মারিও বালোতেল্লিঃ ফুটবলের দুর্দান্ত এক ব্যডবয়!
পোস্টটি ১৬৩৫ বার পঠিত হয়েছেছোট্ট মারিওর জীবনে আসলে ইন্টারেস্টিং তেমন কিছুই ছিল না। ইতালির পালের্মো'তে ঘানাইয়ান অভিবাসী পরিবারে জন্ম; বছর দুয়েক না যেতেই জন্মস্থান ত্যাগ করে ইতালির উত্তরাঞ্চলের শহর ব্রেসিয়া'য় চলে যাওয়া। জীবনমানের তীব্র অবক্ষয়, দারিদ্রতার পাশাপাশি এতটুক বয়সেই নানাবিধ রোগব্যাধিতে ভোগা! বালকের জীবন'টাই ফেনিল- রঙচটা, দারুণ স্যাঁতসেঁতে।
দরিদ্র বাবা-মা বেশিদিন পুষতে পারলেন না তাকে। ৪ ছেলেমেয়ের সংসার চালানো তখন দায়। বছর তিনেক না পেরুতেই মারিও'র স্থায়ী নিবাস হয়ে গেলো কোনো এক 'ফস্টার হোম', যেখানে হেলা-ফেলা অবহেলায় বড় হয় শিশুরা। বড় হওয়া তো নয়, এ যেন এতটুক বয়সে ঢাল তলোয়ারহীন পুরাদস্তুর এক ময়দানে সংগ্রাম করতে শিখা।
মারিও'র ভাগ্যে যদিও এ যাত্রায় সুপ্রসন্ন ছিলো। যুদ্ধবিরতির সাদা মশাল হাতে তাকে বরণ করতে রাজী হলেন এক দম্পতি। তাদের তিন সন্তানের ভীড়ে ছোট্ট মারিও যেন নিজেকে খুঁজে বেড়াতে থাকলো। ভালো স্কুল, খাবারদাবার, একসাথে ৪ জন বেড়ে উঠা; তবু মারিও'র মন বসতো না এখানে। সপ্তাহে পেরুলেই চলে যেতো 'আসল' বাবা-মায়ের কাছে। রক্তের তীব্র টান ছিলো বলেই হয়তো! তবে আস্তে আস্তে এই টানও কমে যেতে থাকলো। মারিও'র কাছে তখন দুটো রাস্তাই খোলা ছিলো- লালনপালনকারী বাবা-মায়ের সাথে থাকা এবং জন্মদাতা পিতামাতার কাছে যেতে পারা; কিংবা যেকোনো একটা বেছে নেয়া!
মারিও তারলালনপালনকারী পিতামাতার কাছে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। তবে এই সিদ্ধান্ত নিছক মারিওর ছিল না, বরং তার জন্মদাতা পিতামাতা-ই জানিয়ে দিলেন 'বালক মারিওর ভরণপোষণ, সামাজিক দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই!'
গল্প শুরুর রংচটা জীবনযাত্রার ছোট্ট মারিওর জীবন এখান থেকেই ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠতে লাগলো। মারিও বারওয়াহ থেকে বালকের পরিচিতি তখন মারিও বালোতেল্লি'তে!
তারপর সময় যত পেরিয়েছে, ভার্সাই নদীর পানি ততোই গড়িয়েছে। মিলানের শিল্পসাহিত্য জনসমাগম বেড়েছে; ফুটবলে ইতালির জনপ্রিয়তা দিনদিন তীব্র হয়েছে। এদিকে মারিও বেড়ে উঠেছে স্বযত্নে। বয়স ১১ কেবল ছুঁয়েছে, পিতামাতা তাকে ভর্তি করে দিয়েছেন ফুটবল একাডেমিতে। যদিও এসি লুমিজানের সিনিয়র টিমে তাকে দেখা গেলো বছর চারেক পরে। মারিও যথেষ্ট সিরিয়াস ছিল একাডেমিতে। সেবছরই বার্সালোনায় ট্রায়াল দিয়ে আসলো। বিধিবাম, ব্যর্থ হলো যে যাত্রা; বার্সা তার প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারলো না।
বার্সায় ব্যর্থ যোদ্ধা লোনে নাম লেখালেন ঐতিহ্যবাহী ইন্টার মিলানে। ২০০৭/০৮ সিরিআ জিতলেন, সুপার কোপা জিতলেন '০৮ সালে। ১৮ বছর বয়সে চ্যাম্পিয়নস লীগ ম্যাচে গোল করে তকমা লাগালেন তৎকালীন সর্বকনিষ্ঠ গোলস্কোরার নামে। ইতালিয়ান'রা বরাবরই ফুটবল পাগল জাতি হিসাবে পরিচিত। এখানে পাগলামীর চূড়ান্ত দেখাতে শুরু করলেন মারিও। নিয়মিত প্রেক্টিস সেশন মিস করা তার অভ্যাসে পরিণত হলো। পাশাপাশি, সাদাকালো বৈষম্যের শিকার হতে হলো কয়েকবার।
২০১০ সালের শেষের দিকে বালোতেল্লির জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম নিলো। ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি'তে যোগ দিলেন মারিও; অভিষেক ম্যাচেই গোল দিয়ে জানান দিলেন তার অস্তিত্ব। মৌসুম না পেরুতেই ক্লাব ভক্তদের প্রিয়জন হতে শুরু করলেন।
তবে ম্যানচেস্টার সিটি অধ্যায়টা সুখকর ছিল না মারিওর জন্য। কোচের সাথে মনমালিন্য, দুই বছরে অন্তত ১১ টি ম্যাচে সাসপেন্ড, টিমমেটদের সাথে মারামারি, মজা করার নামে মারাত্মক এট্যাক; দেরি করে ট্রেনিংয়ে আসা বা মিস দেয়া; ক্যারিয়ারের প্রতি উদাসিতা- বালোতেল্লি দিনকেদিন তার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন সিটিতে।
২০১৩ সালে মারিও বালোতেল্লি আবারো ফিরে যান ইতালিতে। এবার এসি মিলানের জার্সি গায়ে জড়ান সুপার মারিও। ১৩ ম্যাচে ১২ গোল করে দারুণ এক মৌসুম কাটান সেখানে। পরের মৌসুমেই আবার ক্লাব পালটে নাম লেখান লিভারপুলে!
কিন্তু ব্রেন্ডন রজার্সের অধীনে ঠিক খাপ খাইয়ে উঠতে পারলেন না বালোতেল্লি। অলরেডদের হয়ে ১৩ নাম্বার ম্যাচে ১ম গোলের দেখা পাওয়া বালোতেল্লি মৌসুম শেষ করেছেন ২৮ ম্যাচে মাত্র ৪ টি গোল করে! সমালোচকদের চোখে বালোতেল্লির এই সাইনিংটাই ছিল মৌসুমের সবচেয়ে খারাপ সাইনিং! পরের মৌসুমেই আবারো মিলানে পাড়ি জমান মারিও। সেখান থেকে ফ্রেঞ্চ ক্লাব নিস। নিসে ২ মৌসুম কাটিয়ে মার্সেইলে ও ব্রেসিয়া'তে! ফুটবল ক্যারিয়ারটা আর আকর্ষণীয় করতে পারলেন না বালোতেল্লি।
মহাকবি জন মিল্টন বলেছিলেন ভোর দেখে দিনের আন্দাজ করা যায় যেমন, তেমনি বাল্যকাল থেকে ধারণা নেয়া যায় শিশু বড় হয়ে কেমন হবে। বলাই বাহুল্য, বাল্যকাল থেকেই মারিও ফুটবলে ছিল দারুণ; পাশাপাশি অফুটবলীয় ব্যাপারগুলোতেও। এই যেমন স্কুলের বন্ধুদের চড় মেরে গাল লাল করে দেয়া কিংবা খেলার মাঠে লাথি মেরে কাউকে ফেলে দেয়া।
পাগলাটে বালোতেল্লি, বালোতেল্লির পাগলামিঃ
ইন্টার মিলানে থাকাকালীন একবার এক স্পোর্টস চ্যানেলে টকশোর আমন্ত্রন পান বালোতেল্লি। তিনি সে অনুষ্টানে ঠিকই গিয়েছিলেন, তবে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব এসি মিলানের জার্সি পড়ে!
ম্যানচেস্টার সিটিতে কোচ রবার্তো মানচিনি ব্যতিক্রমী এক আইন জারি করেছিলেন; ম্যাচের ৪৮ ঘন্টা পূর্বে কেউ টাউনের বাইরে যেতে পারবেন না। বালোতেল্লি সে আইন ভঙ্গ করে ম্যাচের আগেরদিন রাত দুটায় এক নাইটক্লাবে চলে যান। ফলস্বরুপ জরিমানা গুনতে হয় চার লাখ ডলার!
বালোতেল্লি তার চার বন্ধুকে নিয়ে একবার আতশবাজি ফুটানোর পরিকল্পনা করছিলেন; তন্মধ্যে একটি আতশবাজি তার বাথরুমে ফুটে গিয়ে মূহুর্তেই আগুনে পুড়ে যায় পুরো বাথরুম।
তৎকালীন ইন্টার মিলান কোচ হোসে মরিহো'র সাথে বালোতেল্লির একটি মূহুর্ত ভাগাভাগি করি; কাজানে চ্যাম্পিয়নস লীগ ম্যাচ খেলতে গেছে ইন্টার। সে ম্যাচে ইঞ্জুরিজনিত কারণে বাদ পড়েছেন ডিয়াগো মিলিতো, ইতোর মতো প্লেয়ার। মরিনহোর তখন একমাত্র ভরসা বালোতেল্লি। ম্যাচের ৪২ মিনিটে হলুদ কার্ড খেয়ে বসেন বালোতেল্লি। মরিনহো অপেক্ষা করছিলেন ম্যাচ বিরতির। বিরতির ১৫ মিনিটের ১৪ মিনিট'ই তিনি মারিও'কে বুঝান, 'দেখো মারিও, আমি তোমাকে বদলাতে পারবো না, বেঞ্চে কোনো স্ট্রাইকার নাই। তো কাউকে টাচ করবে না, শুধু বল নিয়ে খেলো। আমরা বল হারালে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবেনা, কেউ তোমাকে মারলেও না। এমনকি রেফারি ভুল করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে না।' বালোতেল্লি বাধ্য বালকের মতো শুনে যাচ্ছিলেন সেসব। ম্যাচ শুরু হলো। পরের মিনিটেই অহেতুক ফাউল করে লাল কার্ড দেখে হাসতে হাসতে মাঠ থেকে বের হয়ে গেলেন বালোতেল্লি!
২০১১ সালের কথা। বিলাসবহুল মাজেরাটি গাড়ি নিয়ে ট্রেনিং সেশনে আসার সময় পুলিশ বালোতেল্লিকে দাঁড় করায়। গাড়ির সামনের সিটে ২৫ হাজার পাউন্ড ছড়ানো দেখে তারা দেখে অবাক হয়! মারিওকে জিজ্ঞেস করে 'এতো টাকা কিসের জন্য?' মারিও উত্তর দেন 'কারণ আমি ধনী!' আরেকবার ট্রেনিং গ্রাউন্ডের কাছাকাছি তার 'আউদি আরএইট' মডেলের গাড়িটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়; পুলিশ এসে দেখে মারিও পকেটে ৫ হাজার পাউন্ড নিয়ে ঘুরছেন!
মজার একটা ফ্যাক্ট শেয়ার করি; মারিও বালোতেল্লি তার পুরো প্রিমিয়ার লীগ ক্যারিয়ারে মাত্র একটা এসিস্ট করেছেন। আর সেটা কুন আগুয়েরো'র লীগ শিরোপা জয়ী গোলের এসিস্ট!
গোলের প্রসঙ্গ যখন আসলো তখন আরেকটা ফ্যাক্ট শেয়ার করা উচিত; প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরু করার ৭ বছর পর পর্যন্ত মারিও বালোতেল্লি কোনো পেনাল্টি মিস করেন নি! ২১ টা পেনাল্টি থেকে ২১ টা গোল করেছেন।
ঘানা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলার সুযোগ এসেছিলো বালোতেল্লির জীবনে। তবে তা তিনি উড়িয়ে দেন ইতালির হয়ে খেলবেন বলে। ১৯ বছর বয়সে ইতালি জাতীয় দলের হয়ে অভিষেকও হয়ে যায় তার।
গোল্ডেন বয় এওয়ার্ড জেতার পর ২য় হওয়া জ্যাক উইলশেয়ারকে চিনেন না বলে জানান বালোতেল্লি; পাশাপাশি তার সাথে কখনো দেখা হলে বলতেন কেন সে ২য় হয়েছে!
বালোতেল্লির চূড়ান্ত পাগলামির কীর্তিকলাপ অভ্যাসের একটি ছিল টাকা বিলানো। একবার ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সকল লাইব্রেরি জরিমানা দিয়ে বসেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৬-১ গোলে হারানোর পরদিন সিটি শপিং মলে অপরিচিত কাউকে দেখলেই ৫০ পাউন্ডের নোট ধরিয়ে দেন!
একটা বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। একটা মহাকাব্যে। একজন রচয়িতা মারিও বালোতেল্লি। বিলাসী ক্যারিয়ারে জিতেছেন বহু কিছু, হারিয়েছেন তারচেয়ে বেশি। দলকে জিতিয়েছেন কখনো, কখনো খাদের কিনারায় ফেলেছেন। কখনো হিরো কখনো ভিলেন সেজে রাঙ্গিয়ে গেছেন ফুটবলের রঙ্গমঞ্চটা। শতশত প্রাপ্তিও আছে, সেসবের পিছনে ব্যর্থতার গল্পও আছে। হাসিয়েছেন যেমন, বারবার বর্ণবৈষম্যর শিকার হয়ে কেঁদেছেনও তেমন। মান অভিমানে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসলেন কত! জীবনটা কত ছোট; সবসময় খারাপটা মারিও'র সাথেই ঘটবে কেন? মারিও তো ঠিকই জিজ্ঞেস করেন 'হোয়াই অলওয়েজ মি?' সঠিক উত্তর দিয়েছেন কেউ কখনো?
- আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য