ছয় গজের প্রহরীদের কথা
পোস্টটি ১৬১৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
“In my teams, the goalie is the first attacker.”
-জোহান ক্রুইফ।
যদি আপনার প্রিয় দলটি একটি ম্যাচ জেতে, সর্বপ্রথম কার প্রশংসা করেন আপনি? হয়তো সেই স্ট্রাইকারটির, যে কি না গোল স্কোর করেছে এক বা একাধিক, নয়তো কোনো মিডফিল্ডার বা উইঙ্গার যারা চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিং আর রোমাঞ্চকর পাসের পর পাসের পসরা সাজিয়ে অ্যাসিস্ট, বিগ চান্স ক্রিয়েশন বা কী-পাসের মাধ্যমে আপনার দলের জয়ের আশা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে বারবার। এরপর লিস্টে নাম আসবে ডিফেন্ডারদেরও, প্রতিপক্ষ দলের আক্রমণকারীদের যারা কড়া পাহারা দিয়ে রেখেছে, ট্যাকল আর ইন্টারসেপশনের মাধ্যমে তটস্থ করে রেখেছে সারাক্ষণ সবাইকে। সবার শেষে আপনার মনে পড়বে গোলকিপারটির কথা, যে কি না ফুটবল মাঠের সবচেয়ে নিচের দিকের ঐ ছয় গজ পাহারা দিয়ে রেখেছে সর্বক্ষণ। সবার আগেও মনে পড়তে পারে, যদি সেই ম্যাচটি টাইব্রেকারে গড়ায় এবং আপনার দলের গোলকিপার বেশকিছু শট ঠেকিয়ে দেয়। অথবা ম্যাচের মাঝেও পেনাল্টি শট ঠেকালে আপনি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। কিন্তু এছাড়া?
না না, ফুটবলে গোলরক্ষকের পজিশন এতটাও অন্যায়ের মুখোমুখি হয় না। আধুনিক যুগের ফুটবলে প্রতিটা পজিশনই গুরুত্বপূর্ণ, আর যারা পুরো ৯০ মিনিট আর অতিরিক্ত সময়ে ঐ ছয় গজকে পাহারা দিয়ে রাখে, প্রয়োজনে নিজের দুই হাতকে পরিণত করে দশ হাতে-তাদের অবস্থান তো অবশ্যই! হয়তো টিমের এগারোজন খেলোয়াড়ের মধ্যে সবচেয়ে কম মুভমেন্ট তাদের, কিন্তু একটা ম্যাচের জয় নিশ্চিত করতে তাদেরই সবচেয়ে বেশি দক্ষ হবার প্রয়োজন। সে কারণেই হয়তো বা যখন তাদের দ্বারা কোনো ভুল হয়ে যায়, ভুগতে হয় পুরো দলকে, গোটা ম্যাচজুড়ে। তবে পাথরের দেয়ালে পরিণত হয়ে নিজের গোলপোস্টকে অভেদ্য দুর্গের মত রক্ষা করা তাদের প্রধান লক্ষ্য হলেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে তারা নিজেদের আরো হালনাগাদ করে নিয়েছেন, ছয় গজের জগতটা ছেড়ে ইনভলভড হচ্ছেন অপনেন্ট এটাক নষ্ট করে দিতে বা অপনেন্টের বাড়ানো বল সুইপ করে বিপদ কাটাতে বা টিমমেটদের অ্যাকুরেট পাস দিয়ে খেলাকে আরো গতিময় আর সুন্দর করে তোলায়।
আজ কথা বলব সেই ছয় গজের প্রহরীদের প্রকারভেদ এবং উদাহরণ দিয়ে, যারা সব যুগেই নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করে নিজেদের পজিশনকে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসে, ফুটবল-অনুরাগীদের হৃদয়ে। প্রাথমিকভাবে, কাজের আর মুভমেন্টের ওপর ভিত্তি করে আমরা ফুটবলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই পজিশনকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করতে পারিঃ
১। লাইন কিপারঃ
এধরণের গোলকিপারদের প্রধান লক্ষ্য একটাই-প্রতিপক্ষের শট ঠেকানো। এজন্য এদের শট-স্টপার বলেই সাধারণত সম্বোধন করা হয়। শট ঠেকাতে তারা বিভিন্ন অ্যাক্রোবেটিক সেভ করেন, উঁচুতে লাফিয়ে বা ডানে-বাঁয়ে ডাইভ দিয়ে। এ কারণে শটের ডিরেকশন অ্যান্টিসিপেট করার ক্ষমতা তাদের অনেক বেশি হয়ে থাকে। অসাধারণ ফ্লেক্সিবিলিটি, দু’হাত ও চোখের মধ্যকার দ্রুত প্রতিবর্তী ক্রিয়া এবং অ্যাথলেটিজমই তাদের প্রধান দক্ষতা। তবে তাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র শট ঠেকানো হবার কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের হাই টেকনিক্যাল অ্যাবিলিটি, রেগুলার গোল কিকের বাইরে অন্যান্য পাসিং অ্যাবিলিটি বা বক্সের বাইরে এসে অপনেন্ট এটাক ভেস্তে দেয়ার দক্ষতা থাকে না। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো তাদের দুর্বলতা মনে হলেও নিজেদের দক্ষতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সহজেই নিজেদের দুর্বলতাকে ঢেকে দিতে সক্ষম তারা।
উল্লেখযোগ্য কয়েকজন লাইনকিপার: ডেভিড ডি গিয়া (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), জ্যান অবলাক (আতলেতিকো মাদ্রিদ), এমিলিয়ানো মার্টিনেজ (অ্যাস্টন ভিলা), ইকার ক্যাসিয়াস (রিয়াল মাদ্রিদ), জিয়ানলুইজি বুফন (জুভেন্টাস)।
২। বল-প্লেয়িং কিপারঃ
শট-স্টপারদেরই এক আধুনিক ভার্সন হল বল-প্লেয়িং কিপার। এদের শুধু হাই শট-স্টপিং বা সেভিং অ্যাবিলিটিই নেই, তার সাথে সাথে এদের আছে বেশ প্রশস্ত পাসিং রেঞ্জ, যার ফলে এরা সহজেই টিমের অফেন্সিভ বিল্ড-আপে ভূমিকা রাখতে পারেন। বর্তমান যুগের ফাস্ট-পেসিং অর্থাৎ গতিময় ফুটবলে একজন বল-প্লেয়িং কিপার বা একটা এক্সট্রা পাসিং আউটলেট থাকা যেকোনো দলের জন্য অবশ্যই একটা প্লাস পয়েন্ট। এছাড়াও নিজেদের অর্ধে বলের দখল থাকার সময় ডিফেন্ডারদের যখন প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকাররা প্রেস করেন, তখনও বল-প্লেয়িং কিপারদের ওপর ভরসা রেখে তাদের ব্যাকপাস করা তথা নিজেদের বলের পজেশন নিশ্চিত করা যেতেই পারে। এদের টেকনিক্যাল অ্যাবিলিটি শট স্টপারদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি।
উল্লেখযোগ্য কয়েকজন বল-প্লেয়িং গোলকিপার: মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগান (বার্সেলোনা), অ্যালিসন বেকার (লিভারপুল), এডারসন মোরায়েস (ম্যানচেস্টার সিটি), ভিক্টর ভালদেস (বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও অন্যান্য)।
৩। সুইপার কিপারঃ
সুইপার কিপারদের মূলত বল-প্লেয়িং কিপারদেরই এক ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। তবে বল-প্লেয়িং কিপার আর সুইপার কিপারদের মূল পার্থক্য হল তাদের বিচরণক্ষেত্র। সুইপার কিপাররা নিজেদের ঐ ছয় গজের ছোট বাক্স বা পেনাল্টি এরিয়ার মাঝেই বন্দী করে রাখেন না, বরং ডি-বক্সের বাইরেও তারা সহজেই তাদের কমফোর্ট জোন বানিয়ে নেন এবং বল রিসিভ করতে সামনে মুভ করতে পারেন, যার ফলে তাদের দলে ১১ বনাম ১০ সিচুয়েশন তথা একপ্রকার আউটফিল্ড নিউমেরিক্যাল সুপিরিয়রিটি তৈরী হয়।
শুধু অফেন্সিভ বিল্ড-আপেই নয়, সুইপাররা গেম রিডিং এবং বক্স থেকে বেরিয়ে প্রতিপক্ষের লং পাস ক্লিয়ারেন্সেও সর্বদা অ্যালার্ট থাকেন। তার মানে হাই শট-স্টপিং এক্সিলেন্সের পাশাপাশি তাদের প্রয়োজন হয় হাই টেকনিক্যাল অ্যাবিলিটি এবং ভালো মানের কম্পোজারও।
উল্লেখযোগ্য কয়েকজন সুইপার কিপার: ম্যানুয়েল নয়্যার (বায়ার্ন মিউনিখ), এডারসন মোরায়েস (ম্যানচেস্টার সিটি), লেভ ইয়াসিন।
যুগে যুগে গোলকিপাররা নিজেদের পজিশনের গুরুত্ব প্রমাণ করেছেন, যখনই তাদের দল কোনো সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে খালিচোখে নিতান্তই সাদামাটা গোলকিপার সার্জিও রোমেরো সেমিফাইনালে যেমন নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টাইব্রেকারে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে আর্জেন্টিনাকে তুলেছিলেন ফাইনালে, ২০২১ সালের কোপা আমেরিকায় এমিলিয়ানো মার্টিনেজও সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে নিজের মাইন্ড গেম আর অসাধারণ সেভিং অ্যাবিলিটি দিয়েও করেছিলেন একই কাজ, ফাইনালেও ধরে রেখেছিলেন পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা। ২০১৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লীগজয়ী ক্লাব লিভারপুলের অ্যালিসন বেকার, যিনি ২০১৯ ব্যালন ডি’অরের শীর্ষ দশের তালিকায় ছিলেন, তার তো গোল-অ্যাসিস্ট করার রেকর্ড পর্যন্ত আছে! ২০১৪ বিশ্বকাপে ম্যানুয়েল নয়্যারের অতিমানব হয়ে ওঠা বা টের স্টেগানের আবারও নিজেকে ধীরে ধীরে ভেঙে গড়ে তোলা-সবকিছুতেই আছে গোলকিপারদের সংগ্রাম, নিজেদের দলকে রক্ষার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। সবচেয়ে কঠিন পজিশনে খেলতে হয়, কিন্তু সবচেয়ে কম ক্ষমালাভ বা সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় এই দস্তানাধারী, ছয় গজের প্রহরীদের।
গত ১৪ই এপ্রিল ছিল আন্তর্জাতিক গোলরক্ষক দিবস। চলুন, এ দিবস উপলক্ষেই আমরা না হয় গোলকিপারদের গড়পড়তার চেয়ে একটু বেশিই শ্রদ্ধা জানাই, সাধুবাদ দেই নিজেদের দুর্গকে অভেদ্য রাখতে তাদের নিরন্তর প্রয়াসকে!
- 0 মন্তব্য