নটিংহ্যাম ফরেস্ট - এক রূপকথা,উত্থান-পতন এবং প্রত্যাবর্তনের গল্প
পোস্টটি ১০৬২ বার পঠিত হয়েছে
স্বপ্নযাত্রা এবং রূপকথা - শব্দ দুইটি পরস্পর আপেক্ষিক বিষয়। এই দুইটি বিষয়ের বাস্তবে আপাতদৃষ্টিতে কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও আমাদের আশে পাশে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা সকলের নিকট অবিশ্বাস্য হিসেবেই থেকে যায়। ফুটবলে এরকম অসাধ্য কে সাধন কিংবা রূপকথার বিষয়টি সামনে এলে যে কথাটি সবার আগে মাথায় আসে সেটা হচ্ছে - লেস্টার সিটির রূপকথার। যে দল টপ টায়ারে প্রমোশন পাবার পর প্রথম মৌসুমে কোনোরকম অবনমন এড়িয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো, তারাই কিনা পরের মৌসুমে টপ সকল ক্লাবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিরোপা উদযাপন করেছে - কল্পনা করা যায়!
এবার চলুন আরেকটু কল্পনা করি। ধরুন,চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে সবে মাত্র একটি নবাগত দল টপ টায়ারে উন্নীত হলো। উন্নীত হবার প্রথম মৌসুমেই বাঘা বাঘা দলকে হারিয়ে জিতে নিলো লিগ শিরোপা। আর্সেনালের ইনভিনসিবল সিজনের মতো উইনিং স্ট্রাইক বজায় রাখলো প্রায় গোটা মৌসুম। ভাবছেন, এগুলো তো স্বপ্নে কিংবা ফিফা ক্যারিয়ার মুডেই সম্ভব! আপনারা এই ভাবনার পরিধি আরেকটু প্রশস্থ করুন। লিগ জয়ের সুবাদে সেই দল কেটে ফেললো পরের মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের টিকিট। এবং প্রথম ইউরোপিয়ান সিজনেই বাজিমাত! ইউরোপের সকল জায়ান্টদের একপাশে রেখে তারা অর্জন করলো শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। তাও এই মুকুট তারা ধরে রাখলো টানা দুই সিজন। আমরা সবাই জানি এই স্বপ্নযাত্রার বাস্তবে কোনো হদিস থাকবার কথা নয়, কল্পনা অথবা ফিফা ক্যারিয়ার মুডেই সম্ভব।
- না! এইসব কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে এক অভাবনীয় রূপকথার জন্ম দিয়েছিলো একটি দল।
১৬ই মে ১৯৯৯
সিটি গ্রাউন্ডে লেস্টার সিটিকে ১-০ গোলে হারিয়েও পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে থেকে চ্যাম্পিয়নশিপে অবনমন।
২৯ মে ২০২২।
ওয়েম্বলিতে প্লে অফ ম্যাচে হাডারসফিল্ড টাউনকে ১-০ গোলে হারিয়ে ২৩ বছর পর আবারো প্রিমিয়ার লিগে আগমন। এর মাঝে কেটে গেছে প্রায় দুই যুগ। পরিবর্তন হয়েছে অনেককিছু। শুধু পরিবর্তন হয়নি এক দল মানুষের স্বপ্ন, আশা, প্রত্যাশার। সেই প্রত্যাশা তাদের আবারো পূরণ হতে যাচ্ছে।
এতক্ষণে হয়তো বুঝতে পেরেছেন কাদের বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে! সময়ের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অসংখ্য উত্থান পতনের স্বাক্ষী হওয়া সেই দলটির নাম নটিংহ্যাম ফরেস্ট। যারা প্রমোশন পাবার বছর চারেকের মধ্যে জিতেছিল সম্ভাব্য সকল মেজর ট্রফি। দেখেছে মুদ্রার বিপরীত পিঠও। সম্প্রতি আবারো তারা অর্জন করে নিয়েছে ইংল্যান্ডের টপ টায়ারে খেলার যোগ্যতা। তাও আবার দুই যুগ পর!
নটিংহ্যাম ফরেস্ট বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ক্লাবগুলোর একটি । এটি প্রতিষ্ঠিত হয় আজ থেকে একশত সাতান্ন বছর আগে, ১৮৬৫ সালে। প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে নটিংহ্যাম ফরেস্ট ছিলো একটি মাল্টি স্পোর্টস ক্লাব যেখানে ফুটবলের পাশাপাশি বেইসবল, Bandy (শীতকালীন একটি জনপ্রিয় খেলা) সহ অসংখ্য খেলায় অংশগ্রহণ করতো। এতে বুঝা যায় শুরু থেকেই আর্থিকভাবে কতোটা স্বচ্ছল ছিলো ক্লাবটি। ফুটবলের (বিশেষ করে ইংলিশ ফুটবল) উন্নয়নেও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে দলটি। আর্সেনাল, এভারটন, ব্রাইটনসহ অনেক ক্লাব তাদের সহযোগিতা পেয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৮৮৬ সালে আর্সেনালের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ফুটবল কিট দিয়ে সাহায্য করেছিল নটিংহ্যাম। আজও তারা সেই লাল রংকে ধারণ করে তৈরি করে ক্লাবের জার্সি , লোগোতেও আছে লাল রংয়ের আভা। এছাড়া ব্রাইটন, এভারটন কে ফুটবলীয় সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করেছিল তারা।
Brian Clough - The Magician Pioneer Behind Nottingham's success:
শুরু থেকে যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা স্বত্বেও সাফল্যের ধরা পায়নি ক্লাবটি। শুরুর দিকে প্রথম ডিভিশনে নিয়মিত খেললেও কয়েক মৌসুম পর নেমে যায় দ্বিতীয় ডিভিশনে। এবং সেখানেই ক্লাবের ইতিহাসের অধিকাংশ সময় পার করেন তারা। একটি সমীকরণে দেখা যায়, নটিংহ্যাম তাদের ক্লাব ইতিহাসে সেকেন্ড ডিভিশনে গড়ে ১২ তম পজিশনে থেকে প্রতিবার লিগ শেষ করে!
সেকেন্ড ডিভিশনের নিয়মিত ক্লাবে পরিণত হওয়া নটিংহ্যাম ফরেস্ট যাচ্ছে তাই অবস্থা পার করছিলো ১৯৭৪ সালের দিকে। ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত অনেক কর্মকর্তাই ক্লাবের শেষ দেখতে শুরু করে দিয়েছিলেন। এই পুরো দৃশ্যপট বদলে গিয়েছিল নর্থ ইয়র্কশায়ারের এক ভদ্রলোকের আগমনে। তার হাত ধরে এরপর এক নতুন ইতিহাস রচনা করে বেহাল অবস্থাতে থাকা সেই নটিংহ্যাম ফরেস্ট। একে ইতিহাস বললে হয়তো বিরাট ভুল হবে,রূপকথা বলাই শ্রেয়! ভদ্রলোকের নাম ব্রায়ান ক্লাফ। নটিংহ্যামের সেই রূপকথার রূপকার ছিলেন তিনি যার জাদুর ছোঁয়াতে নতুন নতুন ইতিহাস লিখা শুরু করে সেই পুঁচকে নটিংহ্যাম! ক্লাফ এবং নটিংহ্যাম হয়ে যায় এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ক্লাফের জন্ম এবং বেড়ে উঠা ইয়র্কশায়ারের মিডলসব্রো তে। খেলোয়াড়ী জীবনে খেলতেন স্ট্রাইকার পজিশনে। তার ক্যারিয়ার শুরু সেই মিডলসব্র ইয়ুথ টিমের হাত ধরেই। তারপর মাঝে দুই বছর দ্বিতীয় বিভাগের একটা ক্লাবে কাটানোর পর ২০ বছর বয়সে মিডলসব্রো মূল দলে অভিষেক হয় ক্লাফের। সেখানে ৬ বছরে ২২২ ম্যাচ খেলে ক্লাফ গোল করেন ২০৪ টি। টানা ৪ মৌসুম করেন ৪০+ গোল। এতো দারুন ফর্মে থাকার পরেও মিডলসব্রোকে জিততে পারেননি বড় কোনো শিরোপা। ক্লাফ সম্পর্কে আরেকটি কথা বলা জরুরি, তিনি ছিলেন একদম স্পষ্টবাদী একজন মানুষ যিনি বিনা দ্বিধায় যেকোনো কিছু বলে ফেলতেন। মিডলসব্রোতে দলীয় সাফল্য না থাকার পেছনে দোষ চাপালেন তার কিছু সতীর্থদের উপর। ক্লাফের দাবি, বাজে ডিফেন্সের কারণে প্রতিনিয়ত ভুগতে হয়ে তাদের। একবার একটি ম্যাচ এগিয়ে থাকার পরেও ৬-৬ গোলে ড্র হবার পর তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন -' আর কয়টি গোল করলে আমরা জয়ের দেখে পাবো?' ফলাফল - রাগে ক্ষোভে ট্রান্সফার রিকুয়েস্ট করেন ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে, অবশেষে তার আবেদন মঞ্জুর হয়। ১৯৬১ সালে তিনি যোগ দেন মিডলসব্রোর লোকাল রাইভাল ক্লাব সান্ডারল্যান্ডে। সেখানেও চলতে থাকে 'ক্লাফনামা'। ব্ল্যাক ক্যাটসদের হয়ে ৭৪ ম্যাচে গোল করেন ৬৩ গোল। তার এই গৌরোজ্জ্বল ক্যারিয়ারটি বেশি দীর্ঘ হতে পারেনি ইঞ্জুরির কারণে। মাত্র ২৯ বছর বয়সে বুট জোড়া তুলে রাখতে বাধ্য হোন নিজের জেনারেশনের অন্যতম সেরা এই স্ট্রাইকার।নিজের এই ক্ষুদ্র খেলোয়াড়ী জীবনে সর্বসাকুল্যে ২৭৪ ম্যাচ খেলে গোল করেন ২৫১টি। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে দুই ম্যাচে মাঠে নামার সৌভাগ্যও হয়েছিলো তার!
বুট জোড়া তুলে রাখলেও ফুটবল থেকে দূরে থাকতে পারেননি বেশিদিন। ১৯৬৫ সালে হার্টসপুল ইউনাইটেডের হয়ে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন ক্লাফ। সেখানে ২ মৌসুম কাটানোর পর ১৯৬৭ সালে যোগ দেন দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব ডার্বি কাউন্টিতে। সেখান থেকে উন্মোচিত হয় এক নতুন দিগন্তের। দায়িত্ব নেবার একবছরের মাথায় দলকে চ্যাম্পিয়ন করে নিয়ে যান প্রথম বিভাগে। প্রায় ১০ বছর পর টপ ফ্লাইট ফুটবলে জায়গা করে নেয় ডার্বি। এই উন্নতির ধারা বজায় থাকে সামনের দিনগুলোতেও। পরের দুই মৌসুমে প্রথম ডিভিশনে ডার্বির অবস্থান ছিল যথাক্রমে চতুর্থ ও নবম। সবচেয়ে বড় সাফল্য পান তৃতীয় মৌসুমে। বছরখানেক আগেও দ্বিতীয় বিভাগে ঢুকতে থাকা ডার্বি এবার জিতে নেয় প্রথম ডিভিশনের লিগ শিরোপা!
The emergence of The Tricky Trees:
ডার্বি তে এই সুসময় দীর্ঘ হয়নি বেশিদিন। কর্তৃপক্ষ এবং কিছু প্লেয়ারের সাথে সম্পর্কের অবনতির জের ধরে ১৯৭৩ সালে ডার্বির দায়িত্ব ছাড়েন ক্লাফ। তারপর বছর দুয়েক কোচিং করান ব্রাইটন এবং লিডস কে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে যোগ দেন নটিংহ্যাম ফরেস্টে।
নটিংহ্যামের তৎকালীন অবস্থা একদম করুণ। দ্বিতীয় বিভাগে ধুঁকতে থাকা দলটির প্রথম বিভাগের খেলার কথা চিন্তা করাও দিবাস্বপ্ন সমান ছিলো। ক্লাফ এসে দলকে ঢেলে সাজাতে থাকেন। দ্বিতীয় মৌসুমে তার সাথে সহকারী হিসেবে যোগ দেন একসময়কার তার সতীর্থ পিটার টেইলর।
টেইলর ছিলেন একজন খাঁটি জহুরি। নটিংহ্যামের এই সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারণ ছিলো স্কাউটিং। গোটা ইংল্যান্ড জুড়ে ট্যালেন্টের তালাশ করতেন এরা দুইজন। নটিংহ্যামের এই স্বপ্নযাত্রায় কয়েকজন ফুটবলার ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে - ভিভ এন্ডারসন, ও'লিন, ইয়ান বোয়ার, টনি উডকক, জন রবার্টসন। পরবর্তীতে বিখ্যাত ইংলিশ কিপার পিটার শেলটন কে করা হয়েছিল দলভুক্ত। তৎকালীন রেকর্ড ১ মিলিয়ন দিয়ে আনা হয়েছিল ট্রেভর ফ্রান্সিস কে। এর আগে ইংলিশ লিগে এতো ফি দিয়ে কোনো ট্রান্সফার সংঘটিত হয়নি।
দলকে মোটামুটি একটি পর্যায়ে দাড় করিয়ে শুরু করেন মূল লড়াই।১৯৭৭ সালে মাত্র ৫২ পয়েন্ট নিয়ে দলকে টপ ডিভিশনে উঠান ক্লাফ এবং টেইলর। এটি ফুটবল ইতিহাসে কোনো প্রোমোটেড ক্লাবের পক্ষ ৫ম সর্বনিম্ন পয়েন্ট। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় মাত্র একবছরের মাথায় প্রমোশন পায় নটিংহ্যাম। প্রোমোটেড দল হিসেবে যেকোনো দলের মূল লক্ষ্য থাকে প্রথম বিভাগে টিকে থাকা। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে টপ ফ্লাইট ফুটবলের প্রথম মৌসুমেই বাজিমাত করে বসে ক্লাফের আর্মিরা। জিতে নেয় ১৯৭৮-৭৮ মৌসুমের লিগ শিরোপা তাও আবার দ্বিতীয় পজিশনে থাকা লিজেন্ডারি কোচ বব পেইসলির লিভারপুল থেকে ৭ পয়েন্টের ব্যবধানে! পেইসলির সেই লিভারপুলকে টেক্কা দেওয়া চাট্টিখানি কথা ছিলো না!
লিগ চ্যাম্পিয়ন হবার সুবাদে পরেরবার ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে ইউরোপিয়ান কাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ফরেস্ট। এখানেও প্রথমবার এসে হারায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন পেইসলির সেই মাইটি লিভারপুলকে।
সেমিফাইনালে জার্মান ক্লাব কোলনের মুখোমুখি হয় নটিংহ্যাম। সেখানে প্রথম লেগে ২ গোলে পিছিয়ে পড়েও ৩-২ গোলে কামব্যাক করার ইতিহাস প্রায় লিখেই ফেলেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তের গোলে ৩-৩ গোলে ড্র করে অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে মাঠ ছাড়ে কোলন। পরের লেগে আর কোনো ভুল হতে দেন নি ক্লাফের সৈনিকরা। ইয়ান বোয়ারের একমাত্র গোলে কোলনের মাঠ থেকে জয় নিয়ে বাড়ি ফেরে ফরেস্ট। সাথে কেটে নেয় স্বপ্নের ফাইনালের টিকেট।
মিউনিখে অনুষ্ঠিত ফাইনালে ফরেস্টের প্রতিপক্ষ ছিলো মালমো। সেখানে রেকর্ড বয় ট্রেভর ফ্রান্সিসের একমাত্র গোলে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই চ্যাম্পিয়ন হয় নটিংহ্যাম!
ক্লাফের আগমেনর পূর্বে ক্লাবের ৯৭ বছরের ইতিহাসে প্রথম বিভাগের শিরোপা জিতেছিল একবার আর এফ এ কাপ দুইবার। ক্লাফ এবং টেইলরের নৈপুণ্যে ৪ বছরের মাথায় নটিংহ্যাম নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে!!
তাদের এই জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে পরের মৌসুমেও। সেবার লিগ কাপ জেতে ফরেস্ট। অপরাজিত থাকে টানা ৪২ ম্যাচ - যেটি পরবর্তীতে ওয়েঙ্গারের আর্সেনাল ভাঙতে সক্ষম হয়। তবে এবার লিগ শিরোপা হারাতে হয় লিভারপুলের কাছে। তাদের সেই উইনিং স্ট্রাইকের সমাপ্তি ঘটে লিভারপুলের বিপক্ষে হারার পর। তবে স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনাকে হারিয়ে জিতে নেয় আরেকটি মেজর ট্রফি - ইউরোপিয়ান সুপার কাপ।
ওই মৌসুমে আবারো ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে পৌঁছায় ফরেস্ট। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে অনুষ্ঠিত ফাইনালে এবার প্রতিপক্ষ ছিলো জার্মান ক্লাব হামবুর্গ। তবে এবার বেশ ঝামেলায় পড়তে হয় ক্লাফকে।কারণ ইঞ্জুরির জন্যে এই ম্যাচ মিস করেন ফ্রান্সিস। নক আউট স্টেজে এই ফ্রান্সিসের একক নৈপুণ্যে ফাইনালে উঠেছিল ফরেস্ট। এছাড়া দলের বেশ কিছু প্লেয়ার মিস করেন ক্লাফ। শেষমেষ মাত্র ১৫ জনের দল নিয়ে মাদ্রিদের উদ্দেশে রওনা দেয় নটিংহ্যাম। ফাইনালে রবার্টসনের একমাত্র গোলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট নিজেদের করে নেয় নটিংহ্যাম ফরেস্ট! সেই ম্যাচে পেইনকিলিং ইনজেকশন নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন পিটার শিল্টন এবং জয়ের পেছনে রেখেছিলেন অসামান্য অবদান।
দুঃস্বপ্নের সূত্রপাত:
লিগ, লিগ কাপ, ইউরোপিয়ান কাপ সহ সম্ভাব্য সকল ট্রফি জেতার পর আস্তে আস্তে মুদ্রার ওপিঠ দেখা শুরু করে ফরেস্ট। ধীরে ধীরে লিগে তাদের পজিশন নিম্নমুখী হতে থাকে। সেসময় ক্লাব ছাড়তে থাকে অনেক গুরুত্ত্বপূর্ন ফুটবলার। একসময় বেশ কিছু ইস্যুর কারণে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান তার সহকারী এবং সতীর্থ টেইলর।
তার অনুপস্থিতিতেও বেশ কয়েকবছর দলের হাল ধরে রাখেন ক্লাফ। নতুন করে দলকে গোছানোর চেষ্টা করেন। ১৯৮৯,১৯৯০ সালে টানা দুইবার জেতেন লিগ কাপ। তবে আর আগের মতো ফিরতে পারেনি ফরেস্ট।
পরের গল্পগুলো স্রেফ হতাশার। অবশেষে ১৯৯৩ সালে প্রায় ১৮ বছর পর রেলিগেটেড হয় নটিংহ্যাম। সেই বছর ক্লাফ ও ইতি টানেন কোচিং ক্যারিয়ারের।
এর মাঝে সূচনা ঘটে এক নতুন যুগের। এতদিন ফার্স্ট ডিভিশন নামে চলা ইংলিশ লিগের নামকরণ করা হয় প্রিমিয়ার লীগ হিসেবে, ১৯৯২ সালে। ফরেস্ট ছিলো সেই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
৯৩ সালে রেলিগেটেড হবার পর ফ্র্যাঙ্ক ক্লার্কের হাত ধরে আবারো ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে ফিরে আসে ফরেস্ট। সেবার প্রমোশন পেয়ে লিগ শেষ করে তৃতীয় স্থানে থেকে।সমর্থকরাও আবারো নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠেনি। বরং আবারো হতে থাকে অবনতি। দুইবছর প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকার পর ১৯৯৭ সালে রেলিগেটেড হয়ে যায় ফরেস্ট। ১৯৯৮-৯৯ তে প্রমোশন পেয়ে সেই মৌসুমেই আবারো অবনমন হয় তাদের। এরপর প্রায় ২৩ বছরে একবারও টপ ফ্লাইট ফুটবল খেলতে পারেনি নটিংহ্যাম। মাঝে হয়েছিল আরো বড় দুর্দশা, ২০০৫ সালে লিগ টু তে নেমে যায় তারা। সেখানে ৩ বছর খেলার পর চ্যাম্পিয়নশিপে ফিরে আসে ঐতিহ্যবাহী দলটি। চ্যাম্পিয়নশিপে সমসময় টেবিলের মাঝের পজিশনে উঠা নামা করতো তাদের অবস্থান।
প্রত্যাবর্তন:
২০২১ সালে ধুঁকতে থাকা এই দলের হাল ধরেন ওয়েলসম্যান স্টিভ কুপার। দায়িত্ব নেবার এক বছরের মাথায় প্রায় দুই যুগ পর আবারো প্রিমিয়ার লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নটিংহ্যাম!
তার হাত ধরেই ফিরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, অবসান ঘটে সব প্রতীক্ষার। কিন্তু ক্লাবের এই ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে পারছেন না ক্লাবের রূপকথার দুই স্রষ্ঠা ব্রায়ান ক্লাফ এবং পিটার টেইলর। ক্লাবের দুর্দিনের যখন সূত্রপাত, সে সময় ১৯৯০ সালে মারা যান টেইলর। তার প্রায় ১৪ বছর পর ২০০৪ সালে সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন ব্রায়ান ক্লাফ। এই দুনিয়াতে সম্ভব না হলেও পরপারে হয়তো দুই বন্ধু একসাথে বসে ঠিকই তাদের প্রিয় ক্লাবের প্রত্যাবর্তন দেখে মুচকি হাসি দিচ্ছেন।
এখন দেখবার বিষয় বিভিন্ন উত্থান পতনের স্বাক্ষী হওয়া এই ক্লাবটি অদূর ভবিষ্যতে টপ ফ্লাইট ফুটবলে কতদূর এগোতে পারে। সেই প্রশ্ন নাহয় সময়ের হাতে তোলা থাক!
- 0 মন্তব্য