অরেলিয়েন শ্যুমেনি:ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে বেড়ে ওঠা এক অক্টোপাস
পোস্টটি ৪১২২ বার পঠিত হয়েছেউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে ১-০ গোলে হারানোর মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ট্রান্সফার উইন্ডোতে লিভারপুলকে আবার হারিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ দলে ভিড়িয়েছে জাতীয় দলে ফ্রান্সের হয়ে খেলা উদীয়মান তারকা অরেলিয়ান শ্যুমেনিকে।মোনাকোর ইতিহাসে কিলিয়ান এমবাপ্পের পর এটিই সবচেয়ে দামী ট্রান্সফার(অ্যাড-অনসহ ১০০ মিলিয়ন ইউরোর চেয়ে একটু বেশি)।যদিও বোরডিয়ক্স থেকে ২০২০ এ মোনাকোতে যোগ দিয়েছেন শ্যুমেনি,২১-২২ মৌসুমেই ক্লাবটিতে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল সময় পার করেছেন। চলুন আগামী মৌসুমে লস ব্ল্যাঙ্কোসের স্কোয়াডে যুক্ত হওয়া নতুন সদস্যের শক্তিমত্তা আর দুর্বলতার বিষয়গুলোকে একটু খুঁটিয়ে দেখি।
বেলজিয়ান কোচ ফিলিপ ক্লেমেন্টের পছন্দের ফর্মেশন হচ্ছে ৪-২-৩-১,তবে তিনি সময়ে সময়ে ৪-৫-১ আর ৪-৪-২ তে ভরসা রেখেছেন।শ্যুমেনি অধিকাংশ সময়ে তার সতীর্থ ইউসুফ ফোফানা বা সেস্ক ফ্যাব্রিগাসের সাথে ডাবল পিভটে "ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার" পজিশনে খেলেছেন।তবে কোচ বাকি দুজনকে ফ্রি "নাম্বার এইট" রোলের মতো স্বাধীনতা দেয়ায় তাকে খানিকটা ডিপ পজিশনেই খেলতে হয়,পাশাপাশি লেফট ফুলব্যাক হেনরিক আর সেন্টারব্যাক অ্যাক্সেল দিসাসি প্রায়ই উপরে উঠে যাওয়ায় রেখে যাওয়া ফাকা জায়গাকেও তিনি মাঝেমধ্যে পাহারা দেন। অবশ্য শেষের দিকের ম্যাচগুলোতে তিনি একাই এই গুরুদায়িত্বের ভার সামলেছেন।
উপরের ছবিতে দেখানো ২১-২২ মৌসুমের হিটম্যাপ দেখে একবারেই বুঝে যাওয়ার কথা তার অক্টোপাস নামের সার্থকতা।কাগজে কলমে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হলেও তার উপস্থিতি মাঠের সবজায়গাতেই।তাকে খানিকটা বক্স টু বক্স ডিএমএফ বললেও মন্দ হয়না।আপনি যদি আগের মৌসুমে মোনাকোর যেকোনো ম্যাচ পুরো ৯০ মিনিট দেখে থাকেন,তাহলে অবশ্যই আপনার মার্সেল দেসাইলির বিখ্যাত টুইটটি "পৃথিবীর ৭১ শতাংশ পানি,আর বাকিটুকু এনগোলো কান্তের দখলে" মনে পড়ার কথা।
পরিসংখ্যানের লড়াইয়ে রিয়াল মাদ্রিদের শীর্ষস্থানীয় মিডফিল্ড ত্রয়ী ক্রুস-ক্যাসেমিরো-মডরিচদেরও ছেড়ে কথা বলছেন না শ্যুমেনি ।বিশেষ করে ওয়ান ভার্সেস ওয়ান চ্যালেঞ্জে শ্যুমেনি বেশ ভালোভাবেই তার নতুন তিন সতীর্থকে ছাড়িয়ে গেছেন(ট্যাকলিংয়ে ৯৯ এ ৭৫)।এই শক্তি শুধু গ্রাউন্ডেই সীমাবদ্ধ নয়,এরিয়ালেও শ্যুমেনি বেশ এগিয়ে(ওপেন প্লে হেডার ৯৯ এ ৯৯)।কেবল ক্যাসেমিরোই শ্যুমেনির কাছাকাছি রয়েছেন।অবশ্য এখানেও "কিন্তু" আছে।প্রতিপক্ষ,টুর্নামেন্টসহ আরো অনেক বিষয় আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।গত মৌসুমে লিগ-১ এও ম্যাচপ্রতি ২.৯ টি ইন্টারসেপশন আর ২.৫ টি ট্যাকল,সাথে ৫.২ টি গ্রাউন্ড ডুয়েল আর ২.২ টি এরিয়াল ডুুুয়েল উইনিং তার দুর্দান্ত হেডিং আর ডিফেন্সিভ সক্ষমতারই পরিচয় তুলে ধরে।তবে কখনো কখনো শুধু সংখ্যা আপনাকে সক্ষমতার সবটুকু পরিচয় দেবেনা,আপনাকে গভীরভাবে ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত এর দিকে নজর রাখতে হবে।
পিএসজির সাথে ৩-০ ব্যবধানে জিতে যাওয়া ম্যাচ থেকে নেওয়া চারটি ছবি শ্যুমেনির নিখুঁত ট্যাকলের একটি উদাহরণ।
প্রথমটিতে দেখা যাচ্ছে মার্কো ভেরাত্তি তার সতীর্থ নেইমারকে পাস দিচ্ছেন,উদ্দেশ্য এক লাইনে থাকা এমবাপ্পে এবং নেইমার যেন ওয়ান টু ওয়ান পাসের মাধ্যমে পরবর্তীতে গোলের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন।দ্বিতীয় ছবিতে নেইমার এমবাপ্পেকে শর্ট পাস দিচ্ছেন,কিন্তু শ্যুমেনির অসাধারণ গেম রিডিং ক্যাপাবিলিটির কারণে তিনি আগেই বিষয়টি বুঝতে পারেন যে,নেইমারের কাছে ওই মুহূর্তে একমাত্র পাসিং অপশন এমবাপ্পে এবং এমবাপ্পে বল পেলে যদি পুনরায় নেইমারকে পাস দিতে সক্ষম হন,তাহলে জোন ১৪ এবং রাইট ফ্ল্যাংক,দুদিকের যেকোনো একদিক দিয়ে পিএসজি আক্রমণ চালানোর পূর্ণ সুযোগ পাবে। কাজেই তিনি এমবাপ্পের ব্লাইন্ড সাইড থেকে এমবাপ্পের দিকে রান নেন।তৃতীয় ছবি অনুযায়ী এমবাপ্পের ফার্স্ট টাচ খারাপ হওয়ায় শ্যুমেনি বলের দখল পেয়ে যান এবং পরবর্তীতে চতুর্থ ছবিতে তার দলকে বলের কন্ট্রোল নিতে দেখা যাচ্ছে।
গত মৌসুমে শ্যুমেনি সেন্টারব্যাক অ্যাক্সেল দিসাসির সাথে দারুণ জুটি গড়ে তুলেছেন,যা দিসাসিকে তার সেরাটুকু দিতে সাহায্য করেছে।যখন এগ্রেসিভ ওয়েতে দিসাসি রক্ষণভাগ ছেড়ে সামনে এগিয়ে যান,ফ্রন্টফুটে তার খেলার কৌশল যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।সামনে আগাতে গিয়ে তিনি পেছনে ফাকা স্পেস তৈরি করেন,যা প্রতিপক্ষকে আক্রমণে বাড়তি সুবিধা দিয়ে থাকে।দিসাসির সাথে শ্যুমেনির (টেলিপ্যাথিক কানেকশনের!)কারণে যখনই দিসাসি সামনে আগান,শ্যুমেনি সাথেসাথেই ফাকা জায়গাটুকু পূরণ করে বিপদের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন।মাদ্রিদের আরেক নতুন সাইনিং রুডিগারের সাথে শ্যুমেনির জুটি দীর্ঘদিনের সার্জিও রামোসজনিত 'অভাব' সমর্থকদের ভুলিয়ে দিতে পারে।প্রশ্ন হচ্ছে "কিভাবে?"
গত কয়েক বছর ধরে রামোস বিল্ড-আপ প্লেয়িংয়ে সবচেয়ে ভালো বল ডিস্ট্রিবিউটর।মাদ্রিদে শেষ সিজনে রামোস ফাইনাল থার্ডে সবচেয়ে বেশি(৭০ টি) পাস খেলেছেন,তারপরেই আছেন টনি ক্রুস(৩৯ টি)।এমনকি লং রেঞ্জ পাসিংয়েও রামোসের একুরেসি সর্বোচ্চ (৯১%),দ্বিতীয়তে ছিলেন ভারানে(৮৩%)।সংখ্যার পার্থক্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে রামোস বল পায়ে কতটা ভালো ছিলেন।রিয়ালের বর্তমান সেন্টারব্যাক জুটি মিলিটাও-আলাবা কেউই বল পায়ে এতটা কমফোর্টেবল নন।রামোস ম্যান টু ম্যান প্রেশারে প্রতিপক্ষের ফার্স্ট লাইনের পিছনে থাকা জায়গাকে সবসময় ব্যবহার করে সামনে আগানোর এবিলিটি রাখতেন,যা এখন কেবল মিলিটাও এর কাছ থেকে কালেভদ্রে দেখা যায়।রুডিগার গত মৌসুমে ফাইনাল থার্ডে ১৩৬ টি পাস খেলেছেন,যা চেলসির খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।থমাস টুখেলের ৩-৪-৩ ফর্মেশনে রুডিগারই কেবল সামনে প্রতিপক্ষের রাখা স্পেসকে কাজে লাগাতেন। ফলে চেলসির হয়ে গত মৌসুমে রুডিগারই সবচেয়ে বেশি প্রোগ্রেসিভ পাস খেলেছেন (১০৪ টি)।রিয়াল মাদ্রিদের ফোর ম্যান ব্যাকলাইনে শ্যুমেনি যদি রুডিগারকে দিসাসির মতো সাপোর্ট দিতে পারেন,তাহলে লস মেরেঙ্গুয়েসের ভক্তরা হয়তোবা অন্য এক রামোসকে দেখতে পারেন।
হেডিংয়ে ৬ ফুট ২ ইঞ্চির শ্যুমেনি রিয়ালের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।কেননা লা লীগায় নিচের সারির দলগুলো সাধারণত বার্সেলোনা কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে লো ব্লকে খেলে থাকে,কাজেই প্রতিপক্ষের রক্ষণব্যূহ ভেদ করা যথেষ্ট কঠিন হয়; একবার গোল হজম করে বসলে আবার গোল করে ম্যাচে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।তার উপর দলে বেনজেমা,ক্যাসেমিরো আর মিলিটাও বাদে হেডিংয়ে কেউই ততটা দক্ষ নন।ফলে প্রতিপক্ষের বক্সে শ্যুমেনির লেট রান কিংবা সেট পিসে তার উপস্থিতি-রিয়াল নিঃসন্দেহে বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাবে।আবার প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলে আগ্রাসন ঠেকাতে ফাইভ ম্যান ব্যাকলাইন গঠনে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকেই সেন্টারব্যাকের ভূমিকা পালন করতে হয়,সেক্ষেত্রে শ্যুমেনির উপরে দায়িত্ব থাকলে রিয়ালের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
শুটিংয়ে টনি ক্রুসের সাথে শ্যুমেনির কিছুটা সাদৃশ্য আছে।ডিবক্সের হাফ সার্কেল থেকে শুট করলে অধিকাংশ সময়েই বল জালের ঠিকানা খুজে নিয়ে থাকে।
তবে হাফ সার্কেল থেকে দূরে লং রেঞ্জের শুটিংয়ে শ্যুমেনির অবস্থা উপরের ছবির মতোই তথৈবচ,বেশিরভাগ সময়ই বল পোস্টের অনেক বাইরে দিয়ে চলে যায়।
ট্রান্সফার মার্কেটে তার উপর শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোর নজর কেবলমাত্র ডিফেন্সিভ কোয়ালিটির কারণে নয়। চান্স ক্রিয়েশনসহ ফাইনাল থার্ডে নাম্বার টেন কিংবা স্ট্রাইকারদের বল প্রোভাইডে শ্যুমেনি সমান পারদর্শী। অবশ্য প্রতিপক্ষের ডিবক্সে মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও ভালভার্দে বা মডরিচের মতো বল নিচে থেকে উপরে নিজেই নিয়ে যাওয়ার চাইতে বল মাইনাস করে সতীর্থদেরকে আক্রমণের সুযোগ করে দিতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
দুর্বলতার দিকগুলোর ব্যাপারে বলতে গেলে প্রথমেই যে ব্যাপারটি উঠে আসে,তা হলো তার পজিশনিং সেন্স এবং অপ্রয়োজনীয় ট্যাকলের দিকটি।শ্যুমেনি তার পজিশন ধরে রাখার চাইতে বলের কাছাকাছি থাকাকে বেশি প্রাধান্য দেন।ফলে উপরের ছবির মতো প্রায়ই তাকে মাঠের একদিকে সরে আসতে দেখা যায়,যা মাঝমাঠে তার দলকে আউটনাম্বারড করে ফেলে এবং প্রতিপক্ষ দলকে আক্রমণ শানানোর পুরো সুযোগ করে দেয়।
প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে এভাবে ডিবক্সে ফাউল করলে যে পেনাল্টি হজম করতে হয় তা সবারই কমবেশি জানার কথা।শেষ মুহূর্তে এরকম পেনাল্টি ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।অথচ সেসময়ে ডিবক্সে যথেষ্ট খেলোয়াড় ছিল,যারা শ্যুমেনিকে ছাড়াই আক্রমণটি ঠেকিয়ে দিতে পারতেন।আনচেলত্তি নিশ্চয়ই এব্যাপারে তার শিষ্যের সাথে বেশ সময় নিয়ে কাজ করবেন।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে প্রতিপক্ষের ধারাবাহিক প্রেসিংয়ে বল পায়ে রাখা এবং নিজ দলের খেলোয়াড়দেরকে প্রয়োজনমত বলের যোগান দেওয়া।ড্রিবলিং করে বল সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শ্যুমেনি মোটেই কার্যকরী নন।প্রেস রেজিস্ট্যান্স হলেও দলের প্রয়োজনে ক্রুস বা মডরিচের মতো ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকবেন।ক্রুসের মতো ৪০-৫০ গজ দূরে নিখুঁত পাস কিংবা মডরিচের মতো ড্রিবল করে প্রতিপক্ষকে বোকা বানানো-কোনোটাতেই শ্যুমেনি তাদের ধারেকাছেও নেই।কাজেই মাঠের সবজায়গাতেই তার উপস্থিতি থাকা বা ভার্সেটাইল প্লেয়ার হিসেবে খেলার যোগ্য হলেও তাকে ট্র্যাডিশনাল নাম্বার এইটের চাইতে নাম্বার সিক্সে খেলানো হলে রিয়াল মাদ্রিদ তার কাছ থেকে সর্বোচ্চটা আদায় করে নিতে পারে।
যখন অরেলিয়ান শ্যুমেনিকে নিয়ে আলোচনা হয়,রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের চোখে ভেসে ওঠে ফেদে ভালভার্দে আর এডুয়ার্ডো কামাভিঙ্গার সাথে গড়ে উঠেছে এক নতুন ত্রয়ী,যারা ক্রুস-ক্যাসেমিরো-মডরিচের মতো আবার ফুটবল দুনিয়ার মাঝমাঠ শাসন করে বেড়াচ্ছে।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ফুটবলবোদ্ধাদের আলোচনা-সমালোচনাই বলার অপেক্ষা রাখে না,তার কাছ থেকে রিয়াল ভক্তদের প্রত্যাশার পারদ কতটা উচুতে।বার্নাব্যু হয়ত তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাবে, সাদা জার্সি পরে খেলার স্বপ্ন পূরণ করে দেবে,কিন্তু তার উপর রাখা আস্থার প্রতিদান তিনি দিতে পারবেন কিনা,তার উত্তর সময়ই আমাদের জানিয়ে দেবে।
(কিছু ছবি এবং তথ্য "দ্য অ্যাথলেটিকস" থেকে সংগৃহীত)
- 0 মন্তব্য