তবু তাকে নিয়ে কেন গল্প লিখা হচ্ছেনা?
পোস্টটি ১৪৮৮ বার পঠিত হয়েছেগোলগাল মুখখানি সবসময় থাকে তার হাসিতে উজ্জ্বল। মাঠে কি মাঠের বাইরে- এক চিলতে হাসিতে মুগ্ধ রাখেন সবাইকে। পায়ের জাদু আর সেকি ভেল্কি! মিশরীয়রা তো ভালোবেসে নামই দিয়েছে 'মিশরীয় মেসি!' ফরোয়ার্ডদের জন্য গোল করা চাট্টিখানি কথা বটে, তবে ধারাবাহিকতা একজন ফরোয়ার্ডকে নিয়ে যেতে পারে অনন্য কোনো উচ্চতায় আর পর্যায়ে! আজকের গল্প এক সাদামাটা চরিত্রের অসাধারণ ফুটবলারকে নিয়ে- যাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি দূরে থাক, কোনো সাধারণ গল্প-ই হয় না!
গল্পের শুরুটা হোক কায়রো শহরের এক প্রান্তে থাকা 'এল মকাউলোন' একাডেমির বিশালাকার মাঠ থেকে।
ট্র্যাকশ্যুট আর ক্যাপ পরা এক ভদ্রলোক, নাম তার সাইদ আল শিশিনি; গলায় ঝুলতে থাকা বাঁশিতে বারবার ফুঁক দিচ্ছেন। হাতের ইশারায় সদ্য কৈশোর পেরুনো এক তরুণকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন। সে তরুণ তার ভীষণ পছন্দের। তার দুইটা কারণ। এক তো এই ছেলে ভীষণ পরিশ্রমী, আর দুই- সে তার একাডেমিতে প্রেক্টিস করতে আসে ৫ বার বাস বদলে!
৫ বার বাস বদলে প্রেক্টিস করতে আসা তরুণের নাম মোহাম্মদ সালাহ হামিদ মাহরুস ঘালি। পড়াশোনায় তার মন বসে না বলে খেলাধুলায় সুযোগ খোঁজতে থাকা এই যুবক অবশ্য ফুটবল'টাকে এতোটাও সিরিয়াসলি নেন নি বয়স ১৪ হওয়ার পূর্বে! বাবা ও চাচার দেখাদেখি ফুটবল খেলতেন গ্রামের মাঠে, অলিগলি আর বিস্তীর্ণ সব স্থানে। ৭ বছর বয়সী সালাহ ফুটবলের ভালোবাসায় পড়েন জিদান, রোনালদো টট্টিদের মতো তারকাদের আইডল মেনে।
ছোট্ট সালাহ খেলা শুরু করেছিলেন গ্রামের ইয়ুথ ক্লাবের হয়ে; সেখান থেকে মিশরীয় প্রিমিয়ার লীগের ক্লাব এল মকাউলোন! মকাউলোনে সালাহ ডাক পাওয়া ছিল এক মিরাকল। তখন সালাহ খেলেন স্থানীয় ক্লাব 'অথমাসন টান্টা'র হয়ে। ২০০৫-০৬ সালের কথা; সেদিন মাঠে খেলা দেখতে উপস্থিত ছিলেন কায়রো থেকে আসা এক স্কাউট। তিনি মূলত অন্য এক খুদে ফুটলারকে কাছ থেকে দেখতে চাচ্ছিলেন; সে ম্যাচে সালাহ ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন দর্শকদের। সালাহ'র পার্ফম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে সেই স্কাউট মকাউলোনে গিয়ে বললেন তার কথা।
বয়স ১৮ পেরুনোর আগেই সুযোগ পেয়ে গেলেন এল মকাউলোনের সিনিয়র দলে খেলার। সেখানেই করলেন বাজিমাত! তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে সুইস ক্লাব এফসি বাসেল তাকে অফার করে বসলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির! কি এমন খেলতেন সালাহ যে তাকে বাসেলের মতো ক্লাব নিতে আগ্রহ দেখায়? উত্তর'টা দিয়েছেন খোদ মকাউলোনের তৎকালীন কোচ শিনিনি; 'সালাহ মাঝমাঠ থেকে বল পায়ে নিয়ে চোখের নিমিষেই বিপক্ষ দলের ডিফেন্স ভেঙ্গে ঢুকে পড়তো ডি-বক্সে; এমনকি ডিফেন্ডার'রাও তাকিয়ে থাকতো তার পায়ের গতি, ড্রিবলিং আর মুগ্ধকর জাদু দেখে!'
বাসেলে দুই মৌসুম কাটালেন সালাহ। প্রথম মৌসুমেই তার অসাধারণ পারফর্মেন্স তাকে এনে দিলো সুইস লীগের প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ারের সম্মান। পাশাপাশি দুই মৌসুমেই ক্লাবের হয়ে জিতলেন সুইস সুপার কাপ। ব্যক্তিগতভাবে পায়ের জাদু দেখিয়ে জিতে নিলেন 'আফ্রিকান বেস্ট প্রমিসিং প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার' এর তকমা। সে বছই জিতলেন ইউয়েফার গোল্ডেন বয় এওয়ার্ড! স্বপ্নের মতো একটা বছর গেলো সালাহ'র।
অবশেষে ২০১৪ সালে স্ট্যামফোর্ড ব্রীজে চেলসির জার্সিতে দেখা গেলো মোহাম্মদ সালাহ'কে। একমাত্র মিশরীয় প্লেয়ার হিসেবে সেবার ১১ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে দ্যা ব্লুজদের সাথে চুক্তিটা সেরে ফেললেন তিনি। কিন্তু বিধিবাম! বাসেলের দূর্দান্ত সালাহকে কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি দ্যা ব্লুজ শিবিরে; কারণ তার প্লেয়িং টাইম স্বল্পতা! দুই মৌসুম চেলসিতে কাটানো সালাহ খেলার সুযোগই পেয়েছিলেন মাত্র ১৩ ম্যাচে, যার বেশিরভাগ ই সাবস্টিটিউট হয়ে!
এরই মধ্যে ঘটে গেলো এক নাটক।
টান্সফার উইন্ডোর শেষ দিনের একদম শেষ পর্যায়ে এসে চেলসি জানালো সালাহ আর থাকছেন না চেলসিতে; ১৮ মাসের লোনে তাকে ব্লুজরা পাঠাচ্ছে ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্তিনায়। ইতালিয়ান এই ক্লাবেও সালাহর মন ঠিক বসলো না; মৌসুম শেষে তাদের সাথে না থাকার ঘোষণা দেয়ায় বেঁকে বসে ক্লাবটি!
২০১৫-১৬ মৌসুমে রোমার হয়ে চমক-ই দেখালেন মিশরীয় মেসি। ৩৪ ম্যাচে ১৪ গোলের পাশাপাশি 'ক্লাবের প্লেয়ার অব দ্যা সিজন' এওয়ার্ড জিতে নিলেন! পরের মৌসুমে রোমা ঘোষণা দেয় তারা সালাহকে পার্মানেন্টলি রেখে দিতে প্রস্তুত। মৌসুমের শুরুটা দারুণভাবে হয়েছিলো সালাহ'র। মৌসুম শেষে সব প্রতিযোগীতায় ১৯ গোল তার প্রমান। তারচেয়ে বড় কথা- সালাহর ধারাবাহিক পারফরমেন্সে রোমা মৌসুম শেষ করে রানার্সআপ হিসেবে।
মোহাম্মদ সালাহ, লিভারপুল এবং একটি অনবদ্য কাব্যঃ
২০১৭ সাল। সবে ইংল্যান্ডে পা রেখেছেন সালাহ। এই আবহাওয়া তার চেনাজানা। এখানে আগেও খেলেছেন; তবু এবার ব্যাপারটা ভিন্ন। কারণ, রোমা'য় সালাহর ধারাবাহিক এবং উজ্জ্বল পারফরমেন্স এবার নজর কেড়েছে ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রভাবশালী ও সেরা ক্লাবের! সালাহ হয়তো রোমায় থেকেই যেতেন; কিন্তু লিভারপুলের প্রস্তাব ফেলে দিতে পারেন নি। তারচেয়ে বড় ব্যাপার এখানকার ফ্যানস। তারা যাকে ভালোবাসে, তাকে হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান দেয় নিঃস্বার্থভাবে। যেমনটা তারা ভালোবেসেছে স্টিভেন জেরার্ডকে।
একজন ফুটবলারের জন্য স্বপ্নের সোনালী সময় কি হতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে এতটুক বলতে পারি- ২০১৭-১৮ মৌসুম মোহাম্মদ সালাহ'র জন্য ছিলো তেমনি একটা সময়। লিভারপুলে তার রাজসিক আগমন, ডেব্যু ম্যাচে গোল আর মৌসুম শেষে সব প্রতিযোগিতায় ৪৪ গোল, ১৬ এসিস্ট! রূপকথা মনে হতে পারে। তবে এমনটাই করে দেখিয়েছেন সালাহ।
এমন নজরকাড়া পার্ফম্যান্স দিয়ে প্রথম মৌসুমেই জয় করে নিয়েছেন লাখো- কোটি লিভারপুল ভক্তের। তাছাড়া, সেবার 'পিএফএ প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার' এর পাশাপাশি ফুটবল রাইটার্স এসোসিয়েশনেরও প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন সালাহ। জিতে নেন প্রিমিয়ারলীগ প্লেয়ার অব দ্যা সিজনের তকমাটাও! প্রিমিয়ার লীগের সে মৌসুমের গোল্ডেন বুটও উঠে তার হাতে। বিবিসি প্লেয়ার অব দ্যা সিজনের সাথেসাথে জিতে নেন বেস্ট আফ্রিকান প্লেয়ার অব দ্যা সিজনের খেতাব। লিভারপুল প্লেয়ারর্স প্লেয়ার অব দ্যা সিজনের পাশাপাশি লিভারপুল ফ্যানস প্লেয়ার অব দ্যা সিজনও নির্বাচিত হন 'মিশরীয় মেসি!'
তার এমন জাঁকজমকপূর্ণ পারফরমেন্স লেগেই থাকলো। শুরুতে কেউ কেউ তাকে 'ওয়ান সিজন ওয়ান্ডার' বলেও খোঁচা দিতে থাকলো। তবে সমালোচকদের গালে কষে থাপ্পড় মারা'টা মাঠে গোল দিয়েই মারতে ভালোবাসেন মোহাম্মদ সালাহ; তাইতো ম্যাচের পর ম্যাচ, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ক্লাবের সেরা প্লেয়ারের ভূমিকায় তাকে দেখা যায়। তিনি হাসেন, হাসতে ভালোবাসেন। মনোযোগ দিয়ে ফুটবল খেলতেও ভালোবাসেন। গোল করেই সেজদায় লুটিয়ে পড়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন! তার ব্যক্তিত্বে মোহিত কি লিভারপুল কি ইংল্যান্ড; দিনকে দিন সালাহ'কে ভালোবাসার মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
২০১৮-১৯ মৌসুমে আরোও ভয়ানক হয়ে উঠলেন মিশরীয় মেসি! যেন গোল দেয়া আর বানিয়ে দেয়ার নেশায় পেয়ে গেছে তাকে। সালাহ মাঠে নামেন দলকে জেতানোর জন্য; আর প্রতিপক্ষরা সালাহকে দেখেন ভয়ঙ্কর এক শিকারির চোখে। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে ছুটে চলেন চিতার বেগে; আলতো করে ছুঁয়ে বলটা জালে পৌঁছে দিয়ে একগাল বিস্তৃর্ণ হাসি হাসি প্রত্যেক ম্যাচেই জানান দেন- তিনি হারিয়ে যাওয়ার নয়।
২৯ বছর লীগ শিরোপা না জেতা এক দলের ভার তখন মাষ্টারমাইন্ড কোচ জার্গেইন ক্লপের হাতে। ক্লপ লিভারপুলে নিয়োগ পেয়ে বলেছিলেন তাকে চারটা বছর সময় দেয়ার জন্য। ইংগিত দিয়েছিলেন লীগ শিরোপার। কিন্তু ১৮/১৯ মৌসুমে এসে তার দল এতোটাই উঁচু মানের খেলা প্রদর্শন করলো যে, তারাই সেবার ইউরোপের রাজা'র সিংহাসনে বসলো। তবে লীগ শিরোপা এবারো হাতছাড়া হলো। লিভারপুলের ৬ তম বারের মতো ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন এই মোহাম্মদ সালাহ'ই! তার করা ফাইনাল ম্যাচের ২ মিনিটের গোলটা এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম গোল।
২০১৯-২০ মৌসুম সালাহর জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ছিলো। তবে ইতিমধ্যেই চ্যাম্পিয়নস লীগ জয় করায় তার দলীয় ও ব্যাক্তিগত পারফর্ম্যান্স নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ রইলো না। এই মৌসুমেও ধারাবাহিক পারফর্ম করেন সালাহ, ফলস্বরুপ মৌসুম শেষে ২৩ গোল ও ১৩ এসিস্ট আসে তার পা থেকে। দলকে ৩০ বছর পর এনে দেন অধরা শিরোপা- প্রিমিয়ারলীগ! যে প্রিমিয়ার লীগের জন্য হাহাকার করেছে লিভারপুল ভক্তরা; যে শিরোপার জন্য বহু তিরস্কৃত হতে হয়েছে তাদের। যে শিরোপার জন্য পুরোটা জীবন খেলে গেলেন স্টিভেন জেরার্ড! সে শিরোপা'ই নিজের করে নিলেন মোহাম্মাদ সালাহ। পুরো ইংল্যান্ড জুড়ে এক উৎসবের জন্ম দিলেন এই কিংবদন্তি। সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ- তাকে নিয়ে যাদের সন্দেহ ছিল, তারা সেদিন তার পায়ের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
তারপর কেটে গেছে বহুদিন। টেমস নদীর পানি বহুদূর গড়িয়েছে। এনফিল্ডের আকাশ বাতাস ততোদিনে চিনে গেছে তাদের একজন সালাহ আছেন। যিনি কেবল দলের সুসময়েই না, বরং দুঃসময়ে দলের ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হয়েছেন বারবার। দলের প্রয়োজনে তাকে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি কারো। সমালোচকদের মুখে কালি লাগিয়েছেন সেতো অনেক আগেই! রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে চলেছেন দিনকেদিন। এইতো কিছুদিন আগেই ক্লাবের হয়ে ছুঁয়ে ফেললেন ১০০ গোলের মাইলফলক।
এইযে এতোসব গল্পের ভীড়ে আমার চোখে বর্তমান সেরাদের একজন মোহাম্মদ সালাহ'র এতো কীর্তি কেন সবার চোখে ধরা পড়ছেনা? মিডিয়া কেন তাকে নিয়ে খুব হইচই করছেনা? নাকি ব্রাজিল- আর্জেন্টিনা কিংবা ইতালি- স্পেনে জন্মান নি বলে সালাহ সেভাবে সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছেন না? যদি এইসব প্রশ্নের উত্তর না থাকে- তবে কেন সালাহ'কে নিয়ে গল্প হচ্ছে না?
- আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য