TEST ক্রিকেটের TASTE : অপরুপ কানপুর, অরুপ চট্টগ্রাম
পোস্টটি ১০৬৬ বার পঠিত হয়েছেকানপুরের ক্রিকেট স্টেডিয়ামটির নাম - গ্রীন পার্ক। সবুজাঙ্গন বা সবুজ উদ্যান। সবুজের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। ভাবালুতা পেয়ে বসে। ঘোর লাগে চোখে। দুনিয়ার সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় সবুজের মাঝে। গ্রীন পার্কে সেরকম নেশা জাগানিয়া সবুজ নেই সত্যি, তবে যা আছে তাতে চোখ ফেরানো দায়। সব কাজ ফেলে রাখে গোগ্রাসে গেলার মতো উপকরণ মজুত। প্রতিমুহূর্তে অবাক উত্তেজনা ও শিহরণ। গ্যালারিতে চিৎকার, আশা-নিরাশার দোলাচল। শত কোটি চোখ চকচক করছে একটি উইকেটের জন্য। মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি। এই বুঝি শেষ, কিন্তু না, আরো একটু অপেক্ষা। আরো খানিকটা আশা। আরো অনেক সুযোগ...। আরো কিছুক্ষণ লড়াই। আরো কিছুক্ষণ পৃথিবী ভুলে উপভোগ করা মাদকতাময় ক্রিকেট।
রাচিন রাভিন্দ্র ও এজাজ প্যাটেল - ইস্পাত দিয়ে গড়া রক্ত মাংসের মানুষ। বিকারহীন। মেঘে ঢাকা সূর্যেও উচ্ছ্বাস নেই, ফের সূর্যের চোরা হাসিতেও নেই হতাশা। সুদৃঢ় সংকল্প। নিঃসীম মনযোগ। ক্লান্তিহীন অধ্যাবসায়। ঘিরে থাকা ফিল্ডারের শ্বাসধ্বনিতে ভয় নেই, বলের ঘূর্ণিকে পরোয়া নেই। একটিমাত্র ভুলের অপেক্ষায় গোটা ভারত, আর ত্রুটিহীন ও নিশছিদ্র সংগ্রামে লিপ্ত দুই নিউজিল্যান্ডার; জন্মসূত্রে যারা ভারতীয়।
লেগ স্লিপ ফাঁকি দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় বল। অস্ফুট হতাশা। বিচিত্র ধ্বনি গ্যালারিজুড়ে, ক্রিকেটারের মুখে। অল্পের জন্য হলো না, ইশ...। রাচিন ও এজাজ - পাহাড়ের মতো অটল, অজেয়, অভেদ্য। ইশান্ত শর্মা বলের পেছন পেছন ছোটেন। রান বাঁচানোর আগ্রহ নেই খুব একটা। বলটা দ্রুত সময়ের মধ্যে ফেরত পাঠাতে হবে। ম্যাচজুড়ে ইশান্তের কাজ ছিল না তেমন, স্মৃতিকাতর হতে পারতেন তিনি। সিনেমার মতো ফ্ল্যাশব্যাক হতে পারে। সিডনির ক্রিকেট মাঠে উনিশের তরুণ ইশান্ত ব্যাটিংয়ে নামছেন। রিকি পন্টিংয়ের ডাক নাম ছিল পান্টার। দিনের কয়েক ওভার বাকি থাকতে দলের দুর্দান্ত বোলারদের বাদ দিয়ে তিনি মাইকেল ক্লার্ককে নিয়ে এলেন বোলিংয়ে। অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক। যেন আকাশের দিকে চেয়ে অপু দশ-বিশ গুণে জুয়া খেললেন অজি-অধিনায়ক। আর বাজিমাৎ তাতেই। পরপর দুই বলে ফিরলেন হারভজন ও রুদ্রপ্রতাপ। হ্যাটট্রিক বলের সামনে ইশান্ত। যেন নেমে পড়েছিলেন অপ্রস্তুত অবস্থায়। তাই অর্ধেক গিয়ে আবার গ্লাভসের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন। ইরফান পাঠান গ্লাভস নিয়ে এলে তা পরে নেন। সত্যি গ্লাভস দরকার ছিল হয়তো, তবে সেই সময় তা অহেতুক সময় নষ্ট মনে হয়।
রাচিন ও ইজাজ - বিন্দুমাত্র সময় নষ্টে মনযোগী নয়। সাইড স্ক্রিণে সমস্যা নেই। গার্ড নিতে দেরি নেই। পিচে অপ্রয়োজনীয় কোনো খড়কুটো নেই। প্রতিটি বলের পর, প্রতিটি ওভারের পর গার্ড নিচ্ছেন নিশ্চিত দৃঢ়তায়। কী সুন্দর! কী অপরুপ! কী চমৎকার!
ড্রেসিংরুমও আশ্চর্য শান্ত। অধিনায়ক উইলিয়ামসন বরাবরের মতো নির্লিপ্ত। যেন মধ্যমাঠে কিছুই ঘটছে না। সাধারণ, স্বাভাবিক যেমন হয়, সেরকম ব্যাট বলের ক্রিকেট হচ্ছে। একে একে বায়ান্নটি বল, প্রকৃতির উদারতায় ভারত পায় সর্বোচ্চ সুযোগ। তবে ভাঙা যায় না রাচিন-এজাজ জুটির মজবুত দেয়াল। খুব সম্ভব ফেভিকলের মজবুত জোড় দেয়া হয়েছিল।
নিতিন মেনন কী পূণ্য করেছিলেন কে জানে! সময়ের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল ও প্রতিভাবান আম্পায়ার। সৎ ও দক্ষ। বারংবার লাইট মিটারে আলো পরিমাপ করে নিচ্ছিলেন। বীরেন্দর শর্মা তার সহযোগী, ঘন ঘন আলাপ করছেন দুই আম্পায়ার। হয়তো খেলা বন্ধ হয়ে যাবে দ্রুতই, পর্যাপ্ত আলো নেই। থাম্বস আপ দেখানো হয় ব্যাটসম্যানদের, হয়তো এই ওভারটা শেষ...। নিউজিল্যান্ডের পরিবর্তে যদি ভারত থাকতো সেখানে, শেষ দুই ব্যাটসম্যান যদি ভারতীয় হতেন, তাহলেই নিতিন মেনন আর সৎ আম্পায়ার থাকতেন না। তার নিরন্তর ছোটাছুটি, লাইট মিটার চেক, অনেকের চোখে হয়তো ভারতকে বাঁচিয়ে দেয়ার কূটকৌশল মনে হতো। কিন্তু মেনন কর্তব্যের ক্ষেত্রে আপোষহীন। কড়া বিচারক। সুবিবেচক আম্পায়ার। মিটারে কী উঠছে তাও দেখান তিনি ব্যাটসম্যানদের, কিন্তু সূর্য নেভার আগে দপ করে জ্বলে উঠলে লাইট মিটার আর দরকারই পড়ে না।
অশ্বিন-অক্ষর-জাদেজা ত্রয়ীর সর্বাত্মক চেষ্টা বিফলে যায়। সূর্যের ঝলমলিয়ে হেসে উঠাও ভারতের কাজে আসে না। ছাতার মতো ঘিরে থাকা ফিল্ডারদের উৎপেতে থাকা হয় অর্থহীন। অজিঙ্কা রাহানের সকল কৌশল ব্যর্থ। অশ্বিনের বুদ্ধিমত্তা ও নানান পরিকল্পনা অকার্যকর প্রমাণিত হয়। শত কোটি প্রাণের অনুনয় প্রার্থনার বদলে দুই ভারতীয় প্রাণের নিউজিল্যান্ডের জন্য সুদৃঢ় সংগ্রামই পায় পূর্ণতা। ভারত জিততে জিততে জেতে না, নিউজিল্যান্ড হারতে হারতে হারে না। অসম্ভব সুন্দর এক ক্রিকেট ম্যাচের সাক্ষী হয় অসংখ্য ক্রিকেট প্রাণ। বিশ্বাস আরো পোক্ত হয় - টেস্ট ক্রিকেট কক্ষনো মরবে না।
টেস্ট ক্রিকেট রঙ বদলায়। কখনো ধূসর হতে হতে রঙিন। কখনো রঙিন থেকে হয়ে উঠে ধূসর। রঙ বদলের এই সৌন্দর্যই টেস্ট ক্রিকেটকে করে অমর, অজর, অক্ষয়। কিন্তু টেস্ট যারা খেলে সবাই সেরকম অমর হয় না। সেরকম সুন্দর লালন করে না। কারো কারো টেস্ট ক্রিকেট কুৎসিত, বিশ্রী, বিদঘুটে। ফ্লাওয়ার ভাইদের সৌন্দর্য, স্ট্রীকের হার না মানা লড়াই নেই জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে। উইন্ডিজ ক্রিকেটে অনুপস্থিত স্যার ওয়েসলি হলের মতো অদম্য লড়াকু। তারপরও অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবময় পূর্বসূরীদের ভূত সওয়ার হলে উইন্ডিজ ক্রিকেট অন্যরকম হয়ে যায়, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট চমকে দেয় হঠাৎ। বাংলাদেশ ক্রিকেটে না আছে সমৃদ্ধ ক্রিকেট সংস্কার, না আছে প্রাণপণ লড়িয়ে পূর্বসূরি। তাই কানপুরের গ্রীনপার্কে যখন নিউজিল্যান্ডের টেলএন্ডার লিখে টেস্ট ক্রিকেটের চিরন্তন সৌন্দর্যের সন্ধ্যা, তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান আউট হন টেলএন্ডারের মতো করে। পিঠাপিঠি সহোদরের মতো দুটি টেস্ট - কানপুর ও চট্টগ্রাম। অগ্রজকে যেমন অনেক ক্ষেত্রেই অনুসরণ করে অনুজ, এখানেও তা-ই। কিন্তু শেষটায় কানপুর হয়ে যায় কত রঙিন, কত চিত্তাকর্ষক, কত মনোমুগ্ধকর। আর চট্টগ্রাম কেমন বিবর্ণ, রঙহীন, সাদামাটা।
বছর দুই আগে নবীন ক্রিকেট শক্তি আফগানিস্তানের বিপক্ষে মোটে ক'ওভার টিকে থাকা সম্ভব হয়নি, এই চট্টগ্রামেই ছিল সেটা। দুই দশকের বেশি সময়ের পথচলায় বেশ কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের যে হার না মানা লড়াই, মরণপণ সংগ্রাম, বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী সংকল্পের যে গল্প তা একদমই অনুপস্থিত। টেস্ট ক্রিকেট তো কেবল ব্যাট-বলের সংঘাত নয়, তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক ও ধৈর্য নিয়েও মাঠে থাকতে হয়। টেস্ট ক্রিকেটকে লালন করতে হয়, ধারণ করতে হয়। ধর তক্তা মারো পেরেক পদ্ধতি এখানে অচল। সাধক হতে হয় এখানে। যত্ন নিতে হয়। পরিচর্যা করতে হয়। ক্রিকেটার থেকে শুরু করে ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের কর্তা পর্যন্ত কেউই টেস্ট ক্রিকেটকে আলিঙ্গনে ইচ্ছুক নয়। তাই টেস্ট ক্রিকেট এখানে মেলে ধরে না অপরুপ সৌন্দর্যময় সন্ধ্যা। এখানে টেস্ট ক্রিকেট একঘেয়ে। বছরের পর বছর ধরে একইরকম, শীতের বুড়ির মতো নির্জীব, খসখসে, বিরক্তিকর।
ইন্ডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্সে হঠাৎ প্রত্যাশাতীত সফলতা ছাড়া আর কিছু নেই। এখনো সেই শুরুর সময়ের মতো। মাঝে ক'টা প্লেয়ারের কিছু রান জড়ো হয়েছে, কারো ঝুলিতে জমা পড়েছে উইকেট। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের যে 'টেষ্ট' পরম আরাধ্য ক্রিকেট দর্শকের কাছে - সেরকম কিছু নেই।
শ্রেয়াস আইয়ার শ্বেত বলের ভবিষ্যৎ থেকে শ্বেত পোষাকের ক্রিকেটে কী অসাধারণভাবে রুপান্তরিত হন। রবি অশ্বিন ভাবেন, খুব ভাবেন, ক্রিকেট নিয়ে, ক্রিকেটের নিয়মনীতি নিয়ে। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া নিয়ে। ঋদ্ধিমান প্রথম সুযোগেই নিজেকে প্রমাণ করেন। অক্ষর-জাদেজা মধুর লড়াইয়ে নামেন। পেস ইউনিট ভীতিকর সুন্দর। ল্যাথামরা জানান স্পিনটাও শিখে নিয়েছেন তারা। রাচিন-এজাজ ভাবাবেগের উর্ধ্বে উঠেন, পুরোদস্তুর পেশাদার। নিতিন মেনন ও বীরেন্দর শর্মা কর্তব্যের খাতিরে নিরপেক্ষ একদম। কত্ত সুন্দর! কী অসম্ভব সুন্দর। পুরো ব্যাপারটা গুণে-মানে আনন্দে-বৈচিত্র্যে অন্যমাত্রায় পৌঁছে। আর লিটনের মেইডেন সেঞ্চুরি হাহাকার জাগায়। বেচারা জানলেনই না নিজের সামর্থ। মুশফিকুর রহিমের দৃঢ়চিত্ততা কখনো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। বছর পেরিয়ে যায়, বয়স বাড়ে, ছোটরা বড় হয়, বড়রা বুড়ো হয়, অথচ শান্ত-মিরাজরা দায়িত্ব নেয়ার মতো পোক্ত হন না। মুমিনুল প্রত্যাশার পারদ উঁচুতে রেখে নীচে নেমে ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে থাকেন। যেন বাংলা সিনেমার সেই একধাঁচের চিত্রনাট্য। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে গরীবের লড়াই। বুড়ো খোকার নবীন সেজে কলেজে পড়া। ঢিশুম ঢিশুম মারপিট, এক-আঁধটু নাচ। নায়িকার বালিশ চেপে কান্না, হতাশ নায়কের হাতে লাল পানীয়। বিটিভির শুক্রবারের বাংলা ছায়াছবির মোহ অবলীলায় কেটে গেলেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি ভালো লাগা কাটে না। তাই একঘেয়ে ও বিরক্তিকর চিত্রনাট্যের পৌনঃপুনিক মঞ্চায়ন দেখতে হয়, একদিন, দুইদিন, তারপর দিন, প্রতিদিন, প্রতিবার...।
অপরুপ সৌন্দর্যমণ্ডিত ক্রিকেটের গল্পগুলো তাই অনেকটা বিদেশী কাহিনীর ছায়া অবলম্বনের মতো। সেখানে বাংলাদেশের গল্প নেই, বাংলাদেশী কেউ নেই। অপরুপ ও অরুপের মাঝে পার্থক্যটা সামান্য। একটিমাত্র - প। তবে সেই প-এর যুৎসই ব্যবহার জানতে হবে। নয়তো অরুপপ বা পঅরুপ এর মতো অর্থহীন শব্দে পরিণত হবে তা। অরুপ ও অপরুপ শব্দগুচ্ছের পার্থক্যও জানা থাকা চাই। আশাহীন হওয়া কোনো সমাধান নয়, আশাবাদী হয়েও অবশ্য লাভ নেই যদি না কার্যকর পরিবর্তন সাধিত হয়।
এই দেশের অরুপ ক্রিকেট একদিন অপরুপ হবে, বিশ্রী অবকাঠামো সুশ্রী হবে, শিল্পী ও সাধকের মন নিয়ে গড়ে তোলা হবে এই দেশের ক্রিকেট। তখন, হয়তো কোনো একদিন কানপুরের সন্ধ্যার মতো অবাক ও অপরুপ ক্রিকেট সৌন্দর্যের রচয়িতা হবে বাংলাদেশ। মঞ্চটা চট্টগ্রাম হতে পারে, অথবা অন্য কোথাও। অমন অনিন্দ্য সুন্দর সময়ের গল্প যে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই যে কেউ দেখতে চায়।
- 0 মন্তব্য