ফুটবল এন্ড কামব্যাক (প্রথম পর্ব)
পোস্টটি ১০২০ বার পঠিত হয়েছেফুটবল অনিশ্চয়তার খেলা। শেষ বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে অনেক কিছু, নিমিষেই পালটে যেতে পারে ফলাফল। আকস্মিকভাবে কামব্যাকের গল্প প্রতি মৌসুমেই রচনা হয়, তবে সেগুলোর মধ্যে কিছু কামব্যাক লিখে ফেলে রূপকথা, হয়ে থাকে ইতিহাসে পাতায় সাক্ষী। সেসব কামব্যাকের কয়েকটি এখন তুলে ধরব আপনাদের সামনে:
১/ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম বায়ার্ন মিউনিখ (১৯৯৮-৯৯ চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল):
এই ফাইনালের আগে দুই দলই নিশ্চিত করে ফেলেছিল নিজেদের ঘরোয়া লীগ ট্রফি এবং ডোমেস্টিক কাপ, তাই এই ম্যাচ জিতে দুই দলের সামনেই সুযোগ ছিল নিজের দেশের সর্বপ্রথম ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জয় করার। ম্যাচের শুরুতেই বাসলার এর গোলে এগিয়ে যায় বায়ার্ন। ম্যাচের ৯০ মিনিট পর্যন্ত রেজাল্ট বায়ার্ন এর পক্ষেই ছিল। ইতিমধ্যে তখন বায়ার্ন ডাগআউটের প্লেয়াররা উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই রেড ডেভিলসদের বাজিমাত। বদলি হিসেবে নামা শেরিংহাম এবং সোলশায়ার এর অতিরিক্ত সময়ে করা গোলে ২-১ গোলে সেই ম্যাচ জিতে নেয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ফলে হয়ে যায় ট্রেবলজয়ী প্রথম ইংলিশ ক্লাব।
২/ম্যানচেস্টার সিটি বনাম কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স (২০১১-১২ প্রিমিয়ার লীগ):
এবারের কামব্যাকের গল্প ম্যানচেস্টার এর আরেক ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির। জিতলেই ৪৪ বছর পর প্রথমবারের মতো লীগ জেতার সমীকরণ নিয়েই সিজনের সর্বশেষ প্রিমিয়ার লীগ ম্যাচে মাঠে নেমেছিলো ম্যানচেস্টার সিটি। ৩৯ মিনিটে জাবালেতার গোলে এগিয়ে গেলেও প্রথমার্ধের বিরতির পর ৬৬ মিনিটের মধ্যে ২ গোল হজম করে পিছিয়ে পড়ে ম্যানচেস্টার সিটি। অতিরিক্ত সময়ে গোল করে ম্যানচেস্টার সিটিকে সমতায় ফেরান এডিন জেকো। তবে সমতায় ফেরাটাও যথেষ্ট ছিল না ম্যানচেস্টার সিটির জন্য, লীগ জিততে হলে সেই ম্যাচে জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না সিটিজেনদের কাছে। তবে ঐ ম্যাচের আসল টুইস্ট তুলে রাখা ছিল ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তের জন্য। অতিরিক্ত সময়ে শেষ বাঁশি বাজার ঠিক পূর্ব মুহুর্তেই মারিও বালোতেল্লির বাড়িয়ে দেয়া বল থেকে গোল করে সিটিকে ৩-২ গোলে জয় এনে দেন সার্জিও আগুয়েরো। সেই জয়ের ফলে প্রায় ৪ যুগ পর প্রথমবারের মতো ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ ঘরে তোলে ম্যানচেস্টার সিটি। বর্তমানে ম্যানচেস্টার সিটি বছরের পর বছর প্রিমিয়ার লীগে আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে, সর্বশেষ ৫ মৌসুমের চারবারই লীগ শিরোপা ঘরে তুলেছে। তবে নিঃসন্দেহে সেবার কামব্যাক করে প্রিমিয়ার লীগ জয়ের স্মৃতি হয়তো সিটিজেনদের কাছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।
৩/ লিভারপুল বনাম এসি মিলান (২০০৪-০৫ চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল)
কার্লো আনচেলত্তির এসি মিলান সে সময়ে সমানতালে ইতালিয়ান এবং ইউরোপিয়ান ফুটবলে আধিপত্য চালাচ্ছিল। দলে ছিল মালদিনি, কাকা, পিরলো, গাত্তুসোর মতো কিংবদন্তি নাম। লিভারপুলের বিপক্ষে সেবার চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে ফেভারিটের তকমা নামের পাশে নিয়েই মাঠে নেমেছিল এসি মিলান। প্রত্যাশামতো প্রথমার্ধেই ৩-০ গোলে এগিয়ে গিয়ে বিরতিতে যায় এসি মিলান। কোনো ফাইনাল ম্যাচে এমন অবস্থায় নিশ্চিতভাবে বলে দেয়া যায় এগিয়ে থাকা দলই ম্যাচ জিততে চলেছে। তবে সেদিন আরো একবার ফুটবলকে অনিশ্চয়তার খেলা প্রমাণ করে লিভারপুল। দ্বিতীয়ার্ধে ৫৪-৬০ এই ৬ মিনিটের মধ্যে ৩ গোল করে সমতায় ফিরে লিভারপুল। ম্যাচের বাকি সময়ে এবং অতিরিক্ত সময়ে কোনো গোল না হওয়ায় ম্যাচ পেনাল্টিতে যায়, পেনাল্টি শুটআউটে ২-৩ গোলে জিতে চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতে নেয় লিভারপুল। চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে প্রথম হাফে ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরও ম্যাচ জিতে শিরোপা ঘরে তোলা, আসলেই অবিশ্বাস্য!
৪/ পশ্চিম জার্মানি বনাম ফ্রান্স (১৯৮২ বিশ্বকাপ)
এবারের কামব্যাকের গল্প ইন্টারন্যাশনাল ফুটবলের, বেশ পুরোনোও বটে। ১৯৮২ বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে স্পেনের সেভিয়ার রামোস সানচেজ পিজহুয়ান স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় ফ্রান্স এবং পশ্চিম জার্মানি। ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলায় প্লাতিনি এবং লিটবারস্কির গোলে ১-১ গোলে সমতা থাকায় ম্যাচ পৌছায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের শুরুর ১০ মিনিটেই ২ গোল করে ৩-১ গোলে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। সেখান থেকে জার্মানির কামব্যাককে হয়তো সবাই অসম্ভব ভেবেছিল, তবে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখায় তারা। ১০২ ও ১০৮ মিনিটে রুমেনিগে এবং ফিশ্চার গোল করে সমতায় ফেরায় জার্মানিকে। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। পেনাল্টি শুটআউটে ফ্রান্সকে ৫-৪ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌছায় জার্মানি। যদিও সেবার ইতালির কাছে ফাইনালে ৩-১ গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল তাদের।
৫/ রেয়াল মাদ্রিদ বনাম ম্যানচেস্টার সিটি (২০২১-২২ চ্যাম্পিয়নস লীগ সেমি ফাইনাল):
সদ্য শেষ হওয়া চ্যাম্পিয়নস লীগের চ্যাম্পিয়ন রেয়াল মাদ্রিদ। ১৪ বারের মতো ইউরোপ সেরার খেতাব নিজের করে নিলো তারা। রেয়ালের এবারের চ্যাম্পিয়নস লীগ জয়ের গল্প পুরোটাই কামব্যাকের ছন্দে রচিত। পিএসজি, চেলসির বিপক্ষে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পিছিয়ে থেকেও কামব্যাক করে সেমিতে পৌছায় রেয়াল মাদ্রিদ। সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ইতিহাদ স্টেডিয়ামে ৪-৩ গোলে জিতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু স্টেডিয়ামে মাঠে নামে ম্যানচেস্টার সিটি। ম্যাচের ৭৩ মিনিটে রিয়াদ মাহরেজ এর গোল ম্যানচেস্টার সিটিকে ৫-৩ গোলের এগ্রিগেটে লিড এনে দেয়। ম্যাচের যখন ৯০ মিনিট চলছিল, সবাই ভেবে নিয়েছিল এবার আর কামব্যাক করা হচ্ছে না রেয়াল মাদ্রিদের। তখনই রেয়ালের ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভাব রদ্রিগোর। অতিরিক্ত সময়ে ২ মিনিটের মধ্যে ২ গোল করে এগ্রিগেটে সমতায় ফিরে রেয়াল মাদ্রিদ, ফলে ম্যাচে যুক্ত হয় আরো ৩০ মিনিট অতিরিক্ত সময়। অতিরিক্ত সময়ে পেনাল্টি থেকে করা বেঞ্জেমার গোল লস ব্লাংকোসদের এনে দেয় ৬-৫ গোলের এগ্রিগেটে জয়। এই কামব্যাকের ফলেই ফাইনালে পৌছায় রেয়াল মাদ্রিদ, লিভারপুলকে ফাইনালে ১-০ গোলে হারিয়ে রেকর্ড ১৪ বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লীগ ঘরে তুলে নেয় তারা।
৬/ দেপোর্তিভো লা করুনা বনাম এসি মিলান (২০০৩-০৪ চ্যাম্পিয়নস লীগ কোয়ার্টার ফাইনাল)
আবারও চ্যাম্পিয়নস লীগে কামব্যাকের গল্প, আবারও এর নির্মম শিকার এসি মিলান। অবশ্য এই কামব্যাকের গল্প ইস্তানবুলের সেই ফাইনালের এক মৌসুম আগের। দোপোর্তিভো লা করুনার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে ৪-১ গোলে জেতায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন এসি মিলানকেই সেমি ফাইনালে উঠার দৌড়ে এগিয়ে রেখেছিল সবাই। সেমি ফাইনালে উঠতে হলে দেপোর্তিভোর জিততে হতো ৪ গোলের ব্যবধানে, দ্বিতীয় লেগে ঠিক সেটি করে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো দেপোর্তিভো। ফিরতি লেগে নিজেদের ঘরের মাঠে তারকায় ঠাসা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন এসি মিলানকে পাত্তাই দেয়নি দোপোর্তিভো, ৪-০ গোলে এসি মিলানকে হারিয়ে সেমি ফাইনালে উঠে তারা। চ্যাম্পিয়নস লীগে নক আউটে ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে দোপোর্তিভো প্রথম লেগে ৩ গোলের ব্যবধানে পিছিয়ে থেকেও উঠে যায় পরবর্তী রাউন্ডে।
৭/ বেলজিয়াম বনাম জাপান (২০১৮ বিশ্বকাপ)
বেলজিয়ামের বর্তমান প্রজন্মের ফুটবলারদের নিয়ে গড়া স্কোয়াডকে বিবেচনা করা হয় গোল্ডেন জেনারেশন হিসেবে। কেভিন ডি ব্রুইনা, ইডেন আজার, রোমেলু লুকাকু, থিবু কর্তুয়াদের নিয়ে গড়া এই দলের হাত ধরেই ২০১৮ সালে বেলজিয়াম পেয়েছে বিশ্বকাপ ইতিহাসে সেরা সফলতা। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে ৩য় স্থান অর্জনকারী বেলজিয়ামের যাত্রাতেও আছে কামব্যাকের গল্প। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে জাপানের বিপক্ষেই তাদের ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ যাত্রার সমাপ্তি ঘণ্টা প্রায় বেজে উঠেছিল। সেই ম্যাচে ৫২ মিনিটের মধ্যে ২-০ গোলে এগিয়ে অঘটনের আভাস দিচ্ছিল জাপান। ৬৯ মিনিটে ভার্টুনঘেন গোল করে বেলজিয়ামকে আশা দেয়, ৭৪ মিনিটে বদলি হিসেবে নামা ফেলাইনির গোলে সমতায় ফিরে বেলজিয়াম। ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে আরেক সাবস্টিটিউট নাসের চাডলির গোলে ৩-২ গোলে জয় পেয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছায় বেলজিয়াম।
চলবে...
- 0 মন্তব্য