কেমন ছিলো বার্সেলোনার ডাগআউটে জাভির প্রথম ম্যাচ?
পোস্টটি ৮৭২ বার পঠিত হয়েছে
অবশেষে বার্সেলোনার ডাগআউটে কোচ হিসেবে জাভির অভিষেক ঘটে গেলো।
এই সিজনের শুরুতে মেসির বিদায়ের পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো, বার্সেলোনার জন্য এই সিজনটা অনেক কঠিন হতে যাচ্ছে। ট্রান্সফার উইন্ডোর ডেডলাইন ডেতে গ্রিজম্যানকে ছেড়ে দেওয়াতে বার্সেলোনার স্টার সাডেড ফরোয়ার্ডলাইন আচমকা একেবারেই দৈন্যদশা অতিক্রম করতে শুরু করেছে।
এমন এক সময়ে লিগ ম্যাচে কাতালান ডার্বিতে নগর প্রতিদ্বন্দী এস্পানিওলের বিপক্ষে বার্সেলোনার ডাগআউটে অভিষেক ঘটে গেল জাভির। তার প্রথম ম্যাচে বার্সেলোনা খুব বেশি ভালো খেলেছে তা বলা যাবেনা, কিন্তু তারপরও এস্পানিওলের বিপক্ষের ১-০ গোলের জয়টা বার্সেলোনার জন্য বেশ আকাঙ্খিত। আজ আমরা এস্পানিওলের ম্যাচে বার্সেলোনার ট্যাক্টিক্সের খুটিনাটি নিয়ে আলোচনা করবো এবং খেলার পজিটিভ দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো যেগুলো কোম্যানের সময় অনুপস্থিত ছিলো।
বার্সেলোনা ম্যাচের শুরুতে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলতে নেমেছিল যেটা অন দ্যা বলে ৪-১-৪-১ ফর্মেশনে পরিবর্তিত হচ্ছিলো। গোলবারের নিচে ছিলো টের স্টেগান। দুই সেন্টারব্যাক ছিলো পিকে এবং গার্সিয়া। ফুলব্যাক রোলে ছিলো মিঙ্গুয়েজা এবং জর্দি আলবা, তবে মিঙ্গুয়েজাকে খুব একটা ওভারল্যাপ করতে দেখা যায়নি, প্রায়সময়ই সে পিকে-গার্সিয়ার সাথে থ্রি ম্যান ব্যাকলাইন ক্রিয়েট করছিলো। সিঙ্গেল পিভট রোল প্লে করছিলো বুসকেটস, তার সামনে দুই ইনসাইড মিডফিল্ডার রোলে ছিলো নিকো এবং ডি ইয়ং। দুই উইং এ ছিলো গাবি এবং ইলিয়াস, তাদের মূল কাজ ছিলো টাচলাইন এরিয়ায় পজিশন নিয়ে এস্পানিওলের ডিফেন্সলাইনকে স্ট্রেচ করা। দলে ফরোয়ার্ড পজিশনে ছিলো ডিপাই, তার রোল অপনেন্টের ডিফেন্সলাইন হোল্ড করে রাখা হলেও ক্রমাগত লাইন থেকে নিচে ড্রপ করে ডি ইয়ং এবং নিকোকে বক্সে রান নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছিলো।
বার্সেলোনা ইন পজেশন :
এস্পানিওলের ফরোয়ার্ড প্লেয়াররা তেমন প্রেসিং না করায় বার্সেলোনার ব্যাক থেকে বিল্ডআপ করতে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি। বিল্ডআপের সময় মিঙ্গুয়েজা হাইলাইনে উঠার পরিবর্তে হাফস্পেসে সড়ে এসে পিকে-গার্সিয়ার সাথে থ্রি ম্যান ব্যাকলাইন তৈরী করে, তবে আলবা তখন যথারীতি ওয়াইড এরিয়ার হাইলাইনে নিজেকে পুশ করে। তখন বুসকেটস সেন্টার লাইন থেকে কিছুটা নিচে এসে ব্যাক থ্রির সাথে ডায়মন্ড তৈরী করে। যেকারণে ব্যাক থেকে বল সার্কুলেশনে কোন বাধার মুখে পড়তে হয়নি।
বার্সেলোনা কাগজে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলতে নামলেও অনফিল্ড ফর্মেশন ছিল ৪-১-৪-১। ডি ইয়ং এবং নিকো অপনেন্ট হাফের ওয়াইড এরিয়ায় পজিশন নেয় ইনসাইড মিডফিল্ডারের মতো। ফাইনাল থার্ডে এস্পানিওলের ব্যাক ফোরের সাথে ৪ ভি ৫ সিচুয়েশন ক্রিয়েট হচ্ছিলো ম্যাচের শুরুর দিকে, একারণে ডেভিড লোপেজ দুই সেন্টারব্যাকের মাঝে ড্রপ করে।
দুই উইঙ্গার গাবি এবং ইলিয়াস ফাইনাল থার্ডের টাচলাইন এরিয়ায় পজিশন হোল্ড করে এস্পানিওলের ডিফেন্সলাইনকে স্ট্রেচ করার চেষ্টা করছিলো। গাবি এবং ইলিয়াস দুজনই রং ফুটেড হলেও তাদেরকে সরাসরি খুব একটা কাটইন করতে দেখা যায়নি।
ফ্রাঙ্কি এবং নিকো দুজনই এস্পানিওলের মিডফিল্ড এবং ডিফেন্সলাইনের মধ্যকার ফ্রি পজিশনে পজিশন নিয়ে থাকতো। যেকারণে বুসকেটস কিংবা দুই সেন্টারব্যাকের পাস খুব সহজেই এস্পানিওলের মিড ব্লককে সারপাস করে ফ্রাঙ্কি এবং নিকোর কাছে পৌছে যেতো, তারা জোন ১৪ র ফ্রি স্পেসে বল রিসিভ করে টার্ন করার মতো এনাফ স্পেস পেয়েছে।
এক্ষেত্রে মিডফিল্ডে বল পায়ে থাকা অবস্থায় ডিপাই তার লাইন থেকে কিছুটা নিচে ড্রপ করে তার মার্কারকে নিজের দিকে ড্রাগ করে নিয়ে আসতো। ফলে এস্পানিওলের ব্যাকলাইনে ফ্রি স্পেস ক্রিয়েট হতো, সেই ফ্রি স্পেসে দুই ইনসাইড মিডফিল্ডার ডি ইয়ং এবং নিকো কন্টিনিউয়াস বিহাইন্ড দ্যা ডিফেন্স রান মেইক করছিলো যাতে করে গোলস্কোরিং চান্স ক্রিয়েট হচ্ছিলো। কিন্তু বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের বক্সের ভেতরে পোর কম্বিনেশনের কারণে ভালো চান্স ক্রিয়েট করেও বারবার গোল করতে ব্যর্থ হয়েছে।
পুরো ম্যাচজুড়ে বার্সার লেফ্ট সাইডের কম্বিনেশনাল প্লে ছিলো চোখে পড়ার মতো। গাবি টিপিকাল লেফ্ট উইঙ্গার না হওয়ায় লেফ্ট ফ্লাঙ্কে পজিশন হোল্ড করার পরিবর্তে প্রায়ই হাফস্পেসে চলে আসছিলো। এসময় আলবা টাচলাইনে পজিশন নিয়ে লাইন স্ট্রেচ করছিলো। আলবা-গাবি-ফ্রাঙ্কির কুইক পাসিং এবং পজিশন ইন্টারচেঞ্জের ফলে এস্পানিওলের রাইটব্যাক আলেক্স ভিদাল এবং উইঙ্গার এম্বাবা ম্যান মার্কিংয়ে বারবারই ভূল করে বসছিলো। নিচের ছবিটার দিকে খেয়াল করা যাক।
উপরের ছবিতে শুরুতে আলবা হাফলাইনে বল পজিশন হোল্ড করে ছিলো, তখন গাবির পজিশন ছিলো টাচলাইন এরিয়ায় এবং ফ্রাঙ্কি ছিলো লেফ্ট হাফস্পেসে। এসময় এম্বাবা ফ্রাঙ্কিকে ম্যান মার্ক করে রাখলেও ভিদাল গাবিকে মার্ক না করে নিজের পজিশন হোল্ড করে ছিল, যেকারণে লেফ্ট সাইড দিয়ে স্পেস ক্রিয়েট করা যাচ্ছিলো না। তখন আলবার পাস গাবি রিসিভ করলে ভিদাল তার পজিশন ছেড়ে গাবিকে মার্ক করতে উপরে চলে আসে৷ ফলে লেফ্ট সাইডে ফ্রি স্পেস ক্রিয়েট হয় এবং ফ্রাঙ্কি সেই ফ্রি স্পেস দিয়ে ডায়াগনাল রান নেয়।
উপরের উদাহরণে আলবা ফাইনাল থার্ডের টাচলাইন এরিয়ায় পজিশন নিয়ে ছিলো। গাবি কিছুটা নিচে হাফস্পেস এরিয়া থেকে গার্সিয়াকে ব্যাকপাস দিয়ে হাফস্পেস ধরে ফরোয়ার্ড রান নেয় এবং এম্বাবা তাকে মার্ক করে নিচে ড্রপ করে। এসময় ফ্রাঙ্কি বক্সের বাইরে হাফস্পেস এরিয়ায় পজিশন নিয়ে ছিলো। গার্সিয়ার ফরোয়ার্ড পাস বুসকেটস রিসিভ করে কুইক টাচে লেফ্ট হাফস্পেসের ফ্রি এরিয়ায় থ্রু বল দেয়। এসময় ফ্রাঙ্কি এবং গাবির মুভমেন্ট এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিলো চোখে পড়ার মতো। ফ্রাঙ্কি তার লাইন থেকে কিছুটা নিচে ড্রপ করাতে তার মার্কার সার্জি গোমেজ তাকে ট্র্যাক করে উপরে মুভ করে। একই সময়ে সেই স্পেসে গাবি মুভ করে বুসকেটসের পাস রিসিভ করে। গোমেজ কিছুটা ফরোয়ার্ড মুভ করায় এস্পানিওলের ডিফেন্সলাইন ডিসঅর্গানাইজড হয়ে পড়ে৷ তখন গাবির থ্রুতে ডিপাই বিহাইন্ড দ্যা ডিফেন্স রান নেয় এবং সেখান থেকেই পেনাল্টির মাধ্যমে বার্সেলোনা তাদের উইনিং গোলটি পেতে সক্ষম হয়।
বার্সেলোনার লেফ্ট সাইড দিয়ে আক্রমণগুলো চোখে পড়ার মতো হলেও রাইট সাইড ছিলো একেবারেই নিষ্প্রভ। পুরো ম্যাচে লেফ্ট সাইড দিয়ে যেখানে ৫১% এটাক হয়েছে সেখানে রাইট সাইড দিয়ে এটাক হয়েছে মাত্র ২১%।
রাইট সাইডে পুরোটা সময়ই ইলিয়াসের কনফিডেন্টের অভাব রয়েছে মনে হয়েছে। পুরো ম্যাচেই মিঙ্গুয়েজাকে খুব একটা ওভারল্যাপ করতে দেখা যায়নি। যেকারণে রাইট ফ্লাঙ্কে বারবারই ইলিয়াস ১ ভি ১ বা ১ ভি ২ সিচুয়েশনে পড়ছিলো। ইলিয়াসের সাক্সেসফুল ড্রিবল এটেম্পট ছিলো ০, একইসাথে রং ফুটেড হওয়ায় তার ক্রসগুলোও ছিলো উদ্দেশ্যহীন।
যাইহোক, সেকেন্ড হাফে আব্দের ইনক্লুশনের পর রাইট সাইডও অনেকটা এক্টিভ হয়ে যায়। বার্সার বেশিরভাগ এটাকগুলোই লেফ্ট সাইড দিয়ে হওয়ায় রাইট সাইডে হিউজ ফ্রি স্পেস পাওয়া গিয়েছে সব সময়ই। ইলিয়াস ড্রিবল করে ফ্রি স্পেসের সুবিধা কাজে লাগাতে না পারলেও আব্দে রাইট উইং দিয়ে এস্পানিওলের ডিফেন্সলাইনে ভয় ধরিয়েছে ক্রমাগতই। সেকেন্ড হাফের ৪৫ মিনিট খেলেই আব্দের ড্রিবলিং এটেম্পট ছিলো ৮ টি যার ৬ টিই ছিলো সাক্সেসফুল।
আব্দে নামার পর শুরুতে এস্পানিওলের লেফ্টব্যাক পেদ্রোসা তাকে টাইট মার্কিং না করে ফ্রি স্পেস দিচ্ছিলো৷ কিন্তু আব্দের ক্রমাগত ড্রিবলিং এটেম্পটের কারণে পরে পেদ্রোসা তাকে টাইট মার্ক করতে শুরু করে। যেকারণে আব্দে ফরোয়ার্ড লাইন থেকে কিছুটা নিচে ড্রপ করলেই বিহাইন্ড দ্যা ডিফেন্স হিউজ ফ্রি স্পেস ক্রিয়েট হয়ে যাচ্ছিলো৷ উপরের ছবিতে মিডফিল্ড থেকে বুসকেটসের লং থ্রু বলে আব্দে বিহাইন্ড দঢা ডিফেন্স রান নেওয়াতে এস্পানিওলের ডিফেন্সলাইন একেবারেই এক্সপোজড হয়ে পড়ে। ফাইনালি আব্দের লো ক্রস থেকে একটুর জন্য বার্সেলোনা গোল বঞ্চিত হয়।
বার্সেলোনা আউট অব পজেশন :
আউট অব পজেশনে থাকা অবস্থায় বার্সার খেলোয়াররা এস্পানিওলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে ম্যান টু ম্যান মার্ক করে, ফলে ব্লাইন্ড লং বল খেলা ছাড়া তাদের হাতে অপশনই থাকতো না।
যখন এস্পানিওল ব্যাক থেকে বিল্ডআপ করতো তখন বার্সেলোনার ৪-৩-৩ ফর্মেশন ৩-৫-২ এ পরিবর্তিত হতো। এসময় গাবি এস্পানিওলের রাইট সেন্টারব্যাক গোমেজকে মার্ক করতো এবং ডিপাই রাইটে মুভ করে কাব্রেরাকে মার্ক করতো। নিকো এস্পানিওলের সিঙ্গেল পিভট লোপেজকে মার্ক করতো এবং তার দুইপাশে দুই উইংব্যাকে মার্ক করতো যথাক্রমে ইলিয়াস ও আলবা। ফ্রাঙ্কি নিচে ড্রপ করে বুসকেটসের সাথে মিলে এস্পানিওলের অপর দুই মিডফিল্ডারকে ম্যান মার্ক করতো।
বার্সেলোনার খেলোয়ারদের নিজেদের হাফে খুব বেশি এগ্রেসিভ প্রেসিং করতে দেখা যায়নি৷ কিন্তু অপনেন্ট হাফে পজেশন লস করার সাথে সাথেই বল হোল্ডারের সম্ভাব্য সকল পাসিং অপশন ব্লক করে তার এরিয়া কনজাস্টেড করে প্রেস করে বল রিট্রিভ করার চেষ্টা করতো।
বার্সার প্রেসিং সিস্টেমে ট্রায়েঙ্গুলার প্যাটার্নও দেখা গেছে কিছু ক্ষেত্রে। এসময় অপনেন্ট থার্ডে বল ক্যারিয়ারের চারপাশে বার্সেলোনার ৩ জন খেলোয়ার সরাসরি প্রেসিংয়ে অংশ নিয়েছে। এক্ষেত্রে দুইজন সরাসরি বল ক্যারিয়ারকে প্রেস করেছে এবং তার পাসিং অপশন ব্লক করে দিয়েছে। অপরজন সরাসরি প্রেসিংয়ে অংশ না নিয়ে সেকেন্ড বল উইন করার চেষ্টা করেছে।
বার্সেলোনার প্রত্যেক প্লেয়ার এস্পানিওলের স্পেসিফিক প্লেয়ারকে ম্যান মার্ক করেছে এবং অফ দ্যা বলে কখনো কখনো আউট অব পজিশনে গিয়েও নিজের মার্ক করা ম্যানকে প্রেস করতে দেখা গেছে। উপরের ছবিতে মিঙ্গুয়েজা তার মার্কার ডি থমাসকে প্রেস করে নিজের পজিশন ছেড়ে ফাইনাল থার্ডে উঠে এসেছে। তখন নিকো নিচে ড্রপ করে মিঙ্গুয়েজার ফেলে আসা ফ্রি স্পেস কভার করেছে।
- 0 মন্তব্য