• ফুটবল

১৯৮৬ বিশ্বকাপ এবং একজন ডিয়েগো ম্যারাডোনা

পোস্টটি ২০৪৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ম্যারাডোনার জন্য নিজেকে বিশ্বমঞ্চে প্রমাণ করার জন্য এক প্রকার চ্যালেঞ্জ ছিল।কারণ ছোটবেলা থেকে তার ২ টা স্বপ্ন ছিল।প্রথমটা,আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বিশ্বকাপে খেলা এবং বিশ্বকাপ জয় করা।১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতলেও সেবার বয়স কম হওয়াতে ম্যারাডোনা স্কোয়াডে ছিলেন না।আর ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিরুদ্ধে লাল কার্ড পেয়ে বিতর্কিত হওয়া-তাই নিঃসন্দেহেই বলা যায় ১৯৮৬ বিশ্বকাপ হয়তো ম্যারাডোনার পুরো ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং চ্যাপ্টার ছিল।

 

gettyimages-129069002-612x612 

সেবার আর্জেন্টিনা এবং ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ মিশন শুরু হয় গ্রুপ স্টেজে সাউথ কোরিয়া ম্যাচ দিয়ে।সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে জয় লাভ করে,আর্জেন্টিনার ৩ টি গোলেই এসিস্ট করেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা।

 

আর্জেন্টিনার গ্রুপ পর্বের পরের ম্যাচ ছিল জায়ান্ট ইতালির বিপক্ষে।ইতালির বিপক্ষে আর্জেন্টিনা শুরুতে গোল হজম করে পিছিয়ে পড়লেও এক প্রকার অসম্ভব এংগেল থেকে অধিনায়ক ম্যারাডোনার করা গোলের সুবাদে ১-১ গোলে ঐ ম্যাচ ড্র করে মাঠ ছাড়ে।

gettyimages-79653091-612x612 

গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার সর্বশেষ ম্যাচ ছিল বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে।ঐ ম্যাচ আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে জিতে রাউন্ড অফ সিক্সটিন নিশ্চিত করে।ঐ ম্যাচেও ম্যারাডোনা ১ টি এসিস্ট করেন,তার বাড়িয়ে দেয়া বলেই বুরুচাগা হেড করে গোল দেন। 

gettyimages-1147935308-612x612 

গ্রুপ স্টেজে সেবার আর্জেন্টিনা মোট ৬ টা গোল করে,তার মধ্যে ৫ টা গোলেই অবদান রাখেন ম্যারাডোনা!শুধুমাত্র গ্রুপ স্টেজ শেষ হওয়ার পরই তার এসিস্ট সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪ এ।বলা হয় যে একটি দিনের সূর্য দেখেই নাকি বলে দেয়া যায় দিনটি কেমন হবে,ঠিক তেমনি ঐ বিশ্বকাপের গ্রুপ স্টেজ এর ম্যাচগুলোও যেনো জানান দিচ্ছিলো এই বিশ্বকাপটা শুধু ম্যারাডোনারই হবে,পুরো বিশ্বকাপই ম্যারাডোনাময় হবে।

রাউন্ড অফ সিক্সটিন এ আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ উরুগুয়ে।ম্যাচটা আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে জিতে।এই ম্যাচে হয়তো প্রত্যক্ষভাবে ম্যারাডোনার গোল বা এসিস্ট ছিল না,কিন্তু ঐ যে,কিছু কিছু প্লেয়ার আছে যারা গোল এসিস্ট না করেও ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিতে পারে-তাদের মধ্যেই একজন ম্যারাডোনা।ম্যারাডোনার বাড়িয়ে দেওয়া বলেই আর্জেন্টিনার ঐ একমাত্র গোলের বিল্ড আপ শুরু হয়।

 

gettyimages-505000168-612x612

এরপরই আসে সেই ঐতিহাসিক আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ড ম্যাচ।ঐ ম্যাচের কথা আমরা আপনারা কম বেশি সবাই জানি।মেক্সিকোর আজটেকা স্টেডিয়ামে সেদিন ১০০০০ মানুষ সমবেত হয়েছিলেন আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ড এর সেই ম্যাচ দেখতে।ম্যারাডোনা দর্শকদের হতাশ করেন নিই,খুব সম্ভবত ঐ বিশ্বকাপের সবচেয়ে সেরা পারফরম্যান্স ম্যারাডোনা ঐ ম্যাচেই দেখিয়েছেন।ঐ ম্যাচে আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে জয় লাভ করে,দুটি গোলই ম্যারাডোনার ছিল।

 

gettyimages-78986258-612x612

এর মধ্যে প্রথম গোলটি হাত দিয়ে করা সেই বহুল আলোচিত "হ্যান্ড অব গড"।আর দ্বিতীয় গোলটা তার চাইতেও আলোচিত " গোল অব দ্যা সেঞ্চুরি"-কারো কারো মতে এখন পর্যন্ত ফুটবলের সর্বকালের সেরা গোল।ইংল্যান্ডের ৪ জন ফুটবলারকে কাটিয়ে গোলকিপার পিটার শিল্টন কে ফাঁকি দিয়ে দেয়া ঐ গোল যারা লাইভ দেখেছিলেন তারা হয়তো এর চাইতে সুন্দর কোনো ফুটবলীয় মুহূর্ত জীবনে কখনোই দেখেন নিই।বলা যায়,মোটামুটি ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যেই বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে পৌছায় টিম আর্জেন্টিনা।

gettyimages-1629927-612x612

 

সেমি ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল বেলজিয়াম।আর্জেন্টিনা জিতলো ২-০ গোলে,এর মধ্যে একটি গোল ম্যারাডোনার।তাও গোলটি এমন তেমন সাধারণ গোল না,তার অন্যান্য গোলগুলোর মতো এই গোলও ছিল ফুটবল শিল্পের প্রতিচ্ছবি।ডি বক্সের বাইরে থেকে চারজন বেলজিয়ান কে কাটিয়ে গোলকিপার কে বোকা বানিয়ে গোল করেছিলেন ম্যারাডোনা।আর্জেন্টিনা চলে গেলো ফাইনালে।ঐ ম্যাচের পর হয়তো দেশ বিদেশের সব দৈনিক পত্রিকার শিরোনামের মূলভাব হয়তো এটাই ছিল,"এক ম্যারাডোনায় চড়ে বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা"

gettyimages-1064052298-612x612

অবশেষে এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ফাইনাল।ঐ ফাইনালের জন্য পুরো বিশ্বের ফুটবল ফ্যানদের চাইতে হয়তো ম্যারাডোনার প্রতীক্ষা কয়েক গুণ বেশি ছিল।কারণ ঐ যে,ম্যারাডোনা ছোটবেলা দুটো স্বপ্নই দেখতেন,প্রথমটি হলো আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বিশ্বকাপে খেলা এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া।আজ তার আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাঝে মাত্র ১ ম্যাচের দূরত্ব।বাকি ম্যাচগুলোর মতো এই ম্যাচটিও যদি নিজের করে নেন তাহলেই তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন পূরণ হবে।

gettyimages-52928881-612x612 

অবশেষে হিটলারদের স্বজাতি জার্মানির সাথে আর্জেন্টিনার ফাইনাল শুরু হলো।তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার লোথার ম্যাথিউস ম্যাচের পুরোটা সময় ম্যারাডোনা কে মার্ক করে রেখেছিলো।কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয় নিই,কারণ ম্যারাডোনারা কখনো হার মানে না।শত বাধা উপেক্ষা করে যারা বিজয়ী হিসেবে মাঠ ছাড়ে তারাই যে ম্যারাডোনা!সেই ম্যাচে ম্যারাডোনা ১ টি এসিস্ট করেন,কিন্তু সেই ১ টি এসিস্ট হয়তো ম্যারাডোনার পুরো বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স এর চাইতে সবচেয়ে বেশি দামী কারণ তার বাড়িয়ে দেয়া সেই বলেই বুরুচাগা গোল করে ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দেন।আর্জেন্টিনা জিতে যায় ৩-২ গোলে,দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে উঠে আর্জেন্টিনার।ম্যারাডোনাময় একটি বিশ্বকাপের সমাপ্তি ঘটে ম্যারাডোনার হাতে বিশ্বকাপ উঠার মাধ্যমেই!

gettyimages-1629139-612x612

 

এবার আসা যাক আরো ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার ইন্ডিভিজুয়াল কিছু পরিসংখ্যানে:

আর্জেন্টিনা ঐ বিশ্বকাপে ১৪ টি গোল করে,তার মধ্যে ৫ গোল এবং ৫ এসিস্ট করে ১০ গোলে অবদান রাখেন ম্যারাডোনা,পার্সেন্টেজ হিসাব করলে আর্জেন্টিনার গোলগুলোর ৭১% গোলেই ম্যারাডোনার অবদান ছিল।

ঐ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা যতগুলো শট নেয় বা চান্স ক্রিয়েট করে তার ৫২% ই ম্যারাডোনার পা থেকে এসেছিলো।

ঐ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ৯০ টি ড্রিবল সম্পন্ন করেন,যা ঐ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ছিলো।

এমন অতিমানবীয় পারফরম্যান্স এর পর যে ম্যারাডোনা ঐ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল পাবে সেটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়,তবে মজার বিষয় হলো আর ২ গোল করলেই গ্যারি লিনেকার কে টপকিয়ে সেবার গোল্ডেন বুটও জিতে নিতে পারতেন ম্যারাডোনা।

 

কারো কাছে ৮৬ বিশ্বকাপ মনে থাকবে ম্যারাডোনার সেই হাত দিয়ে দেয়া গোলের কারণে,কারো কাছে ৮৬ বিশ্বকাপ মনে থাকবে ম্যারাডোনার দেয়া সেই সর্বকালের সেরা গোলের কারণে,কারো কাছে ঐ বিশ্বকাপ মনে থাকবে ম্যারাডোনার ক্যারিয়ার এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কম্পলিট করার বিশ্বকাপ হিসেবে।কিন্তু সবাই ঐ বিশ্বকাপকে "ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ" হিসেবে মনে রাখতে বাধ্য।এমন বোধহয় ফুটবল ইতিহাসে দ্বিতীয়বার হয় নি যে একটি বিশ্বকাপের পুরো লাইমলাইট একজন প্লেয়ারই নিজের পারফরম্যান্স এর মাধ্যমে নিয়ে গেছেন।