• অন্যান্য

নয় দশকের নার্ভাস মুশফিক

পোস্টটি ৬৭৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০০৯ সালের জিম্বাবুয়ে সিরিজ। তামিমের ১৫৪ রানের সুবাদে গত ম্যাচে সিরিজ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের সামনে টার্গেট ২১০ রান। কি বুঝে সেদিন হুট করে মুশফিককে ওপেনিংয়ে পাঠায় টিম ম্যানেজমেন্ট। মুশফিকও ব্যাট হাতে শুরু থেকেই আস্থার প্রতিদান দিচ্ছিলেন। ৪৭ রানে প্রথম উইকেট পড়া তামিম ইকবাল করেছিলেন মাত্র ৪ রান। বাকি ৪৩ রান আসে মুশি এবং মিস্টার এক্সট্রার কল্যাণে। সবাই যখন সেট হয়েও আউট হয়ে যাচ্ছিলেন, মুশফিক এক প্রান্ত আগলে রেখে সিঙ্গেল, ডাবলস নিয়ে এগোচ্ছিলেন নিজের স্বপ্নের পথে। নব্বইয়ের কক্ষে মুশফিকুর রহিম। প্রথমবারের মতো নব্বই টপকানো। মুশিকে একেবারে নার্ভাস লাগেনি তা নয়। বরং আরও সাবধানী ব্যাটিং শুরু করলেন। জিততে ৩৩ বলে করতে হবে মাত্র ১১ রান। তাই আহামরি চাপও ছিলো না। ভীতগ্রস্থ চেহারার মাঝেও ছিলো স্বপ্ন ছোঁয়ার ঝলক। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুশফিক একটু পরেই প্রাণ খুলে হাসবেন। ভুবন মাতানো হাসি। যে হাসিতে মুক্তা ঝরবে। স্বপ্ন জয়ের গল্প রচিত হবে। শতক ছুঁতে মুশফিকের আর মাত্র দুটো রান বাকি। বোলিংয়ে অভিজ্ঞ রেইমন্ড উইলিয়াম প্রাইস। আগের দুটি বল শর্ট ফাইন লেগ এবং কাভারে ঠেলে দিয়ে কোন রান পাননি মুশি। ডট দেওয়া দুটো বলে স্বাভাবিক মনে হয়েছে এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানকে। প্রাইসের ওভারের চতুর্থ বল, আউট সাউড অফ স্টাম্পে অনেকটা ঝুলিয়ে ছেড়েছেন। ব্যাটসম্যানকে মারতে প্রলুব্ধ করছেন। মুশফিকও সুযোগ নিতে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। ডাউন দ্যা ট্র্যাকে এসে বোলারের মাথার উপর দিয়ে বল উড়িয়ে মারার চেষ্টা। বাঁহাতি প্রাইস ভালোই টার্ণ পেয়েছেন। টার্নে বিট হলেন মুশফিক। বল সরাসরি উইকেট রক্ষকের হাতে। বদলি কিপার চার্লস কভেন্ট্রি মুহুর্তের মধ্যেই উইকেট ভেঙে দিলেন। ভেঙে দিলেন স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলা মুশফিকের শৈল্পিক যাত্রা। ৯৮ রানে সেদিন আউট হয়ে মুশফিক যেন মাঠই ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। নিজের ভুলে সাফল্যের ভ্রুণকে সমাধি দেওয়ার অপরাধে সেখানেই পড়ে থাকতে চাইছেন। আবেগী মুশিকে সান্ত্বনা দিতে সেদিন বাউন্ডারি লাইনে এসেছিলেন তামিম ইকবাল খান। ছলছল চোখে তীব্র অপরাধবোধে মাথা নিচু করে মাঠ ছেড়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। টং দোকানে বসে খেলা দেখতে থাকা ক্রীড়াপ্রেমী চাচাও সেদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'ইশশ, ছোট্ট ছেলেটার একশো হলেও পারতো।'

FB_IMG_1638035321560

মুশফিকের নার্ভাস নাইন্টিনে আউট হওয়া নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে নব্বইয়ের ঘরে সবচেয়ে বেশি থেমে যাওয়া ব্যাটসম্যানটাই মুশফিকুর রহিম। ইনিংস সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। গুণে গুণে আটটি। সাদা বলে ৪টি, লাল বলেও ৪টি। লাল বলের শেষ ইনিংসটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, চলমান সিরিজে। সাদা বলেও পাকিস্তানের সাথে নাভার্স নাইন্টিনে আউট হওয়ার ঘটনা রয়েছে। সেটা আরও বেশি আক্ষেপের। ১ রানের আক্ষেপ। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে ৯৯ রানে আউট হয়েছিলেন মুশফিক। শুরুতে দ্রুত উইকেট হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশ মুশফিক এবং মিথুনের ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে ভালো সংগ্রহ দাঁড় করায়। মিথুন ব্যক্তিগত ৬০ রানে আউট হয়ে গেলেও মুশফিক দাঁড়িয়ে ছিলেন অন্য প্রান্তে। স্ট্রাইক রোটেশন আর বাজে বলকে বাউন্ডারি ছাড়া করে মুশফিক পৌঁছেছিলেন ৯৯ রানে। একচল্লিশতম ওভারে এঙ্গেল ক্রিয়েট করে বল করছিলেন শাহীন শাহ আফ্রিদি। ওভারের দ্বিতীয় বলটাকে অনেকটা খোঁচার মতো করে বাউন্ডারি ছাড়া করেন মুশফিক। পুরো ম্যাচে ওটাই বাজে শট। তৃতীয় বলটা যেন পেশাদার ইয়ার্কার। অবশ্য মুশফিক পেশাদার ব্যাটসম্যানের মতোই সেটাকে ডিফেন্স করেছেন। বোলাররা এঙ্গেল থেকে বল ছুঁড়ে সাধারণত ভেতরের দিকেই ঢুকাতে চান। আফ্রিদির চতুর্থ বলটা অনেকটা এমনই ছিলো।    গুড লেন্থে পড়া আউট সাইড স্টাম্পের বলটা মুশফিক ড্রাইভ কর‍তে চেয়েছিলেন। কিন্তু লেন্থ বুঝতে না পারায় টেকনিকে গড়বড় হয়ে যায়।  ব্যাটের কানা ছুঁয়ে বল জমা হয় উইকেটরক্ষক সরফরাজের গ্লাভসে। বিপরীত স্ট্রাইকে থাকা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ততক্ষণে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন। এক রানের আক্ষেপ যে মেনে নেওয়া যায় না। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৯৯ রানে আউট হওয়া এটাই প্রথম ঘটনা।

 

মুশফিক ছাড়াও নার্ভাস নাইন্টিনে আছে  সাকিব-তামিমের নাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭ ইনিংসে নব্বইয়ের ঘরে থেমেছেন সাকিব আল হাসান। তামিম থেমেছেন ৬ ইনিংসে। লাল বলে ৪ বার করে থেমেছেন সাকিব-মুশফিক। একই দলের বিপক্ষে সাদা এবং লাল বলের সংস্করণে থামার রেকর্ড আছে মুশফিকের। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ৯৮ রানে আউট হয়ে যাওয়া মুশফিক ২০১৩ সালে একই দলের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে ৯৩ রানে আউট হন। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সাদা পোশাকে ৯২ রানে উইকেট হারানো মুশি ২০১৯ সালে লঙ্কানদের বিপক্ষে রঙিন পোশাকে ৯৮ রানে (অপরাজিত) ইনিংস শেষ করেন। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯৯ রানে কাটা পড়া মিস্টার ডিপেন্ডেবল ২০২১ সালের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপে বাবরদের বিপক্ষে ৯১ রানে সাজঘরে ফিরেন। তাছাড়া টেস্টে একবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে (৯৫) এবং ওয়ানডেতে একবার নিউজিল্যান্ডের সাথে (৯০) শতক ছুঁতে না পারার আক্ষেপে পুড়েছেন। মুশফিকের নব্বইয়ের ঘরে আউট হওয়া ৮ ইনিংসের ৪ ইনিংসই ঘটে ঘরের মাটিতে। চার ইনিংসের তিন ইনিংস আবার চট্টলার জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। রঙিন পোশাকে নয় দশকের কক্ষপথে আউট হওয়া মুশফিকের ৪ ম্যাচের ৩টিতে জিতে বাংলাদেশ দল। তবে সাদা পোশাকে রয়েছে জয়, ড্র এবং হারের মিশ্র স্বাদ। 

 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্বে নব্বইয়ের ঘরে সবচেয়ে বেশি আউট হয়েছেন ক্রিকেটের বরপুত্র শচীন টেন্ডুলকার। কাছাকাছি গিয়েও ২৮বার শচীন শতক ছুঁতে ব্যর্থ হয়েছেন, পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। রোদের আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়েছেন। দিনান্তে শচীনের নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে 'শতকের শতক।' শচীনের সাথে মুশফিকের তুলনা নিতান্তই বোকামি। তবুও দেশ সেরা ব্যাটসম্যান দিনশেষে নিজেকে সাফল্যের শীর্ষে তুলে ধরতে নতুন করে পরিকল্পনা করবেন। ভুল শুধরানোর ছক আঁকবেন। অনুশীলনে পুড়ে নিজেকে অন্যন্য করে তুলবেন। নব্বইকে শতকে রূপ দিতে আরও উদ্যমী হয়ে উঠবেন। নিশ্চয়ই মুশফিক জানেন এবং মানেন, 'পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি।'