ভিরাটের শততম টেস্ট
পোস্টটি ৭৪৫ বার পঠিত হয়েছেওহ মাই গড! আমার নিজের কাছেই বিশ্বাস হচ্ছে না। কী অসম্ভব একটা ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। এ-ক-শো টেস্ট কোনো চাট্টিখানি কথা না, কতগুলো দিন, কত বছর, আনন্দ-বেদনার কত বিমূর্ত ক্ষণ পেরিয়ে এই পর্যায়ে এসেছি। মনেই হচ্ছে না এত এত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়ে গেছে আমার। উঁহু, কক্ষনো কল্পনাও করিনি একশো টেস্ট খেলবো, রোমাঞ্চিত হবো এভাবে। এখনো ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। দীর্ঘ একটা সফর। আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ যে, এত লম্বা সময় এই পথচলায় যাত্রী হতে পেরেছি। মহান দয়াময় নিশ্চয় দয়ালু ছিলেন আমার প্রতি। একইসঙ্গে এটাও ধ্রুব সত্য, এই যাত্রা অব্যহত রাখতে আমার প্রচেষ্টাও কম ছিল না। অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের মূল্য বলা যায় এটাকে। আমার ফিটনেস ও স্কিল নিয়ে প্রচুর কাজ করেছি। আমার পরিবার, কোচ সকলেই অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। দেশের হয়ে শততম টেস্ট খেলার এই অর্জন কেবল আমার একার নয়, আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, সুহৃদ ও ভক্তকূলেরও। ওদের সহযোগিতা ও সমর্থন ছাড়া এই পর্যায়ে পৌঁছা আমার পক্ষে কঠিন হতো।
এই লম্বা জার্নিতে বহু মণিমাণিক্য জীবন অভিজ্ঞতার ঝুলিতে পুরেছি। নানান রঙের ধূসর বা রঙিন সময় কাটিয়েছি। বহু সময় আমাকে ঋদ্ধ করেছে। পোক্ত করেছে। সমৃদ্ধ করেছে। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটার কথা মনে পড়ে, অস্ট্রেলিয়ায় পুরো দলের ব্যর্থ এক সফর ছিল সেটা। দ্রাবিড়ের দেয়ালে ফাটলের চিহ্ন, শচীনের অর্কেস্ট্রা সুরহীন, লক্ষণ-স্পেশালের দেখা নেই, সেই দুর্যোগে, দুর্দিনে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা পাই। ঝলমলে ওডিআই ক্যারিয়ারটা অফুরান আনন্দ দিলেও ঠিক স্বস্তি দিচ্ছিল না। এই সেঞ্চুরিটা আমাকে স্বস্তি দেয়। সাহসী করে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। তরুণ একজন ব্যাটসম্যানের জন্য অস্ট্রেলিয়ার মাঠে, ওদের দুরন্ত আক্রমণ সামলে, দলের দুঃসময়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করা, সেঞ্চুরি পাওয়া, কি অসাধারণ অর্জন ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। খেয়াল করলে দেখবেন, এই সেঞ্চুরিটা আমাকে আরো দুর্বার আরো ক্ষুরধার হতে সাহায্য করেছে। প্রসঙ্গত বলে নিই, আমার টেস্ট অধিনায়কত্বের শুরুটাও অস্ট্রেলিয়াতেই।
নেতৃত্বের প্রথম দিন থেকেই আমি আমার সর্বস্ব উজার করে দিয়েছি। টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে ক্রিকেটের শুদ্ধতম ও সুন্দরতম আঙিনা। এই ফরম্যাট বনেদী ও অভিজাত। শুরু থেকেই আমি চেয়েছি, টেস্ট ক্রিকেট হবে মানুষের সবচেয়ে পছন্দের ফরম্যাট। মানুষ সবচেয়ে বেশি দেখতে চাইবে এই খেলা। ছোট ছোট ছেলেপিলেরা এই অঙ্গনের মর্যাদা মাথায় রেখে, টেস্ট ক্যাপের স্বপ্ন বুনবে, চোখে আঁকবে টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার বাসনা। আমার নেতৃত্বাধীন যে দলটা দেখতে পায় মানুষ, আমি একদম সেভাবেই টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে আমার স্বপ্ন-চিন্তা-পরিকল্পনা যদি কাঠামো পায়, তাহলে তা এইরকমই হবে। ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুসজ্জিত অঙ্গন হচ্ছে টেস্ট ক্রিকেট। শতভাগ নিবেদন, উজার করা পরিশ্রম ও প্রতিনিয়ত নিজের দক্ষতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার মানসিকতা নিয়েই টেস্টের জন্য তৈরী করতে হয় নিজেকে। গোটা একটা দলকে নিজের এই বিশ্বাসে গড়ে তোলা সহজ কম্ম নয়, বহু পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও ক্লান্তিকর সময়ের মিলিত ফসলই আপনাকে দেবে দুর্দান্ত, দুর্বার ও দুর্জেয় একটি টেস্ট দল। আমার সৌভাগ্য যে, চমৎকার কিছু বন্ধু, সতীর্থ ও সহকর্মী পেয়েছি। যাদের নিয়ে পরিবেশ বদলানোর কাজটা সহজ হয়েছে। খুব কম মানুষই এইরকম সৌভাগ্যবান হয়, যারা গোটা একটা প্রজন্মকে, একটা সংস্কৃতিকে বদলে দেয়ার সুযোগ ও সম্মান লাভ করেন। আমি সত্যিই ভাগ্যবান, আমি সেই বিরলপ্রজ মানুষদের একজন হয়েছি।
দায়িত্ব নেয়ার সময় আমি ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম দলটা ঠিক সেভাবেই গড়ে তুলতে পেরেছি। এটা আমার কাছে অত্যন্ত তৃপ্তি ও আনন্দদায়ক ব্যাপার। টানা পাঁচটি বছর বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে বছর শেষ করেছি। সবচেয়ে বড় কথা এই দলটা ভয় কাকে বলে জানে না। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো শক্তির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। জড়তাহীন, অস্বস্তি নেই। ভয়ের তো প্রশ্নই উঠে না। ড্রেসিংরুমে বসে আমি যখন দলের আবহ বোঝার চেষ্টা করি, পরিবেশ ও সবার মানসিকতা উপলব্ধির চেষ্টা করি, আমি সন্তুষ্ট হই। নাহ, আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব বোধয় ভালোভাবেই পালন করতে পেরেছি। এই দলটার আত্মবিশ্বাস ও মানসিকতা বিশ্ববিজয়ী। একজন নেতার জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী চাই!
অধিনায়ক হিসেবে অর্জনের খাতা ভরপুর মনে হয়। কত কী পেয়েছি। সম্মান, সহযোগিতা ও ভালোবাসার কথা না হয় নাই বা বলি। কিন্তু ক্রিকেটীয় অর্জনই কি কম আছে? বহু কঠিন সময় পার করেছি। উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাই, জয়-পরাজয়, মান-অপমান, বিদ্রুপ-টিটকারি, রাগ-অনুরাগ, কষ্ট-দুঃখ-সুখ-গৌরব সব মেলানো মেশানো বলা চলে। পুরো এই দীর্ঘ সফরটাকেই ম্যাজিকেল ও রোমাঞ্চকর মনে হয়। তবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার মাঠেই ২-১ এ সিরিজ জয় অবিস্মরণীয় আমার কাছে। গত সিরিজ না, সেবার তো প্রথম টেস্টের পর আমি দলেই ছিলাম না। অজিঙ্কা দুর্দান্ত নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমি বলছি দুই হাজার উনিশ সনের কথা। প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জিতেছিলাম। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও ২-১ এ লিড নিয়ে দেশে ফিরেছি। একটা বা দুইটা সিরিজ উল্লেখ ঠিক হচ্ছে না যদিও, তবু পেছন ফিরে দেখলে এই সময়গুলোর জন্য আমি গর্বিত হই। আমার কাছে আরো স্মরণীয় ও গৌরবের ব্যাপার হচ্ছে, এই ধরণের জয় বা অর্জনকে আমরা আমাদের প্র্যাকটিসে পরিণত করতে পেরেছি। স্বাভাবিক বলে প্রমাণ করতে পেরেছি।
হ্যাঁ, এখন হয়তো আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব নেই। তারপরও এই দলটার জন্য আমি সবসময় সর্বস্ব ঢেলে দিতে প্রস্তুত। একযুগেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক আঙিনায় এই সফর আরো বহুদূর ও বহুদিন পর্যন্ত টেনে নেয়ার ইচ্ছে রাখি। এবং ক্রিকেট শুরুর প্রথম দিন যে বিষয় আমাকে অনুপ্রাণিত করত - স্বদেশের প্রতিনিধিত্ব করা। স্বদেশের জন্য সম্মান ও গৌরব বয়ে আনা। এখনো সেই বিষয়টাই আমার মূল ও মূখ্য। ক্রিকেট খেলাটাকে এখনো সেই পুঁচকে ভিরাটের মতো ভালোবাসি। ক্রিকেট আমার প্যাশন। আমার স্বস্তির জায়গা। ভারতের জন্য আমি নিজেকে নিংড়ে দিতে চাই ক্রিকেটের সবুজ উদ্যানে। আরো রান, আরো জয়, আরো ট্রফি চাই আমার।
একশোতম টেস্ট একটা মাইলফলক, একটা অর্জন। তবে নিছক সংখ্যামাত্র। স্বীকার করে নিতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, আমি কস্মিনকালেও কল্পনা করিনি ভারতের হয়ে আমার জার্নি এত দীর্ঘ হবে। একশো টেস্ট খেলার সম্মান পাবো। তবে আমার মনে আছে, বহু বছর আগে আমি নিজেকে নিজেই বলতাম, ভারতের হয়ে যা যা অর্জন করা সম্ভব সমস্তই আমার চাই। যত উঁচুতে উঠা সম্ভব সেই উচ্চতাকে চাই আমার পায়ের নীচে। কোনো কিছুই আমাকে আমার লক্ষ্য থেকে সরাতে পারবে না। আমার স্বপ্ন থেকে হটাতে পারবে না। ক্রিকেট শৃঙ্গের সুউচ্চ চূড়াটাও চাই আমার হাতের মুঠোয়। আমার স্বপ্ন তাড়া করার রঙিন জার্নি চলছে, জানি চলবে। আর জীবনের অনিশ্চয়তার সৌন্দর্য অবাক করার মতো একটি ব্যাপার। ভবিষ্যতে কি হবে কেউ জানি না। কত অসম্ভব ও অসাধারণ ব্যাপার ভবিষ্যৎ লুকিয়ে রেখেছে কে জানে। ওসব মাথায় নিয়ে কাজ নেই। আমি আমার কাজটা ঠিকঠাক করে যেতে চাই। ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে নিজের কাজটা যথাযথ ভাবে করে গেলে সাফল্য আপনাতেই লূটিয়ে পড়ে। আমাকেই উজ্জ্বলতম উদাহরণ হিসেবে নিতে পারেন।
এই যে মানুষ আপনাকে মনে রাখছে, আপনার অর্জনকে উদযাপন করছে, আপনাকে সম্মান ও ভালোবাসা দিচ্ছে; এও কী কম সফলতা? এক জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী লাগে আসলে!
- 0 মন্তব্য