শেন ওয়ার্ন, বিদায়!
পোস্টটি ১৯০৪ বার পঠিত হয়েছে
গতকাল ছিল আইরিশ ক্রিকেটার কেভিন ও' ব্রায়েনের জন্ম দিবস। তাকে নিয়ে একটা লেখা লিখলাম। লেখা এবং লেখা পরবর্তী সাজসজ্জা করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। দুপুরের দিকে লেখাটা সাবমিট করলাম প্যাভিলিয়নে। সন্ধ্যার দিকে খবরটা পেলাম যে, শেন ওয়ার্ন প্রয়াত হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই খুব স্বাভাবিক লাগেনি শুনে। মানুষ মরণশীল, সবাইকে চলে যেতে হয়। এসব জানবার পরেও। কত আর বয়স ছিল! আলোচনা করছিলাম যেখানে আমি থাকি, সেখানের লোকজনের সাথে। পরে দেখা গেল, মাত্র ৫২ বছর হয়েছিল বয়স। প্রথমেই মাথায় আসলো, হয়তো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া, হার্ট এটাক এই ধরনের কিছুই দেখবো নিউজে। মাথায় আসলো দিয়েগো ম্যারাডোনার কথাও। আরো লতা মঙ্গেশকরদের কথা। মৃত্যু জিনিস তো! কারো সাথে গানে সম্পর্ক, কারো সাথে খেলায়। মানুষ কষ্ট পায়। স্বাভাবিকভাবে কয়েকদিন পর সেই কষ্ট চলেও যায়, এরকমই হবার কথা।
তো এক ক্রিকেটারের জন্ম দিবস উপলক্ষে লিখতে না লিখতেই, অন্য আরেক ক্রিকেটারের মৃত্যু সংবাদ শোনা। একই দিনে, ৪ মার্চ। এমন করেই বোধহয় জীবনের আশ্চর্য ঘটনাগুলি ঘটে। আশ্চর্য কিন্ত বাস্তব।
গতরাতেই শেন ওয়ার্নের কিছু ডেলিভারি দেখলাম ইউটিউবে। মানুষ কমেন্ট করে যাচ্ছে সেসব ভিডিওতে। তাদের শোক প্রকাশ করছে, এবং তারা যে এই ঘটনা বিশ্বাস করতে পারছেনা, সেসব লিখছে। দেখছিলাম। পরে ওয়ার্ন-কে নিয়ে আরো কিছু তথ্য কি পাওয়া যায় দেখলাম। জানা-অজানা অনেক কিছুই পেলাম সত্যি বলতে। শেন ওয়ার্ন তার জীবন কাটিয়েছেন বোধহয় কিছুটা নিজের মতো উপভোগ আর উদযাপন করে। মাঝেমধ্যে অবশ্য অযাচিত অনেক কর্মকান্ড তার ছিল, যেসব নিয়ে অনেক বিতর্ক-প্রশ্নের জন্মও তিনি দিয়েছেন। মানুষ হিসেবে পূর্ণ স্বাধীনতা সে পেতে চাইতেন হয়তো নিজের কর্মকান্ডে। সে যাইহোক।
শেন ওয়ার্ন; জানা-অজানা
ছোটবেলায় শেন ওয়ার্ন ছিলেন ইস্ট স্যান্ড্রিংহাম ক্রিকেট ক্লাবে। সেখানে ওয়ার্নকে লেগ-ব্রেক বল করতে ইন্সট্রাকশন দেওয়া হতো। ওয়ার্ন খুব কম বলই সেসময় পিচ করতে পারতেন। তখন তিনি ব্যাট করতে পছন্দ করতেন।
১৯৯১/১৯৯২ সালে ভারত অস্ট্রেলিয়া সফর করে। সেই সিরিজের তৃতীয় টেস্টে শেন ওয়ার্নের ডেব্যু হয়। ডেব্যুকালীন সময়ে ওয়ার্নের ওজন ছিল ৯৭ কেজি।
কলম্বোতে, শ্রীলঙ্কা ৭ উইকেটে ১৫০ রানে, এই অবস্থায় অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার তার তরুণ লেগ স্পিনারের কাছে বল তুলে দেন। শেন ওয়ার্নের বোলিং রেকর্ড তখন, ৯৩ ওভারে ৩৪৬ রান দিয়ে ১ উইকেট। কি সাহসী সিদ্ধান্তই না নিলেন সেদিন বোর্ডার! বাকি ৩ উইকেট নিয়ে নেন ওয়ার্ন দ্রুতই। শ্রীলঙ্কা অলআউট। অস্ট্রেলিয়া জয় পায় ১৬ রানে।
One of the famous quotes of Shane Warne was: Part of the art of bowling spin is to make the batsman think something special is happening when it is not.
শেন ওয়ার্ন মনে করতেন, মূলত ব্যাটসম্যানরা কম্বিনেশন নিয়ে চিন্তিত, বোলাররা নয়। আর তার যেকোনো রহস্যময় ডেলিভারি আবিষ্কার হতো অ্যাশেজ সিরিজের আগে। এবং অ্যাশেজে তিনি সেই ডেলিভারি কাজে লাগাতেন।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি টেস্টে অ্যান্ড্রু জোনস-কে এলবিডব্লিউ করার আগে শেন ওয়ার্ন আম্পায়ার স্টিভ ডান- এর দিকে তাকিয়ে হাসি ফ্ল্যাশ করেন এবং বলেন: THIS IS THE ONE এবং সেই বলেই জোনস ফেরেন এলবিডব্লিউ হয়ে।
শেন ওয়ার্ন স্লেজিং করতেন বিশদভাবেই।
তিনি নাসির হুসাইনকে সাদ্দাম বলে সম্বোধন করতেন, গ্রাহাম গুচকে মিস্টার গুচ বলে। আবার তিনি এও জানতেন কোথায় তাকে থামতে হবে। শচীন টেন্ডুলকারকে খুব কমই কিছু বলেছেন।
একবার সৌরভ গাঙ্গুলী হাফ-ভলি বলে রক্ষণাত্মকভাবে প্যাড করছিলেন। শেন ওয়ার্ন তার দিকে এগিয়ে গিয়ে, অন্য প্রান্তে শচীনের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, লোকে তার (গাঙ্গুলীর) স্ট্রোক দেখতে এসছে, তার ব্লক দেখতে নয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই গাঙ্গুলী স্টেপ আউট করে বের হয়ে যান, এবং বল মিস রিড করে স্টাম্পড আউট হয়ে ফেরেন।
সবচেয়ে কম রানআপে তিনি যে পরিমান টর্ক পেয়েছিলেন তা অবিশ্বাস্য। বল যেদিকে ঘোরে, তার বিপরীত দিকে প্রবাহের জন্ম দেওয়া, যা ফিজিক্সের ভাষায় ম্যাগনাস ইফেক্ট, তাই করতেন ওয়ার্ন। প্রায়শই ব্যাটসম্যানরা তাদের পা প্রসারিত করে দিতেন ওয়ার্নের বলের সামনে, তারপরেও এর প্রবাহিত ক্ষমতা এত বেশি যে, তা আরো চওড়া হয়ে ঠিকই জায়গা খুঁজে নিত স্ট্যাম্প ভাঙ্গার জন্য।
তার এসব কারবারের জন্য অবশ্যই তিনি পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। তার প্রতিটা ডেলিভারির জন্য ছিল পরিকল্পনা। স্ট্রাউস যেমন বলেছেন, ওয়ার্ন একটি বল করার আগে পুরো ওভারের পরিকল্পনা করেছিলেন। এমনকি যদি একজন ব্যাটসম্যান মাইন্ড-গেম থেকে উতরেও যায়, তাকে আউট করার জন্য পদ্ধতিগত পরিকল্পনা ওয়ার্নের ছিল। ওয়ার্ন চিন্তা করতেননা বল কোথায় পিচ করবে বা কোনদিকে ঘুরবে। ব্যাটসম্যান কোন ধরনের স্ট্রক খেলতে চায়, কিভাবে সেই বল তার স্ট্রোকে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে, সে সম্পর্কে তিনি ভাবতেন।
শেন ওয়ার্ন কখনোই ফিটনেস ড্রিল নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না। ইয়ান চ্যাপেল একটি গল্প বলেন, একটা ম্যাচের আগে ওয়ার্ন তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, কেন আমরা এই ষ্টুপিড ৪৫ মিনিটের ফিল্ডিং অনুশীলন করছি? আমার যা দরকার তা হল নেটে কয়েকটি বল করা এবং তারপরে ড্রেসিংরুমে বসে স্মোক করা, চা খাওয়া এবং আজকে যে ছেলেদের বল করতে হবে তাদের কথা ভাবা।
একদা গ্যাবা টেস্টের সময়, ব্রিসবেন লায়ন্স থেকে অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবলাররা ভিজিটে এসেছিলেন, সেসময় ওয়ার্ন একটি বিয়ার ধরে ছিলেন, এক কোণে বসেছিলেন, তার হাঁটুতে একটি বরফের প্যাক রেখেছিলেন এবং কথা বলার সময় তিনি ধূমপান করছিলেন।
২০১১ বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ড বনাম ইন্ডিয়া ম্যাচের আগে শেন ওয়ার্ন একটা টুইট করলেন। লিখলেন, এই ম্যাচে তার প্রেডিকশন, ম্যাচটা টাই হতে যাচ্ছে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেই ম্যাচ টাই হয়। পরবর্তীতে ওয়ার্নের টুইট বেশ হৈচৈ ফেলে। ফক্স স্পোর্টস সেসময় শিরোনাম করেছিল, জিনিয়াস নাকি ফিক্সার!
শেন ওয়ার্নের বেশ কিছু বিতর্ক এবং অপছন্দনীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা
১৯৯৪ সালে করাচি টেস্টের একটা ঘটনা। পাকিস্তান অধিনায়ক সেলিম মালিকের দ্বারা প্রলুব্ধ হবার একটা কথা শোনা যায়। যেটা শেন ওয়ার্ন নিজেই প্রকাশ করেছিলেন পরে। যেখানে ওয়ার্ন এবং অস্ট্রেলিয়ান স্পিনার টিম মে- কে অফ স্টাম্পের বাইরে বল করবার জন্য সেলিম মালিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবার জন্য আহবান জানানো হয়েছিল। যদিও ওয়ার্ন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলে দাবি করেন এবং সেলিম মালিক দাবি করেন ওয়ার্নের বক্তব্য মিথ্যা।
২০০০ সালের দিকে শেন ওয়ার্ন স্টিভ ওয়াহ’র ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ পান। সেই সময় তিনি লেস্টার হলিডে ইন থেকে ডোনা রাইট নামে এক ২২ বছর বয়সী নার্স-কে মাতাল শব্দে ভয়েস মেসেজ পাঠান। ডেইলি মিরর সেসময় শিরোনাম করেছিল ‘SHAME WARNE’, এসব ব্যাপারে সাধারণ জনগণ কিছুদিন পর ভুলে গেলেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বেশ গুরুতরভাবেই নিয়েছিল। ওয়ার্ন যদিও বলেছিল, তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয় মাঠের কোনো কিছুকে অসুবিধা করছেনা। কিন্ত পরে তাকে সহ-অধিনায়ক থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করবার পর শেন ওয়ার্নের আরো কিছু অনুচিত কর্মকান্ড বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালের শুরুর দিকে, ওয়ার্নকে ৪৫০০ মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয় এবং একটি ম্যাচ নিষিদ্ধ করা হয়, অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের জন্য, মারলন স্যামুয়েলসের সাথে মাঠের মধ্যে বিতণ্ডায় জড়ানোর জন্য এবং বিগ ব্যাশের একটি ম্যাচ চলাকালীন আম্পায়ায়ের সিদ্ধান্তে গুরুতর ভিন্নমত দেখানোর জন্য।
আরো বিভিন্ন বিতর্কের সাথেই ওয়ার্নের পরিচয় হয়েছিল, তাতে হয়েছে নানারকম অভিজ্ঞতাও। কেউ কেউ মনে করেন, এক জীবনে মানুষের যত ধরনের অভিজ্ঞতা সম্ভব, ভালো কি মন্দ, তার মধ্যে দিয়ে যাওয়া উচিত। কেনো উচিত জানা নাই। হয়তো কিছু নতুন জ্ঞানের সঞ্চার ঘটে তাতে।
যাকগে সেসব। সব অভিজ্ঞতা, সব বিতর্কের ঊর্ধ্বেই তো তিনি এখন উঠে গেলেন। মৃত্যু! সব কিছু জানিয়ে দিয়ে যায়। আমরা যখন সবকিছু ভুলে বসে থাকি, সব সত্য, তখন এসব ঘটনা আমাদের সামনে আসে। বলে, একটু থামো, একটু ভাবো, জীবনটাকে আরেকটু দেখে-শুনে, এরপর আবার চলো, একদিন তো থামবেই এই যাত্রা।
শেন ওয়ার্ন, বিদায়!
নামঃ শেন কিথ ওয়ার্ন
জন্মঃ ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯
মৃত্যুঃ ০৪ মার্চ, ২০২২
তথ্যসূত্র: https://www.cricketcountry.com
Article of Arunabha Sengupta,
He is a cricket historian and chief cricket writer at Cricket Country.
- 0 মন্তব্য