• ফুটবল

পাওলো হেনরিক গানসো - কোথায় হারিয়ে গেলেন তিনি??

পোস্টটি ১৫৩০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

পাওলো হেনরিক গানসো'র কথা মনে আছে? হয়তো অনেক বছর হয়ে গেছে, যখন আপনি সর্বশেষ গানসো'র কথা শুনেছেন! অথচ, গানসো'র বয়স মাত্র ৩১, অবসর'ও নেননি, অথচ সাবেক সান্তোস, সাও পাওলো, সেভিয়া মিডফিল্ডার কোথায় আছে, ফুটবল খেলছেন কিনা, কজন'ই বা জানি!  

ইন্টারনেট দুনিয়ার যেকোনো সার্চ ইঞ্জিনে গানসো'র নামে সার্চ দিলেই গানসো'র ফেলে আসা সেই সোনালী সময়ের দেখা পাবেন, ইউটিউবে দেখা মিলবে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ফুটবল প্রতিভার, চোখে পড়বে গানসোর সেই চোখ ধাঁধানো ফার্স্ট টাচ, ডিফেন্স ছেড়া পাস! কিন্তু গানসো'র সেই মুহূর্তগুলো এখন অতীত, কেবলই স্মৃতি। গানসো এখনো খেলেন, ফ্লুমিনেন্সের হয়ে; একের পর এক সার্জারিতে গানসো নিজের ছায়াতেও বড্ড ম্লান!

গানসো এবং নেইমার; একে অপরের বন্ধু। এই জুটি সান্তোসে একসাথে বেড়ে উঠেছেন, মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে বন্ধুত্বের ছাপ রেখেছেন। "তারা এখন কোথায়" শীর্ষক আর্টিকেলের প্রকৃত উদাহরণ হতে পারেন এই জুটি।

ব্রাজিলের বিখ্যাত খেলোয়াড় তোস্তাও বলেন - আমি এখনো গানসো'র প্রাইম ভার্শন মিস করি। গানসো'র পিক সময়ে, 'টক অফ দা ব্রাজিল' ছিলেন গানসো। সেই সময়ে গানসো'র ফুটবল শৈলি এতটাই উঁচুমানের ছিলো যে অনেকেই বলে বসতো - এই ছেলে স্ট্রিট ফুটবলের জন্য নয়। গানসো যখন স্টেট চ্যাম্পিয়নশীপে খেলতো দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এতটাই থাকতো যেনো পেলে, গারিঞ্চা আজ মাঠে আবার নতুন যৌবনে মাঠে নামবেন। গানসো ছিলো সাম্বা ফুটবলের প্রতিচ্ছবি, যারা হৃদয়ে সাম্বা সৌন্দর্য ধারণ করতেন তাদের কাছে বিলাসব্যসন।

"সে জিনিয়াস; আমি সবসময় বলি গানসো একদিন জিদান ২.০ হবে" - সান্তোস টিমমেইট, সান্তোসের নাম্বার ১০ নিয়ে গ্লোবো টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন নেইমার।

২০১০ বিশ্বকাপের আগে নেইমার-গানসো জুটির দিপ্তীমান পার্ফরম্যান্সের ঝলসানিতে, তৎকালীন ব্রাজিল কোচ দুঙ্গাকে অনেক মিডিয়াই দুজনকে দলে নেওয়ার জন্যে চাপ দিয়েছিলেন। যদিও তা না হলেও, বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পরে ব্রাজিল দলে যে আমুল পরিবর্তন এনেছিলেন নতুন কোচ মানো মেনেজেস তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন এই দুই তারকা - নেইমার ও গানসো।

যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অভিষেকের পরেই হাঁটুর ইঞ্জরি বেশ ক'মাসের জন্যে মাঠের বাইরে চলে যান তিনি; কে জানতো এই ইঞ্জুরি ছিলো গানসোর দুর্ভাগ্যের পূর্বাভাস, ক্যারিয়ার জুড়েই ইঞ্জুরি আর ফিটনেসের সাথে লড়াই করতে হয়েছে গানসো'কে।

গানসোর সান্তোস সতীর্থ নেইমার, দানিলো, সান্দ্রো পরের বছরগুলোতে ইউরোপে পাড়ি দিলেও, গানসোর আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া হয়নি তখনো। ২০১২ তে সাও পাওলোতে যান তিনি, সেখানেও লুকাস মাওরাকে প্যারিসে, উইলিটন'কে রাশিয়ায়, সৌজা কে তুরস্কে পাড়ি জমাতে দেখেন তিনি। সাও পাওলোতে তিনি পাতো'র সাথে খেলেছেন, আরো খেলেছেন লুইস ফ্যাবিয়ানো, মাইকেল বাস্তোস, কাকা'র মতো খেলোয়াড়দের সাথে। কিন্তু গানসো'র ইউরোপে যেতে লেগে যায় আরো বেশ কিছু সময়! গানসো'র বয়স যখন ২৬, সেইসময় সেভিয়া তাকে দলে নেয়ার রিস্ক নেয়।

কেনো "রিস্ক" বলছি, কেনো অমীয় প্রতিভার পরেও, কেনো তাকে দলে নিতে ইউরোপের অনেক ক্লাবের আগ্রহ থাকলেও, আটলান্টিক পাড়ি দিতে গানসোর লেগে যায় এতটা সময়!? এসবের উত্তরই গানসো'র ক্যারিয়ারের প্রতিচ্ছবি , গানসো'র হারিয়ে যাওয়ার কারণ!

গানসো'র সেভিয়া অধ্যায়ে তাকানো যাক; স্পেনে পৌঁছেই লালীগার আবহ পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে যুদ্ধ করতে হয় তাকে। জর্জে সাম্পাওলির বিশেষ অনুরোধ  ৯ মিলিয়নের বিনিময়ে তাকে দলে ভেড়ায় সেভিয়া।

একজন জাদুকর যখন মঞ্চে তার জাদু দেখানো শেষ করে, দর্শক তখনো তাকে আরো জাদু দেখতে মিনতি করে। মাঠে ছোটখাটো শৈলী, প্রতিপক্ষের ডিফেন্স এরিয়ায় একটুখানি কারিকুরি সবকিছু থাকলেও সেভিয়ার দরকার ছিলো আরো বেশিকিছু, যা দলকে সুবিধা দিবে, মাঠে দলকে জেতাবে। কিন্তু গানসো পারছিলেন না; মাঠে দৌড়াতেন না, বলের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বল হারিয়ে ফেলতেন, ভুলে ভরা পাসে খেলা নস্ট করতেন! গানসো যখনই নিজের রুপে ফিরেছেন, তখনই ইঞ্জুরিতে আক্রান্ত হয়ে ছন্দ হারিয়েছেন! তাই সাম্পাওলি ক্লাব ছাড়ার পরে, গানসোর'ও আর থাকা হয়নি, লোনে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের আমিয়েনে!

সাবেক সান্তোস প্রেসিডেন্ট লুইস আলভারো ডি অলিভেইরা রিবেইরো তার অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছিলেন - নেইমার ছিলো শ্যাম্পেইনের মতো, আর গানসো ওয়াইন, পার্টি বা ডিনারের জন্যে দুইটাই গুরুত্বপূর্ণ!  সময়ের সাথে নেইমার যেখানে গ্লোবাল ব্র‍্যান্ডে পরিণত হয়েছে, গানসো রয়ে গেছে প্রদীপের বিপরীতে!  

গানসোর সর্বোচ্চটুকু ছিলো সেই শুরুর দিকেই, লিবার্তোদোরেসে, কোপা দো ব্রাজিলে। ব্রাজিলের হয়ে একটা কোপা আমেরিকা'ও খেলেছিলেন, গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচের পরে ইকুয়েডরের কোচ বলেছিলেন - নেইমারের পায়ে বল থাকলে ভয় নেই, কিন্তু নেইমারের পাস কোনোভাবেই গানসো'র কাছে পৌছালেই তা ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়! কিন্তু ব্রাজিল বরাবরই তাদের ১০ নাম্বার খেলোয়াড়কে দিয়েই আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছিলো।

কথায় আছে সকালের সুর্যই নাকি সারাদিনের পূর্বাভাস; কিন্তু গানসো'র বেলায় তা উলটো  সময় গড়িয়েছে, গানসো হারিয়ে গিয়েছে। যেনো জ্বলে উঠার আগেই স্তিমিত হয়ে যাওয়া।

গানসো'র কথা মনে হলেই মাথায় আসে, যদি ২০১০/১১ কিংবা তার আগে গানসো কে ধরে রাখা যেতো! গানসো এখন ফ্লুমিনেন্সে খেলছেন, ৩১ বছর বয়সী এই খেলোয়াড়কে মাঠে দেখলেই আফসোস হয়! বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে কাটানো, দু পায়ের মাঝ দিয়ে বল কাটানো, দূরপাল্লার শটে গোলের চেস্টা; এখনকার ফুটবলে এলিট কোচেরা ব্যাক্তিগত ফুটবল শৈলির চেয়ে দলগত ফুটবল শৈলির দিকেই অধিক নজর দেন, যেখানে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি কখনোই গানসো!

প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে, হারিয়ে যাওয়া, ব্রাজিল ফুটবলের নিয়মিত দৃশ্য! খেলোয়াড়দের ঝড়ে পড়া সেলেসাওদের সবচেয়ে বড় সমস্যা! গানসো, পাতো, এন্ডারসন, আরো কত কত! ভবিষ্যতেও হয়তোবা "কোথায় হারিয়ে গেলেন তিনি" নামক শিরোনামে না জানি আরো কত নামে প্রবন্ধ লেখা যাবে, তা হয়তো কেবল বিধাতাই জানে!