেষ মূহুর্তের সমতাসূচক গোলের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিলো রূপকথার গল্প লেখা ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। ফুটবল জাদুকর কে থামানোর দায়িত্ব টা স্বাভাবিক ভাবেই লোথারের কাঁধে পড়ে। কিন্তু সেবারের ম্যারাডোনাকে থামাবে, কার সাধ্য? তারপরও তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। ৮৬ মিনিটে ম্যারাডোনার পাস থেকে বুচারাগা গোল করেন, ৩-২ ব্যবধানে শিরোপা জিতে নেয় আর্জেন্টিনা। লোথারের আরও এক স্বপ্নভঙ্গ।

দুইবছর পরের ইউরোতে আবারও লিখতে হলো ট্র‍্যাজেডি। এবার অবশ্য ফাইনালে না, সেমি ফাইনালে। শুরুতে লোথারের পেনাল্টি গোলে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এগিয়ে যায় জার্মানি। কিন্তু ম্যাচের শেষদিকে রোনাল্ড কোম্যানের পেনাল্টি ও মার্কো ফন বাস্তেনের ট্যাপ ইন গোলে আবারও ফিরে আসতে হয় ট্রফি জয়ের দোরগোড়া থেকে।

নিজের সবটা উজাড় করে দেওয়ার পরও বারংবার স্বপ্নভঙ্গ, আর কত মেনে নেওয়া যায়? মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অবশেষে এর থেকে উত্তোরণের জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ক্লাব ছাড়ার। যেতে চাইলেন জার্মানি থেকে বাইরে।

অবশেষে চারবছর মিউনিখে কাটিয়ে ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে তিনি পাড়ি জমান ইতালিতে। নতুন চ্যালেঞ্জের নেশায় যোগ দেন ইন্টার মিলানে।

image_search_1635677096888
ইন্টার মিলানে যোগ দেওয়া তার জীবনে শ্রেষ্ঠতম টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। কাছে এসেও বারবার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো যেসব শিরোপা, সেসব যেন এবার তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। প্রথম মৌসুমেই জয় করেন স্কুদেত্তো। তাছাড়া ইতালিয়ান লিগ তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা। সেখানে নিজের উন্নতি করতে থাকেন লোথার, নিজেকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। সেখানে চার মৌসুমে ১১৫ ম্যাচে চার গোল করে আবারও ফিরে আসেন প্রিয় মিউনিখে।

এর মধ্যে এসে পড়ে ১৯৯০ বিশ্বকাপ। দলের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে লোথার ম্যাথিউস কে মনোনীত করা হয়। তার নেতৃত্বে পৃথিবী এবার যেন দেখা পায় ভয়ডরহীন এক অন্য জার্মানির। একদম সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। প্রথম ম্যাচে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। দল জয় পায় ৪-১ গোলে। এরপর নকআউটে তাঁরা মুখোমুখি হন দুবছর আগে ইউরোর সেমি ফাইনাল থেকে তাদের বিদায় করে দেওয়া নেদারল্যান্ডসের। তাদের ২-১ গোলে হারিয়ে আগেরবারের হারের শোধ তোলে জার্মানি।

কোয়ার্টার ফাইনালে চেকোস্লোভাকিয়া কে হারায় জার্মানি। পেনাল্টি থেকে গোল করেন লোথার। সেমিফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। এই ম্যাচ টি ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা ম্যাচ হয়ে আছে। আক্রমণ প্রতি আক্রমণ চলতে থাকে পুরো ম্যাচ জুড়ে। সেই সাথে ছিলো লোথার ম্যাথিউসের জীবনের অন্যতম সেরা পারফর্মেন্স। পৃথিবী বাসি দেখতে পায় আরও একটি "লোথার ম্যাথিউস শো"। নির্ধারিত সময় ১-১ ব্যবধানে শেষ হওয়ার পর পেনাল্টি শুটআউটে জিতে ফাইনালে পৌঁছে যায় জার্মানি।

ফাইনালে আবারও প্রতিপক্ষ হয়ে আসে চার বছর আগের সেই চেনা আর্জেন্টিনা। তবে ম্যাচটি তেমন দর্শনীয় হয়নি। পুরো ম্যাচ জুড়ে চলতে থাকে মারাত্মক সব ট্যাকল, ফাউল, ধস্তাধস্তি। দুজন খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখে। অবশেষে আন্দ্রেস ব্রাহিমির গোলে শিরোপা জয় করে জার্মানি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এর আসনে অধিষ্ঠিত হয় লোথার ম্যাথিউসের জার্মানি।

image_search_1635676715009
এত্তসব অবদানের ব্যক্তিগত স্বীকৃতি অবশেষে পেয়েছিলেন লোথার ম্যাথিউস। জ্যঁ পিয়েরে পাপিন, মার্কো ফন বাস্তেন, আন্দ্রেস ব্রাহিমিদের মতো তারকাদের পেছনে ফেলে ১৯৯০ সালের ব্যালন ডি অর জিতে নেন লোথার। এরপর ১৯৯১ সালে জয় করেন ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড। সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ হয় তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার।

অসংখ্য অর্জন ও রেকর্ডের খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছেন লোথার ম্যাথিউস। এখন অবধি একমাত্র জার্মান হিসেবে তিনি জিতেছেন ফিফা প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার। ১৯৯৮ সালে নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ খেলার রেকর্ড গড়েন লোথার। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি (২৫ টি) ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তার দখলে। দুইবার নির্বাচিত হয়েছেন জার্মান প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার। জার্মান জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (১৫০ টি) খেলার রেকর্ডও তার।

লোথার ম্যাথিউস সম্পর্কে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, "ম্যাথিউস আমার কঠিনতম রাইভাল"। তাকে বলা হত "পার্ফেক্ট মিডফিল্ডার"। দলের প্রয়োজনে মিডফিল্ডের যেকোনো জায়গায় খেলেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে, সাবলীলভাবে। সবজায়গা তেই হয়ে উঠেছেন বেস্ট। প্রাইমারি পজিশন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড হলেও তিনি একাই ছিলেন পুরো মিডফিল্ড। একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো মাঠ। পুরো মাঠের খেলার নিয়ন্ত্রক হিসেবে তিনি ফুটবল ইতিহাসেই একদম অনন্য একটি জায়গা করে নিয়েছেন, যা প্রায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

শুধু কীর্তি বা সাফল্যই নয়, তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার হার না মানা মানসিকতার জন্যও। অসংখ্যবার হৃদয় ভেঙেছে তার, ফিরে আসতে হয়েছে শিরোপার একদম কাছে থেকে। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি। লেগে থেকেছেন, চেষ্টা করে গেছেন বারবার। অবশেষে ধরা দিয়েছে সাফল্য।

image_search_1635677296903
তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন কখনো হাল না ছাড়ার, কঠোর অধ্যাবসায়ের। তার শিক্ষা, তার অর্জন, তার ব্যক্তিত্ব ও সর্বোপরি তার কীর্তি... ফুটবল বিশ্বে তাকে অম্লান করে রাখবে চিরকাল।