অলিম্পিক ডি মার্সেই এর পুনরুত্থান ও টিম অ্যানালাইসিস
পোস্টটি ১১০৬ বার পঠিত হয়েছেদীর্ঘ সময় ধরে চরম খারাপ সময় পার করার পর সম্প্রতি গতিশীল ফুটবল খেলে নজর কেড়েছে ফ্রান্সের ইতিহাসে সফলতম ক্লাব অলিম্পিক ডি মার্সেই। খেলার ট্যাকটিকে আমূল পরিবর্তন, সাথে গত সামারে বেশ কিছু নতুন সাইনিং। গত সিজনে ধুঁকতে থাকা মার্সেই দল যেন একদমই বদলে গেছে।
এই পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় অবদান দুজনের। একজন হলেন ক্লাবটির নতুন প্রেসিডেন্ট পাবলো লংগোরিয়া, যিনি একইসাথে স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করছেন। আর সবচেয়ে বেশি অবদান যার, তিনি হলেন আর্জেন্টাইন মাস্টারমাইন্ড হোর্হে সাম্পাওলি।
২০১০ সালে সর্বশেষ লিগ ওয়ান ঘরে তোলে মার্সেই। তারপরের দুই-তিন বছরও টাইটেলের জন্য বেশ লড়াই করেছে। কিন্তু এর পর থেকেই মার্সেই এর অধঃপতন শুরু। হাতবদল হয় ক্লাবের। আর্থিক চরম ক্রাইসিসে পড়ে দল। একে একে ছেড়ে দিতে হয় দলের সবকটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় কে। এরপরের ক'বছর মার্সেই কাটায় ইতিহাসের কঠিনতম সময়। লিগ টাইটেল তো দূরের কথা, টপ টেনের মধ্যেই জায়গা হতোনা নিয়মিত।
অবশেষে গত ক'বছর ধরে আস্তে আস্তে উন্নতির চেষ্টা করছিলো তারা। চ্যাম্পিয়নস প্রজেক্ট নামে নতুন প্রজেক্ট শুরু করেন ক্লাব মালিক ফ্রাঙ্ক ম্যাককোর্ট। কিন্তু লাভ হয়নি তেমন। দল উন্নতি করলেও সেই উন্নয়নের ধারা স্ট্যাবল ছিলোনা। ২০১৮ সালে ইউরোপা লিগে ফাইনাল খেলেছে, কিন্তু লীগে ভালো করতে পারেনি।
২০১৯-২০ সিজনের শুরুতে নতুন কোচ হয়ে আসেন তরুণ পর্তুগিজ আন্দ্রে ভিয়া বোয়া। তার হাত ধরে দল ক্রমান্বয়ে উন্নতি করতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে লীগে অপরাজিত থাকে মার্সেই। লিগ শেষ করে টেবিলের দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে ও সেই সাথে বহুবছর পর জায়গা মেলে ইউসিএলে। (কোভিডের কারণে সেবার লিগের সবগুলো ম্যাচ হয়নি। পয়েন্ট টেবিলে সবকটি দলের অবস্থান, পরবর্তী ম্যাচসমূহ, ফর্ম সবকিছু বিবেচনা করে চূড়ান্ত লিগ টেবিল নির্ধারণ করা হয়।)
২০২০-২১ মৌসুম একদম বাজেভাবে শুরু করে মার্সেই। লিগের পাশাপাশি ইউসিএলেও পারফর্মেন্স ছিলো একদম জঘন্য। এর পাশাপাশি জানুয়ারির দিকে ক্লাবে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। ক্লাব প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে চরম আন্দোলনে নামে ক্লাবের ফ্যানরা, ভাঙচুর চালায় স্টেডিয়ামে ও আশেপাশে। এর পাশাপাশি একটা সাইনিং কে কেন্দ্র করে কর্তৃপক্ষের সাথে কলহে জড়ায় কোচ ভিয়া বোয়া। অবশেষে পদত্যাগ করেন ভিয়া বোয়া, তার পাশাপাশি বরখাস্ত হন তৎকালীন ক্লাব প্রেসিডেন্ট জ্যাক হেনরি ইউরাদ, যাকে ক্লাব ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ধরা হয়।
ক্লাবের নতুন প্রেসিডেন্ট হয়ে আসেন দলের তৎকালীন স্পোর্টিং ডিরেক্টর পাবলো লংগোরিয়া। আর ভিয়া বোয়ার স্থলাভিষিক্ত হন আর্জেন্টাইন কোচ হোর্হে সাম্পাওলি।
সাম্পাওলি এসেই দলের খেলার ধরণ পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলেন। মার্সেই এর প্রচলিত ৪-৩-৩ এর জায়গায় তিনি ৩-৪-৩ ফর্মেশন ব্যবহার শুরু করেন। ফলে দলের খেলার স্টাইল পুরোপুরি ডিফেন্সিভ থেকে পুরোপুরি অফেন্সিভে পরিবর্তিত হয়।
তবে খুব ভালো করতে পারেননি তিনি। সেটার একমাত্র কারণ তার ফর্মেশন মতো প্লেয়ার ছিলোনা তখন দলে। তাই বারবার বিভিন্ন প্লেয়ার কে বিভিন্ন পজিশনে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বুবাকার কামারা আর পল লিরোলা ছাড়া অন্যান্য প্লেয়াররা প্রায় কেউই ফর্মেশনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি। ফলে কারও থেকেই কন্সিস্টেন্ট পারফর্মেন্স পাওয়া যাচ্ছিলোনা। তারপরও কোনোরকমে পঞ্চম হয়ে লিগ শেষ করেন, দল জায়গা করে নেয় ইউরোপা লিগে।
এরপর গত সামার ট্রান্সফার উইন্ডোতে লংগোরিয়া ও সাম্পাওলি মিলে দলে আনেন আমূল পরিবর্তন। স্কোয়াডের প্রায় অর্ধেক প্লেয়ার ঝেড়ে ফেলা হয়। তাদের জায়গায় অনা হয় নতুন সব ট্যালেন্ট। দলের গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ারদের মধ্যে স্ট্রাইকার দারিও বেনেদেত্তো ও ভালেরে জার্মেইন, রাইট উইঙ্গার ফ্লোরিয়ান থুভা, রাইট ব্যাক হিরোকি সাকাই, লেফট ব্যাক নাগাতোমো, গোলকিপার ইয়োহান পেলে সহ অসংখ্য প্লেয়ার কে বিদায় জানায় মার্সেই।
আর নিয়ে আসে রোমা থেকে গোলকিপার পাউ লোপেজ ও উইঙ্গার চেংগিজ উন্দার, আর্সেনাল থেকে উইলিয়াম সালিবা ও মাত্তেও গেন্দুজি, ব্রাজিলের ফ্ল্যামেঙ্গো থেকে মিডফিল্ডার গেরসন সান্তোস, সান্তোস থেকে সেন্টার ব্যাক লুয়ান পেরেস, শালকে থেকে আমিন হারিত এবং বার্সেলোনা থেকে রাইট উইঙ্গার কনরাড ডি লা ফুয়েন্তে কে। বেশিরভাগ প্লেয়ার কেই আনা হয় লোনে। তবে মার্সেই এর ইতিহাসে অন্যতম দামী সাইনিং হিসেবে আসে গেরসন। লুয়ান পেরেস ও কনরাডও আসে পার্মানেন্ট সাইনিং হিসেবেই।
নতুন মৌসুম নতুনভাবেই শুরু করে মার্সেই। ৩-৪-৩ ফর্মেশনে দলকে খেলানো চালিয়ে যান সাম্পাওলি। এবার নিজের খুশিমতো দলকে খেলাতে পারেন সাম্পা, কারণ এবার তার হাতে যথেষ্ট অপশন আছে।
ভালো পারফর্মেন্স দিয়ে গোলবারের নিচে এ মার্সেই লিজেন্ড ও লং সার্ভিং গোল্কি স্তিভ মান্দান্দার জায়গা দখল করে নেন পাউ লোপেজ। তার সামনে রাইট সিবি ও লেফট সিবি তে কন্টিনিউস দারুণ পারফর্ম করে জায়গা পাকাপোক্ত করে ফেলেন উইলিয়াম সালিবা ও লুয়ান পেরেস। আর মাঝখানে কেউই স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারেনি। সেখানে দুহে ক্যালেটা কার, লিওনার্দো বালের্দি ও আলভারো গঞ্জালেজ কে রোটেশন করে ব্যবহার করতে শুরু করেন সাম্পা।
তবে সালিবা ও সেন্ট্রাল সিবি মূলত ডিফেন্স হিসেবে খেললেও লুয়ান পেরেস বিস্তৃত ভূমিকা পালন করেন। লেফট সাইডে চান্স ক্রিয়েটের প্রধান কারিগর তিনি। ডিফেন্স থেকে এটাক, সবখানেই তিনি অসাধারণ। তার ওভারল্যাপিং রান অতুলনীয়, যার ফলে দলের লেফট উইং ফরওয়ার্ড এখন অবধি দলের অন্যতম দূর্বল পয়েন্ট হলেও দলের বেশিরভাগ এটাক হয় লেফট সাইড থেকে। আর এর প্রধান কারণ লুয়ান পেরেস। তাই অ্যাটাকে গেলে দলের থ্রি ব্যাক ফর্মেশন দাঁড়ায় টু ব্যাক ফর্মেশনে।
তাদের সামনে বেশিরভাগ সময় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে থাকেন ভালেন্তিন রনজিয়ে, বুবাকার কামারা ও মাত্তেও গেন্দুজি। তবে প্রকৃতপক্ষে ডিএম রোলে কেউ থাকেনা। সাম্পার অল আউট এটাক স্টাইলে বায়ার্ন মিউনিখের মতো দলের সবাইকেই এটাকে অংশ নিতে হয়। তাদের তিনজনের সামনে থাকেন দলের টালিসম্যান দিমিত্রি পায়েত। তার ভূমিকা মূলত চান্স ক্রিয়েট, আর এ কাজে তিনি অতুলনীয়।
গেন্দুজি কে ডিফেন্সিভ মিড থেকে এটাকিং মিড পর্যন্ত সব পজিশনেই দেখা যায়। লোথার ম্যাথিউস এর মতো তার দায়িত্ব থাকে পুরো মাঝমাঠ ব্যাপি। আর এখন অবধি তাতে তিনি পুরোপুরি সফল।
দলের ঐতিহাসিক সাইনিং গেরসন কে পায়েতের সঙ্গী হিসেবে খেলানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখন অবধি তিনি দলের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি, তাই আপাতত তাকে ফ্লপ সাইনিং হিসেবেই কাউন্ট করা হয়। সেই সাথে ফিটনেস প্রবলেমও বেশ ভোগায় তাকে। তবে তার যথেষ্ট পটেনশিয়াল আছে। আশা করা যায় খুব দ্রুত তিনি নিজেকে ফিরে পাবেন। আপাতত তিনি মূলত ব্যাকাপ হিসেবে থাকেন, যেখানে তার সঙ্গী ডিএম পাপে গেইয়ে।
দলের রাইট উইং এ দুর্দান্ত পারফর্মেন্স বজায় রেখে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন চেংগিজ উন্দার। তার ব্যাকাপ হিসেবে আছেন পল লিরোলা। আর সেন্টার ফরওয়ার্ডে তো চেনা মুখ, নাপোলি থেকে লোনে আসা পোলিশ স্ট্রাইকার আর্কাদিউস মিলিক। তবে বেশ বড় ধরনের ইঞ্জুরি থেকে ব্যাক করার পর এখন পর্যন্ত নিজের আগের ফর্ম ফিরে পাননি তিনি। আশা করা যায় ছন্দে ফিরবেন দ্রুতই।
তার ব্যাকাপ হিসেবে আছেন মার্সেই এর এই সিজনের চমক বাম্বা দিয়েং। লিগের শুরুতে মিলিকের অনুপস্থিতিতে একদমই তরুণ এ সেনেগালীয় স্ট্রাইকার দুর্দান্ত ভাবে শুরু করে এই সিজন। তবে সেটা ধরে রাখতে পারেননি, এ বয়সে পারার কথাও না। তবে এখনও তিনি ভালোই পারফর্ম করেন। তার প্রচুর পটেনশিয়াল আছে। তার পজিশনিং, ড্রিবলিং ও বল রিসিভিং অসাধারণ। কিন্তু ফিনিশিং এ এখনও প্রচুর সমস্যা আছে, হয়তো আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠবেন।
লেফট উইং বর্তমান মার্সেই এর প্রধান সমস্যা। দলে পিওর লেফট উইঙ্গার আছেন দুজন। লুইস হেনরিক ও কনরাড ডি লা ফুয়েন্তে। কনরাড শুরুর কিছু ম্যাচে দারুণ পারফর্ম করলেও তা ধরে রাখতে পারেননি। আপাতত ফর্মে নেই দুজনের কেউই। তাই লেফট উইং ফরওয়ার্ড সাম্পাওলির বর্তমান মাথাব্যথার প্রধান কারণ। সেখানে কনরাড, লিরোলা, হারিত, বাম্বা দিয়েং, লুইস হেনরিক সবাইকেই খেলানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু কারও কাছে থেকেই আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি।
দলের খেলা পজিশন বেসড ও অল আউট এটাকিং।তবে ফিনিশিং দলের অন্যতম প্রধান সমস্যা। প্রধান ফিনিশার মিলিকের অফ ফর্ম, বাকিদের কেউই ফিনিশিং এ ভালো করতে পারছেন না। ৭০%+ বল পজিশন রেখে, সারা ম্যাচ এটাক করেও ঠিকমতো ফিনিশিং এর অভাবে তারা হেরে বসে অসংখ্য ম্যাচ।
ডিফেন্সিভ স্ট্যাট অবশ্য অসাধারণ। মূলত মার্সেই এত মুহুর্মুহু আক্রমণ চালায় যে প্রতিপক্ষ আক্রমণের সুযোগই পায়না। কিন্তু কাউন্টার এটাক থেকে মাঝে মাঝে গোল কন্সিড করতেই হয়। এটা অবশ্যম্ভাবী।
সর্বোপরি, এই সিজনে মার্সেই এর খেলা বেশ উপভোগ্য। যদি আপনি দেখতে বসেন, আপনার বোরিং লাগবেনা আমি বাজি ধরে বলতে পারি। হাই প্রেসিং ফুটবল সবসময়ই আকর্ষণীয়। সাম্পাওলির দলের অল আউট এটাকিং, ভয়ডরহীন এই প্রেসিং ফুটবল সত্যিকার অর্থেই চোখে লাগার মতো।
- 0 মন্তব্য