আর্সেনাল- বর্তমান আক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পোস্টটি ৮৮০ বার পঠিত হয়েছেযদি প্রিমিয়ার লীগের পয়েন্ট টেবিলের চতুর্থ স্থানে অথবা শীর্ষ চার স্থানে মৌসুম শেষ করার জন্য শিরোপা দেয়া হতো, তাহলে আর্সেনাল নিঃসন্দেহে গত দশকে অনেকগুলো শিরোপা জিতত। গানার্সরা সর্বশেষ প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা ঘরে তুলেছিল ২০০৩-০৪ মৌসুমে, যা আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে। কিংবদন্তি ম্যানেজার এবং অনেকের মতে ক্লাব ইতিহাসের সেরা ম্যানেজার আর্সেন ওয়েংগার এর সর্বশেষ মৌসুমগুলোতে আর্সেনালের মূল লক্ষ্যই ছিল প্রতি মৌসুমে লীগের পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ চারের মধ্যে থেকে নিয়মিত চ্যাম্পিয়নস লীগ ফুটবল খেলা। তবে ওয়েংগার এর বিদায়ের পর চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলাটাও গানারসদের জন্য যেন এক প্রকার সোনার হরিণ। আর্সেনাল সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলেছিল ২০১৭ সালে, এরপর ৫ বছর ধরে লীগের পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ চারের বাইরে থেকেই গানারসদের মৌসুম শেষ করতে হয়। এই মৌসুমে তো তারা ইউরোপিয়ান ফুটবল খেলার সুযোগই পায়নি।
গত মৌসুম দুঃস্বপ্নের মতো কাটানোর পরও আর্সেনাল বোর্ড ভরসা রেখেছিল ম্যানেজার মিকেল আরতেতার উপর। নিজের পছন্দমতো গ্রীষ্মকালীন দলবদলে আর্তেতা পেয়েছিল নুনো তাভারেস, লোকোনগা, ওডেগার্ড, রামসডেল, বেন হোয়াইট এবং টাকেহিরো টমিয়াসুর মতো তরুণ এবং উদীয়মান খেলোয়াড়কে। সামার ট্রান্সফার উইন্ডোতেই ১৪২ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে ৬ জন খেলোয়াড়কে কিনেছিল আর্সেনাল।
নতুন মৌসুমের শুরুটা যেন দুঃস্বপ্নের মতো পার করা গত সিজনের চাইতেও বাজে ছিল আর্সেনালের জন্য। শুরুর ম্যাচেই নব্য উত্তীর্ণ দল ব্রেন্টফোর্ড এর কাছে হেরে মৌসুম শুরু হয় আর্সেনালের। এরপর নগর প্রতিদ্বন্দ্বী চেলসি এবং ম্যানচেস্টার সিটি, দুই দলের কাছেই শোচনীয় পরাজয় বরণ করে আর্তেতার শিষ্যরা। ফলে ঐ সময়ে ৩ ম্যাচ পর পয়েন্ট টেবিলের ২০ নম্বর স্থানে অবস্থান করছিল আর্সেনাল। যা রীতিমতো লজ্জাজনক এবং অপ্রত্যাশিত ছিল।
তবে সেপ্টেম্বরের ইন্টারন্যাশনাল ব্রেকের পর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের সূচনা গানার্সদের, অবশ্য এটিকে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের শুরু না বলে বরং "ধারাবাহিকভাবে অধারাবাহিক" হওয়ার সূচনা বলা উচিৎ। কারণ আর্সেনালের পুরো মৌসুমকে দুই শব্দের এই বাক্য দিয়েই ব্যাখা করা সম্ভব। ইন্টারন্যাশনাল ব্রেকের পর প্রথম ম্যাচেই নরউইচ এর বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়, এরপরের ম্যাচে বার্নলিকে ১-০ গোলে হারানো, আর্তেতার শিষ্যরা এরপর প্রিমিয়ার লীগে টানা ৮ ম্যাচ অপরাজিত ছিল, যার মধ্যে ৬ ম্যাচেই তারা জিতেছিল।
প্রথম ৩ ম্যাচ পর ২০ এ থাকা আর্সেনাল পঞ্চম স্থানে থেকে এনফিল্ডে লিভারপুলের বিপক্ষে খেলতে গেল, ঐ ম্যাচে ৪-০ গোলে হেরেই আর্সেনালের অপরাজিত থাকার দৌড় শেষ হলো। ২০ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর, এই দুই সপ্তাহর ব্যবধানে আর্সেনাল ৪ ম্যাচের ৩ টি ম্যাচই হেরেছিল।
ফলে অনেকেই ধারণা করছিল বোধহয় আর্সেনালের ভালো ফর্মের দৌড় এখানেই শেষ, আবার আগের মতো অগোছালো হয়ে উঠেছে গানার্সরা।
ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল, এই ৪ মাসে আর্সেনাল প্রিমিয়ার লীগে ১৩ টি ম্যাচ খেলেছিল, যার মধ্যে ১০ টি ম্যাচই জিতেছিল। হেরেছিল শুধুমাত্র লিভারপুল এবং ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে। মার্চ মাসের ইন্টারন্যাশনাল ব্রেক এর আগে এস্টন ভিলাকে হারানোর পর পঞ্চম স্থানে থাকা টটেনহামের চাইতে এক ম্যাচ কম খেলেই ৩ পয়েন্ট এগিয়ে চতুর্থ স্থানে ছিল গানার্সরা। ঐ সময়ে ২৮ ম্যাচ খেলা গানার্সদের উপরই সবার বাজি ছিল যে তারা আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলবে। এমনকি আর্সেনাল ভক্তরাও তখন স্বপ্ন দেখছিল ৫ মৌসুম পর ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে তাদের প্রিয় ক্লাবকে দেখবে।
ছন্দপতনের শুরুটা মার্চের ইন্টারন্যাশনাল ব্রেকের পর থেকেই হলো। আনপ্রেডিক্টেবল হিসেবে পরিচিত আর্সেনাল অপ্রত্যাশিতভাবেই মধ্যম সারির ক্লাব সাউথাম্পটন, ক্রিস্টাল প্যালেস এবং ব্রাইটনের বিপক্ষে টানা ৩ ম্যাচ হারলো। ফলে আর্সেনালের টপ ফোর পাওয়ার সমীকরণ সহজ থেকে জটিলে পরিণত হলো।
তবে এর পরের ম্যাচগুলোতেই দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ালো আর্সেনাল। সাউথাম্পটন এর বিপক্ষে হারার পর টানা ৪ ম্যাচে জয় পেয়েছিল আর্সেনাল। যার মধ্যে ছিল টেবিলের শীর্ষ ৭ এ থাকা দল চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ওয়েস্ট হাম এর বিপক্ষে জয়।
পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে থাকা লিডসকে হারানোর পর আর্সেনালের সামনে আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলার সমীকরণ ছিল একদম সহজ, পরবর্তী ম্যাচে পঞ্চম স্থানে থাকা টটেনহামকে হারালেই মিলতো পরবর্তী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলার টিকিট।
এমন সহজ সুযোগ ফের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে আর্সেনাল। মৌসুমের শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে অধারাবাহিক আর্সেনাল পঞ্চম স্থানে থাকা টটেনহামের বিপক্ষে হারলো ৩-০ গোলে।
তবে টটেনহামের বিপক্ষে হারলেও সেই ম্যাচের পর তাদের থেকে ১ পয়েন্ট এগিয়ে ছিল আর্সেনাল। ফলে আর্সেনালের ভাগ্য তখনো নিজেদের হাতে ছিল, আগামী ২ ম্যাচে জয় পেলেই পেয়ে যেত চতুর্থ স্থান। তবে নিউক্যাসলের বিপক্ষে ২-০ গোলের হার এক প্রকার ভেস্তে দিয়েছে আর্সেনালের চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলার স্বপ্ন।
এখন গানার্সদের নিজেদের ভাগ্য আর নিজেদের হাতে নেই। এভারটনের বিপক্ষে মৌসুমের সর্বশেষ ম্যাচ জিতলেও আর্সেনালের তাকিয়ে থাকতে হবে টটেনহামের ম্যাচের দিকে। আর্সেনাল এভারটনকে হারানোর পর যদি টটেনহামও নরউইচের বিপক্ষে হারে, তাহলে আর্সেনাল সুযোগ পাবে পরবর্তী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলার। যদি আর্সেনালের জয়ের পরও টটেনহাম নরউইচের বিপক্ষে অন্তত ড্র করে, তাহলে চ্যাম্পিয়নস লীগে খেলার জন্য অপেক্ষার প্রহর বৃদ্ধি হবে আর্সেনালের।
নিউক্যাসলের বিপক্ষে ২-০ গোলে হারার পর অধিনায়ক মার্টিন ওডেগার্ড থেকে শুরু করে ম্যানেজার আর্তেতা, সবার চোখে মুখে ছিল ব্যর্থতার কারণে হতাশার ছাপ। ম্যাচ পরবর্তী সাক্ষাৎকারে আক্ষেপের কণ্ঠ ঝড়েছে গ্রানিথ শাকার কণ্ঠে। এত কাছে এসেও আগামী মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লীগ না খেলতে পারাটা নিঃসন্দেহে আর্সেনালের খেলোয়াড়, ম্যানেজার, বোর্ড থেকে শুরু করে ভক্ত সমর্থক সবার জন্যই অনেক বড় একটা আক্ষেপের কারণ হবে।
তাহলে পরবর্তীতে কি অপেক্ষা করছে আর্সেনালের জন্য? গত সপ্তাহে ম্যানেজার মিকেল আর্তেতার চুক্তি ২০২৫ পর্যন্ত বাড়িয়ে আর্সেনাল বোর্ড ইংগিত দিয়েছে তারা আর্তেতার সঙ্গে আছে। এই মৌসুমে ইউরোপিয়ান কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে না পারলেও আগামী মৌসুমে অন্তত ইউরোপা লীগে খেলার সুযোগ আছে আর্সেনালের, ফলে এক মৌসুম পর ইউরোপিয়ান ফুটবলে প্রত্যাবর্তন হচ্ছে গানার্সদের। ব্যাপারটি ইতিবাচক ভাবে দেখছে আর্সেনাল বোর্ড।
ইতিমধ্যে ইংগিত পাওয়া গেছে আগামী দলবদলের মৌসুমের জন্য ভালো বাজেট পাচ্ছে ম্যানেজার আর্তেতা। তবে চ্যাম্পিয়নস লীগ ফুটবলে খেলতে পারলে হয়তো বাজেট একটু হলেও বৃদ্ধি হতো, ভালো খেলোয়াড়দের দলে টানার সম্ভাবনা বেড়ে যেত। তবুও আর্সেনাল বোর্ড আশাবাদী তারা যে সকল খেলোয়াড়দের দলে নেয়ার টার্গেট করেছে, প্রায় সবাইকেই দলে ভেড়াতে পারবে। ম্যানচেস্টার সিটির গ্যাব্রিয়েল হেসুস আগামী মৌসুমের জন্য আর্সেনালের শীর্ষ টার্গেটসমূহের মধ্যে অন্যতম, আর্সেনাল বোর্ড মনে করে চ্যাম্পিয়নস লীগ ফুটবল না থাকলেও তাদের প্রজেক্ট, ভিশন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আর্সেনালে যোগ দেয়ার ব্যাপারে হেসুসের মতো অন্যান্য শীর্ষ খেলোয়াড়দের আগ্রহী করবে।
তবে আর্সেনাল চ্যাম্পিয়নস লীগে খেলতে পারলে দলের সেরা খেলোয়াড়দের নতুন চুক্তির ব্যাপারে মানানোটা সহজ হতো। তাছাড়া চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলার জন্য উত্তীর্ণ হতে পারলে খেলোয়াড়দের সাপ্তাহিক বেতনের সাথে যুক্ত হতো স্পেশাল বোনাস, যা তাদের উজ্জীবিত করতে ভূমিকা পালন রাখতো।
আর্সেনালের এই দল যদি একটু ধারাবাহিক হতো, তাহলে এবারই নিশ্চিতভাবে শীর্ষ চারে থেকে মৌসুম শেষ করতে পারতো। এই মৌসুম হতে পারতো আর্সেনালের জন্য মনে রাখার মতো, এমনকি এই পরিস্থিতি থেকেও যদি আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লীগে খেলতে পারে আর্সেনাল তবে চ্যাম্পিয়নস লীগে প্রত্যাবর্তনের মৌসুম হিসেবে ভক্তদের স্মৃতিতে দীর্ঘদিনের জন্য জায়গা পাবে এই সিজন। তবে ওডেগার্ড, সাকাদের মতো তরুণ প্রতিভা গড়া এই আর্সেনাল স্কোয়াডের মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা, যা এই মৌসুমেই আমরা দেখতে পেয়েছি। আর্সেনালের খেলোয়াড়রা যদি আরেকটু ধারাবাহিক হয়ে এই মৌসুমের ফেলে রাখা পারফরম্যান্স আগামী মৌসুমে উপস্থাপন করতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে ভালো ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে গানার্সদের জন্য।
- 0 মন্তব্য