স্যার ববি চার্লটন- মিউনিখ ট্রাজেডি জয় করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন
পোস্টটি ৯৭৮ বার পঠিত হয়েছেআধুনিক ফুটবলের উৎপত্তিস্থল ইংল্যান্ড, কিন্তু এই ইংলিশরা মাত্র ১ বার হয়েছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ১৯৬৬ সালে নিজেদের ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া সেই বিশ্বকাপই ইংল্যান্ডের জেতা প্রথম এবং সর্বশেষ বিশ্বকাপ। বরাবরই সবসময় তারকার মেলা থাকে ইংল্যান্ড টিমে, বিশ্বকাপজয়ী সেই দলেও গর্ডন ব্যাংকস, নবি স্টিল, ববি মুরের মতো কিংবদন্তীরা ছিলেন। তবে সবাইকে ছাপিয়ে সেই বিশ্বকাপের সেরা প্লেয়ার হোন ববি চার্লটন। ৩ গোল করে ইংল্যান্ডের সেই বিশ্বকাপ জয়ে সামনে থেকে ভূমিকা রাখেন তিনি।
ববি চার্লটনের জন্ম হয়েছিল ফুটবল অনুরাগী পরিবারে। চার্লটনের চার মামাই প্রফেশনাল ফুটবলার। তার মায়ের কাজিন জ্যাকি মিলবার্নকে তো নিউক্যাসল ইউনাইটেড ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন ফুটবলার হিসেবে গণ্য করা হয়। তার ভাই জ্যাক চার্লটনও ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ী ইংল্যান্ড স্কোয়াডের সদস্য ছিলেন।
মায়ের পরিবারের ফুটবলীয় জিন চার্লটন নিজের মধ্যে ভালোভাবেই পান। ১৯৫৩ সালের কোনো এক দুপুরে ১৫ বছর বয়সী চার্লটন নর্দামবারল্যান্ড স্কুলে ফুটবল খেলছিল। সে সময়ে সেখানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর চিফ স্কাউট উপস্থিত ছিলেন, সাথে সাথেই চার্লটন তার নজরে পড়ে যায়। ফুটবল ব্যাকগ্রাউন্ডের পরিবার থেকে আসলেও তার মা শুরুতে তার ম্যান ইউনাইটেড একাডেমীতে যাওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, আশংকা করেছিলেন তিনি প্রফেশনাল ফুটবলার হতে পারবেন কিনা। পরে ঠিকই তিনি রাজি হোন, এজন্য চার্লটনও অনেকবার বলেছেন তার ফুটবলার হওয়ার পেছনে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি।
চার্লটন ইউনাইটেড একাডেমীতে যোগ দেয়ার পর থেকেই ছিলেন দুর্দান্ত। বয়সভিত্তিক দল, রিজার্ভ দলের হয়ে গোলের পর গোল করে ১৯৫৬ সালে ১৯ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সিনিয়র দলের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পান।
চার্লটন এথলেটিকের বিপক্ষে নিজের শুরুর ম্যাচেই চার্লটন জোড়া গোল করেন। সিনিয়র ফুটবলে নিজের প্রথম সিজনে চার্লটন ১৪ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান, এই ১৭ ম্যাচে ১২ গোল করেন যার মধ্যে একটি হ্যাটট্রিক ছিল। এই সিজনে তিনি ইউনাইটেড এর হয়ে জিতেন লীগ শিরোপা।
এরপরের মৌসুমে দলে পুরোপুরি নিয়মিত হোন চার্লটন। ইউনাইটেড এবং চার্লটন উভয়েরই এরপরের মৌসুম ভালোই যাচ্ছিল। ২০ বছর বয়সী চার্লটন তখন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ইতিমধ্যে তারা ইউরোপিয়ান কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে রেড স্টার বেলগ্রেডকে হারিয়ে সেমিতে পা রেখে যুগোস্লাভিয়া থেকে ম্যানচেস্টারে ফিরছে। তখনই ঘটে সেই ঐতিহাসিক মিউনিখ ট্রাজেডি। বিমান তেল নেওয়ার জন্য মিউনিখে দাঁড়ালে এরপরই বৈরী আবহাওয়ার জন্য ঘটে দূর্ঘটনা। মিউনিখ ট্রাজেডিতে ৪৪ জন বিমান আরোহীর ২৩ জনই মারা যান, যার মধ্যে ছিলেন ৮ জন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর প্লেয়ার। তবে বেঁচে যান ববি চার্লটন। মিউনিখ ট্রাজেডিতে বেঁচে যাওয়া সর্বশেষ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।
সৌভাগ্যবশত এই দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত হোননি তিনি, ১ মাসের মধ্যেই পুনরায় ফুটবলে ফিরেন। ৮ জন প্রথম দলের ফুটবলারের মৃত্যুর পরও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সেই মৌসুমে এফএ কাপ এর ফাইনাল খেলে। সেই ম্যাচ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ২-০ গোলে হারলেও ক্লাব পর্যায়ে আরো একটি সফল মৌসুমের পরিসমাপ্তি ঘটে চার্লটনের। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩০ ম্যাচ খেলে ১৬ গোল নিয়ে মৌসুম শেষ করেন চার্লটন।
সেই বছরই জাতীয় দলে ডাক পান চার্লটন। মিউনিখ ট্রাজেডির ২ মাস পরেই ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পান তিনি। দ্বিতীয় ম্যাচেই ইংল্যান্ডের হয়ে জোড়া গোল করে কোচের কাছে নিজের প্রতিভার জানান দেন। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে চার্লটন জায়গা পেলেও মাঠে নামার সুযোগ পাননি।
ভয়াবহ মিউনিখ ট্রাজেডির পর পুনরায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলকে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব নেন ম্যাট বাসবি। সেই প্রজেক্ট এর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন ববি চার্লটন। মিউনিখ ট্রাজেডির পর ৫ বছর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোনো শিরোপা না জিতলেও দলের সেরা পারফর্মার ছিলেন ববি চার্লটন। ১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে তিনি করেন ২৯ গোল। এর পরের তিন মৌসুমে তার গোলসংখ্যা যথাক্রমে ২১, ২১ এবং ১০। এই সময়টাতেই ববি চার্লটনের খেলার প্লে মেকিং এর দিকটি ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছিল, বয়সের সাথে তিনি হয়ে উঠছিলেন পরিপূর্ণ একজন এটাকিং মিডফিল্ডার, যে নিজে গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে গোল করাতে পছন্দ করে।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর মেইনম্যান হওয়ার পাশাপাশি ইংল্যান্ড জাতীয় দলেও নিয়মিত হোন চার্লটন। আস্তে আস্তে নিজেকে ইংল্যান্ড দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের মতো ৬২ বিশ্বকাপেও ডাক পান তিনি, তবে সেবার তিনি ইংল্যান্ড একাদশের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। সেই বিশ্বকাপে চার্লটনের পারফরম্যান্স ছিল দুর্দান্ত, তবে বাকিদের ব্যর্থতায় কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় ইংলিশদের। বিশ্বকাপের পর ইংলিশ ম্যানেজার আলফ রামসে সিদ্ধান্ত নেন ১৯৬৬ বিশ্বকাপের জন্য ববি চার্লটনকে কেন্দ্র করে তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে দল সাজাবেন।
মিউনিখ ট্রাজেডির পর ১৯৬২-৬৩ মৌসুমে প্রথম শিরোপা জিতে ইউনাইটেড। এফএ কাপের ফাইনালে লেস্টার সিটিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দুইটি এফএ কাপ ফাইনাল হারের পর প্রথমবারের মতো এফএ কাপ জয়ের স্বাদ পান ববি চার্লটন। সেই মৌসুমে ববি চার্লটন ৩৪ ম্যাচে ৯ গোল করলেও ডিপ লায়িং ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলা চার্লটনের প্লে মেকিং ইউনাইটেড এর এফএ কাপ জয়ে সবচেয়ে বড় কি পয়েন্ট ছিল।
এরপরের সিজনগুলো ইউনাইটেড এর সফলতার গল্প ছিল। ১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে লীগ শিরোপা জেতার খুব কাছাকাছি গিয়েছিল ইউনাইটেড, ২য় স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করে রেড ডেভিলসরা। ৫৪ ম্যাচ খেলে ১৫ গোল নিয়ে মৌসুম শেষ করা চার্লটন এই মৌসুমেই প্রথমবারের মতো একসাথে জর্জ বেস্ট এবং ডেনিশ ল এর সাথে একসাথে খেলার সুযোগ পান, তাদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেন "দি ইউনাইটেড ট্রিনিটি"।
৭ সিজন পর ১৯৬৪-৬৫ সিজনে প্রথমবারের মতো লীগ শিরোপা জিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ইউনাইটেড এর লীগ শিরোপা জেতার পেছনে দি ইউনাইটেড ট্রিনিটির বড় ভূমিকা থাকলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ববি চার্লটনের। সেই মৌসুমে ইউনাইটেড এর সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন ডেনিশ ল, তরুণ জর্জ বেস্টও সেই সিজনের ধারাবাহিক পারফর্মার ছিলেন। তবে পুরো ইউনাইটেড দলকে ববি চার্লটন তার নেতৃত্ব দিয়ে মাঠে রাখতেন উজ্জ্বীবিত, তার বানানো বলেই একের পর এক গোল পেতেন ডেনিশ ল, জর্জ বেস্টরা। তিনিও সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫৯ ম্যাচ খেলে মোট ১৮ গোল করেন।
এরপরের মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কমিউনিটি শিল্ড জিতে, আরো একটি শিরোপা যুক্ত হয় ববি চার্লটনের নামের পাশে। এই মৌসুমেও ক্লাবের হয়ে ১৮ গোল করেন তিনি।
মৌসুম শেষ হওয়ার পরই শুরু হলো ১৯৬৬ বিশ্বকাপ। ব্যাংকস, স্টিল, মুরের মতো তারকাদের নিয়ে গড়া ইংলিশ দলের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন ববি চার্লটন। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ ইংল্যান্ড উরুগুয়ের বিপক্ষে ০-০ গোলে ড্র করলেও এরপরের ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় পায় ইংল্যান্ড, একটি গোল আসে চার্লটনের পা থেকে।
পরের ম্যাচে ফ্রান্সকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে ইংলিশরা। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে সেমিতে উঠে ইংল্যান্ড।
সেমি ফাইনালে ইংল্যান্ড এর প্রতিপক্ষ ছিল পর্তুগাল। সেই ম্যাচটি সম্ভবত ববি চার্লটনের ইংল্যান্ড জার্সিতে খেলা সবচেয়ে সেরা ম্যাচ ছিল। চার্লটনের করা ২ গোলেই ইউসেবিওর পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠে ইংল্যান্ড।
ফাইনালে জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ইংলিশরা। ৩ গোল করে সেই বিশ্বকাপে ইংলিশদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হোন ববি চার্লটন। তবে পুরো বিশ্বকাপজুড়ে অসাধারণ পারফরম্যান্সের পুরস্কারস্বরূপ তিনি টুনার্মেন্ট সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হোন।
১৯৬৬ বিশ্বকাপের পরই ববি চার্লটন নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম এবং একমাত্র ব্যালন ডি অর জিতেন।
তাছাড়া এর আগের মৌসুমের ক্লাবের হয়ে অনেক ভালো খেলায় ফুটবলার্স রাইটার্স এসোসিয়েশনের বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারও তার নামের পাশে যুক্ত হয়।
বিশ্বকাপ জয়ের পরের মৌসুমেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর হয়ে তৃতীয়বারের মতো লীগ শিরোপা জিতেন ববি চার্লটন। ১৯৬৬-৬৭ মৌসুমে সব মিলিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর হয়ে ৪৪ ম্যাচে ১২ গোল করে ৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ইউনাইটেডকে লীগ শিরোপা জেতানোয় ভূমিকা রাখেন তিনি।
১৯৬৭-৬৮- ক্লাব পর্যায়ে হয়তো ববি চার্লটনের সবচেয়ে সেরা এবং মনে রাখার মতো মৌসুম বোধহয় এটাই। এই মৌসুমের ঠিক ১০ বছর আগে ইউরোপিয়ান কাপ খেলে ফিরে আসার পথেই চার্লটন হারান তার সতীর্থদের, অভিজ্ঞতা করেন তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ স্মৃতি। আর মিউনিখ ট্রাজেডির ঠিক ১০ বছর পরই ইউনাইটেড প্রথমবারের মতো ঘরে তোলে ইউরোপিয়ান কাপ, প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে রেড ডেভিলসরা। ববি চার্লটনের নেতৃত্বেই বেনফিকার বিপক্ষে ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে মাঠে নামে ইউনাইটেড, ৪-১ গোলে জেতা সেই ম্যাচে চার্লটনের পা থেকেই আসে ২ গোল। অধিনায়ক হিসেবে ববি চার্লটন উচিয়ে তুলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাব ইতিহাসের প্রথম ইউরোপিয়ান শিরোপা। তাছাড়া সেই মৌসুমে কমিউনিটি শিল্ডও ঘরে তুলে রেড ডেভিলসরা, লীগ শেষ করে ২য় স্থানে থেকে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর এমন সফল একটি মৌসুমে উজ্জ্বল ছিলেন ববি চার্লটনও। সেই মৌসুমে ৫৩ ম্যাচ খেলে মোট ২০ গোল করেন তিনি, এই পারফরম্যান্সের সুবাদে ব্যালন ডি অর এর রানার্স আপ নির্বাচিত হোন চার্লটন।
এই মৌসুমের পরই শুরু হয় ১৯৬৮ সালের উয়েফা ইউরো। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে যান ববি চার্লটন। ১৯৬৮ ইউরোর স্কোয়াডে ছিলেন তিনি, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড সেবার তৃতীয় স্থানে থেকে ইউরো শেষ করে। সেই টুনার্মেন্টে ২ ম্যাচ খেলে ১ গোল করেন ববি চার্লটন।
১৯৬৮ সালে ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের পরই যেন ছন্নছাড়া হতে শুরু করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দল। গত মৌসুম দ্বিতীয় স্থানে থেকে শেষ করলেও এবার মৌসুম শেষে লীগে ইউনাইটেড এর পজিশন ছিল ১১ তম। পুরো ইউনাইটেড দলের মতো সেবার অনুজ্জ্বল ছিলেন ববি চার্লটন নিজেও। সেই মৌসুমে ৪৮ ম্যাচ খেলে মাত্র ৭ গোল করেন তিনি।
ক্লাবের হয়ে মলীন এক মৌসুম পার করলেও ১৯৬৯ সালে ক্রীড়ার মাধ্যমে দেশকে গৌরবের সাথে প্রতিনিধিত্ব করায় তাকে OBE পদে ভূষিত করা হয়।
আগের মৌসুমের মতো ১৯৬৯-৭০ মৌসুমেও কোনো শিরোপা জিততে পারেনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। সেবার লীগের পয়েন্ট টেবিলের ৮ম স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করে ইউনাইটেড। ঐ মৌসুমে গত মৌসুমের তুলনায় তুলনামূলক ভালো পারফরম্যান্স আসে চার্লটনের কাছ থেকে, ৫৭ ম্যাচ খেলে করেন ১৪ গোল। তবে তার পারফরম্যান্সে বয়সের ছাপ হতে থাকে লক্ষণীয়, ধীরে ধীরে নিজের ধার হারাতে থাকেন তিনি।
১৯৭০ সালের ২১ শে এপ্রিল ১০০ তম বারের মতো ইংল্যান্ডের হয়ে মাঠে নামেন ববি চার্লটন। সেই ম্যাচে ইংল্যান্ডের হয়ে তিনি ৪৮ তম গোলটি করেন। ইংল্যান্ডের হয়ে ববি চার্লটনের ৪৯ তম এবং সর্বশেষ গোলটি আসে ১৯৭০ বিশ্বকাপের পূর্বে আয়োজিত কলম্বিয়ার বিপক্ষে এক প্রস্তুতি ম্যাচে।
১৯৭০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এর হয়ে গ্রুপ পর্বে সব কয়টি ম্যাচ খেলেন ববি চার্লটন। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষেও শুরুর একাদশে ছিলেন তিনি, যতক্ষণ তিনি মাঠে ছিলেন, ততক্ষণ ম্যাচ ছিল ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে। ৬৯ মিনিটে যখন ২-১ গোলে ইংল্যান্ড এগিয়ে থাকে, তখন ম্যানেজার তাকে সাব অফ করেন। তিনি মাঠ ছাড়ার পরই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ হারায় ইংল্যান্ড এবং অতিরিক্ত সময়ে ৩-২ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। ইংল্যান্ডের হয়ে এটিই ববি চার্লটনের সর্বশেষ ম্যাচ ছিল, এই ম্যাচের পরই ৩২ বছর বয়সী চার্লটন জাতীয় দলের হয়ে অবসরের সিদ্ধান্ত নেন।
এদিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর বাজে সময় চলমান থাকে। ববি চার্লটনের ফর্মও পড়তির দিকে যেতে থাকে। ১৯৬৮ সালে ইউরোপিয়ান কাপই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর হয়ে ববি চার্লটনের জেতা সর্বশেষ শিরোপা ছিল। ১৯৭২-৭৩ মৌসুম ববি চার্লটনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর হয়ে পার করা সর্বশেষ মৌসুম। রেড ডেভিলসদের হয়ে চার্লটন সর্বশেষ ম্যাচ খেলেন ১৯৭৩ সালের ২৮ এপ্রিল চেলসির বিপক্ষে। তার কয়েক ম্যাচ আগেই সাউথাম্পটনের বিপক্ষে ববি চার্লটন ইউনাইটেড এর হয়ে ২৪৯ তম এবং সর্বশেষ গোলটি করেন।
১৭ বছরে চার্লটন ইউনাইটেড এর হয়ে ৭৫৮ ম্যাচ খেলে মোট ২৪৯ গোল করেন, জিতেন ৯ টি শিরোপা। ২০০৮ সালে রায়ান গিগস তার রেকর্ড টপকানোর আগ পর্যন্ত তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ফুটবলার ছিলেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন, এখনও ওয়েইন রুনির পর রেড ডেভিলসদের ক্লাব ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি গোল তার পা থেকেই এসেছে।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়ার পর প্রেস্টন নর্থ এন্ড এর হয়ে ২ বছর প্লেয়ার ম্যানেজার হয়ে কাটিয়েছেন তিনি। আইরিশ ক্লাব ওয়াটারফোর্ড এর হয়ে এক মৌসুম খেলার পর ১৯৭৬ সালে দীর্ঘ ২০ বছরের খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানেন তিনি।
১৯৯৬ সালে খেলোয়াড়ি জীবনে তার অবদানের জন্য ব্রিটেন রাণীর কাছ থেকে নাইটহুড পান তিনি, ফলে তার নামের পূর্বে যুক্ত হয় স্যার শব্দ। অবসরের পর উইগান এথলেটিকের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি, দায়িত্ব পালন করেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর ডিরেক্টর হিসেবেও। তার সম্মানার্থে ইউনাইটেড এর হোমগ্রাউন্ড ওল্ড ট্রাফোর্ড স্টেডিয়ামের সাউথ স্ট্যান্ড এর নামকরণ করা হয় "স্যার ববি চার্লটন স্ট্যান্ড" নামে।
হয়তো ১৯৫৮ সালে বাকি ৮ সতীর্থের মতো মিউনিখ ট্রাজেডিতেই প্রাণ যেতে পারতো ববি চার্লটনের। কিন্তু তিনি মিউনিখ ট্রাজেডি থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসে পরবর্তীতে জিতেছেন বিশ্বকাপ, হয়েছেন কিংবদন্তি। তাই বলাই যায়, মিউনিখ ট্রাজেডি জয় করেই তিনি হয়েছেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
- 0 মন্তব্য