মার্সেলো বিয়েলসা - দ্যা ম্যাড ম্যান অফ ফুটবল
পোস্টটি ১৫৭৯ বার পঠিত হয়েছেপেপ গার্দিওলা বার্সেলোনার কোচ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ছুটে গিয়েছিলেন শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকের কাছে। পচেত্তিনো, জিদান, এন্টনিও কন্তে, এমনকি ডিয়েগো সিমিওনে পর্যন্ত তার কাছে কোচিংয়ের বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ এবং তার ওয়ার্কশপ সেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অ্যাটাকিং ফুটবলের সাথে প্রেসিং এর সমন্বয় ঘটিয়ে একটি নতুন ব্র্যান্ড হিসেবে পরিণত করেছিলেন তিনি। যার কাছে দিনের ২৪ ঘণ্টা মানেই হলো ফুটবল। ছুটির দিনগুলোতে তিনি গড়ে ১৪ ঘণ্টা করে ব্যয় করতেন ফুটবলের বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপ দেখে, ফুটবলের বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে। এমনকি খেলা দেখার সময় নোট টুকে রাখার জন্যে কাজে লাগাতে নিজের শ্বশুরকেই। ফুটবলকে রাখতেন সবকিছুর উপরে। এমনকি ফিফার অ্যাওয়ার্ড শো গুলোতেও হাজির হতে ট্র্যাকসুট পড়ে।
অন দ্যা ফিল্ড তার টাক্টিক্স এবং প্ল্যান ইম্প্লিমেশনে দেখা গেছে নানা সৃজনশীল পদ্ধতি।যাকে মডার্ন ফুটবলের মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সড কোচ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি মার্সেলো বিয়েলসা। আর্জেন্টিনায় তাকে সবাই ভালোবেসে ডাকেন 'এল লোকো' নামে যার অর্থ পাগল।
বিয়েলসার জন্ম ১৯৫৫ সালে জুলাই মাসে আর্জেন্টিনার রোজারিওতে। এই শহরে জন্ম হয়েছে মেসি, ডি মারিয়াদের মতো ফুটবলারদের।ছোটবেলার থেকেই ছিলো ফুটবলের প্রতি অবিরাম ভালোবাসা। যার ফলস্বরূপ নিজের ক্যারিয়ারের শুরু হয় লোকাল ক্লাব নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবের হয়ে। পেশাদারী জীবনে খেলতেন ডিফেন্ডার পজিশনে। কিন্তু পায়ে যথেষ্ট স্পিড না থাকার কারণে নিজেই নিজের উপর প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন তিনি। যার ফলে বেশি দূর থিতু হতে পারেনি প্লেয়িং ক্যারিয়ার। মাত্র ৬৫ ম্যাচ খেলে বুট জোড়া তুলে রাখেন বিয়েলসা।তখন কে জানতো? এই স্পিড, প্রেসিংকেই তিনি এক সময় বানাবেন নিজের প্রধান হাতিয়ার?
পায়ে ফুটবলের সেই গুণ না থাকলেও শরীরের প্রতিটি শিরা এবং ব্রেইন জুড়ে ছিল একটা জিনিস - সেটা হচ্ছে ফুটবল।
কোচিং ক্যারিয়ার:
কোচিং রোল হিসেবে তাঁর হাতেখড়ি হয় মূলত বুয়েন্স আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল দলের হয়ে। বুয়েন্স আয়ার্সের বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক দল বাছাইয়ে সর্বপ্রথম সবাইকে চমকে দেন তিনি। মাত্র ২০ জনের দল গঠনের জন্য তিনি ৩০০০-এর বেশি খেলোয়াড় চেখে দেখেন যা রীতি মতো অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে আপনার।
তারপর সেখান থেকে ১৯৮০ সালে নিজের লোকাল ক্লাব নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজের যুব দলের দায়িত্ব গ্রহন করেন। এই দায়িত্বের ভার সামলান ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। মূলত এখানেই প্লেয়ার স্কাউটিং এর জন্যে রীতিমতো পাগলামি কাজ কর্ম শুরু করেছিলেন বিয়েলসা। বিয়েলসা খেয়াল করে দেখলেন পাইপলাইন থেকে খেলোয়াড় একদমই উঠে আসছে না। উপায় বের করতে আর্জেন্টিনার ম্যাপ নিয়ে বসলেন। পুরো আর্জেন্টিনাকে ভাগ করলেন ৭০ ভাগে। নিজের "পুরনো ফিয়াট-১৪৭" চালিয়ে প্রতিটি ভাগে গিয়ে গিয়ে ট্রায়াল শুরু করে খেলোয়াড় তুলে আনতে লাগলেন।
তিনি তার কাজকে এতোটাই ভালোবাসতেন এবং দায়িত্বের সাথে পালন করতেন তার আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে - একবার রাত ২ টায় নিজ বাড়ি থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে অবস্থিত একটি বাসায় গিয়ে হাজির হলেন । অনেক খোঁজ করে একজনের ব্যাপারে জানতে পারেন। ট্রায়ালের জন্যে তিনি শুধু তার পা গুলো দেখতে চেয়েছিলেন। জানেন সেই প্লেয়ারটির নাম কি? আজকের মরিসিও পচেত্তিনো।
পচের ভাষ্যমতে সেই রাত তার জীবন বদলে দিয়েছিলো। তার এই স্কাউটিং প্রজেক্ট থেকে একে একে বের হয়ে এসেছে - বাতিস্তুতা- আয়ালা-পচেত্তিনো-ওয়াল্টার স্যামুয়েল-জানেত্তি-সিমিওনে সহ আরো বেশ কিছু বিখ্যাত নাম।
নিজ কাজের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে ১৯৯০ সালে ওল্ড বয়েজের মূল দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ পান। দায়িত্ব নেবার প্রথম সিজনে লাতিন আমেরিকার চ্যাম্পিয়নস লিগ'-খ্যাত কোপা লিবার্তাদোরেসের এক ম্যাচে সান লরেঞ্জোর বিপক্ষে ৬-০ গোলের লজ্জাজনক হারের মুখ দেখে তার দল। এ সময় তিনি এতোটাই ফ্রাস্ট্রেটেড ছিলেন যে নিজেকে শে**ষ করে দেওয়ার চিন্তাও করে। এদিকে বাহিরে কিছু আল্ট্রাস সমর্থক তার বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল। ক্ষুব্ধ বিয়েলসা এবার গ্রে'নে **ড হতে নিয়ে বের হয়ে তাদের চলে যাবার হু"ম*কি দেয়। তার ডাক নাম এল লোকো হবার পেছনে এই ঘটনাটি ছিল অন্যতম একটি কারণ।
পরের সিজনে সেই কোপা লিবার্তাদোরেসের ফাইনালে নিয়ে যান নিজের দলকে। কিন্তু ভাগ্যের কাছে হেরে বসেন তিনি। সাও পাওলোর কাছে পেনাল্টি শুট আউটে হারতে হয় বিয়েলসাবাহিনীকে। দুই মৌসুমে টানা লিগ শিরোপা জিতালেও এবার তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।
১৯৯৩ সালে আর্জেন্টিনা ছেড়ে এবার দায়িত্ব নেন মেক্সিকোর ক্লাব অ্যাটলাসের। সেখানেও তার একই দায়িত্বশীলতা, একই ফিলোসফির প্রয়োগ। সেই সময় সেখান থেকে বের করেন একঝাঁক তরুণ মেক্সিকান প্রতিভা। যার ফল পরবর্তীতে ভোগ করে মেক্সিকো।
মেক্সিকোতে ৩ বছরে অ্যাটলাস এবং ক্লাব আমেরিকার কোচ হিসেবে থাকার পর ১৯৯৭ সালে ফিরে আসেন আর্জেন্টিনাতে। এবার গন্তব্য ভেলেজ সার্সফিল্ড। প্রথম প্রেস কনফারেন্সে ৫১ টি ভিডিও ক্লিপের বিশ্লেষণ করে আবারো শিরোনামে উঠে আসেন তিনি। সেই সময় দাবি করলেন একজন কম্পিউটার অ্যানালাইসিসের।সেই মৌসুমে লিগ শিরোপা নিজেদের ঘরে তুলে সার্সফিল্ড।
জাতীয় দলের অধ্যায়ের সূচনা:
আর্জেন্টাইন লিগে ৩ মৌসুমে দুইটি ভিন্ন দলের হয়ে তিনবারই লিগ ঘরে তুলেন এল লোকো। এই ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখে আর্জেন্টিনা ১৯৯৮ সালে তাদের জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেন তাকে। তার সবচেয়ে বড় অ্যাসাইনমেন্ট ছিলো ২০০২ বিশ্বকাপ। যেখানে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। আর্জেন্টিনার বিদায়ের ঘণ্টা বাজে গ্রুপ পর্ব থেকেই। তবুও এল লোকোর উপর আস্থা ছিল ফেডারেশনের। সেই যাত্রায় তার চাকরি বেঁচে যায়। নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজের ইয়ুথ প্রজেক্ট থেকে উঠে আসা সিংহভাগ প্লেয়ারই ছিলেন তখনকার জেনারেশনের আর্জেন্টিনার ভরসার প্রতীক।
কথায় আছে না? খাঁটি জহুরি কখনো হীরা চিনতে ভুল করেনা? ২০০৩ সালে রিভারপ্লেট সাইন করে হাভিয়ের মাশচেরানোরকে। তখনো তার মূল দলে অভিষেক হয়নি। তখনকার আনকোড়া মাশচেরানোরকে কেউ ঠিক মতো না চিনলেও তার ব্যাপারে আদ্যোপান্ত ইতিহাস বের করে আনেন বিয়েলসা। ক্লাব কর্তৃপক্ষকে জানান তার কথা এবং তার হস্তক্ষেপে সেই বছরেই ক্লাব অভিষেকের আগেই উরুগুয়ের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়ে যায় মাশচেরানোর।
২০০৪ সাল ছিলো তার জন্যে একটি ট্রেডমার্ক ইয়ার। সেবছর কোপা আমরেরিকাতে গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে ভালো খেললেও ফাইনালে পরাজয় বরণ করতে হয়ে ব্রাজিলের কাছে; পেনাল্টি শুট আউটে ৪-২ তে হারে আর্জেন্টিনা। একই বছর অলিম্পিক ফুটবলে অংশ নেয় আর্জেন্টিনা। উরুগুয়ের পর প্রথম লাতিন আমেরিকা দল হিসেবে ফুটবলে গোল্ড মেডেল জিতে আর্জেন্টিনার। সেটাই ছিল আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে সবচেয়ে বড় অর্জন। পরবর্তীতে হোসে পেকারম্যান তাকে রিপ্লেস করেন।
২০০৭ সালে চিলির কোচ হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এখানেও তার পরিচিত ধারা বজায় রাখেন। চিলি পায় ক্লাদিও ব্রাভো, আর্তুরো ভিদাল, গ্যারি মেডেল, ইসলা, অ্যালেক্সিস সানচেজ দের মতো এক ঝাঁক প্রতিভাবান প্লেয়ার। এদের নিয়ে ১৯৯৮ সালের পর প্রথমবারের মতো ২০১০ বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায় চিলি। সেবার ১২ বছর পর খেলতে এসেই পরের রাউন্ডে উঠে চিলি যা ছিলো এক বিরাট অর্জন। ব্রাজিলের কাছে হেরে থেমে যায় স্বপ্নযাত্রা।
২০১১ কোপা আমেরিকার পর চিলি ফুটবল ফেডারেশনের সাথে বনিবনা না হওয়ায় দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন বিয়েলসা। যাওয়ার আগে অবশ্য চিলির ইতিহাসে সবচেয়ে সফল কোচ হিসেবে নাম লিখিয়ে যান। ৬৬ ম্যাচে ৩৪ জয় নিয়ে বিয়েলসার সময়ে চিলির শতকরা জয় ছিল ৫১.৫%! লোকে হয়তো বলবে চিলির সাফল্যের পেছনে বেশি অবদান সাম্পাওলির। কিন্তু চিলিবাসী ঠিকই জানে এল লোকোর অবদান। আংসাং রোল প্লে করে উঠিয়ে এনেছিলেন একটা জেনারেশন কে যারা পরবর্তীতে জেতে কোপা আমেরিকা।
ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে পদচারণা:
চিলি ফুটবল দলের দায়িত্ব ছাড়ার পর বিয়েলসা যোগ দেন স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ে। সেখানে ২ মৌসুমে বিলবাও ফ্যানদের উপহার দেন তার ট্রেড মার্ক ফুটবল স্টাইল। সেখান থেকেও তিনি বের করে আনেন কিছু সিস্টেমেটিক প্লেয়ার - এন্ডার হেরেরা, জাভি মার্টিনেজ, ফার্নান্দো লোরেন্তে, ইটুরাস্পে, মুনিয়ান ইত্যাদি। ২০১১/১২ এর সেই মৌসুমে লিগে ১০ম এবং কোপা দেল রে ও ইউরোপা লিগে রানারআপ হয় বিলবাও। পরের মৌসুমে তেমন সুবিধা করতে না পারায় সেই দায়িত্ব থেকে সরে আসেন তিনি।
সেখান থেকে ২০১৪ সালে মাত্র ১২ মাসের জন্যে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ফ্রান্সের মার্শেই এর। তখন দলের টালমাটাল অবস্থা থেকে লিগে চতুর্থ পজিশনে নিয়ে আসেন তিনি। সেই মৌসুমে কায়েনের সাথে এক ম্যাচে ১-০ হারের পর হুট করেই নিজের উপর রাগ করে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তার পদত্যাগের পর মার্শেই প্রেসিডেণ্ট Vincent Labrune আফসোস করে বলেছিলেন - "আমার কাছে মনে হয়েছিল আমরা ১২ মাসের জন্যে মেসিকে সাইন করিয়েছিলাম।"
নিজের নীতি, ইচ্ছা, প্ল্যান প্রজেক্টের সাথে কখনো আপোষ করেন নি বিয়েলসা। তাই তো ২০১৬ সালে দায়িত্ব নেবার ৩ দিনের মাথায় লাৎজিও দলের কোচের পদ থেকে সরে আসে কারণ ক্লাব কর্তৃপক্ষ তার ডিমান্ড পূরণ করতে পুরো রাজি হয়নি।
বিয়েলসার কোচিং ক্যারিয়ারে নোটেবল একটা অর্জন হচ্ছে লিডস ইউনাইটেড কে প্রিমিয়ার লিগে ব্যাক করানো। ২০১৮ সালে দায়িত্ব নেবার আগে ১৪ বছরে ১১ বার কোচ চেঞ্জ করেছিলো লিডস। তবুও ভাগ্য বিধাতা তাদের দিকে মুখ ফিরে তাকাননি। দায়িত্ব নেবার প্রথম মৌসুমে অল্পের জন্যে প্রমোশন মিস করলেও পরেরবার আর মিস করেননি। চ্যাম্পিয়নশিপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ার লিগে প্রত্যাবর্তন ঘটে লিডসের। লিডস শহরের প্রতিটা মানুষ বিয়েলসাকে মনের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসে। প্রমোশন পাবার পর রাস্তায় সমর্থকদের সাথে আনন্দ উদযাপনে মেতে উঠার মুহূর্ত যেনো এক সোনালী অতীত। লিগে প্রথম মৌসুমে ১০ম হয়ে সবার নজরে নতুন করে আসেন তিনি। তবে পরেরবার (সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে) ইঞ্জুরিজর্জরিত লিডস নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারেননি। দলীয় ব্যার্থতার জন্যে সরে দাঁড়ান পদ থেকে।
ট্যাকটিকাল ফিলোসফি:
বিয়েলসার ফিলোসফি এক কথায় একদম সহজ - আপনাকে সবসময় নিরলসভাবে বলের পেছনে ছুটতে হবে, পজিশন হারালে প্রতিপক্ষকে মারাত্মকভাবে প্রেস করতে হবে এবং পজেশন বেজড ফুটবল অসম্ভব গতিতে খেলতে হবে। এই ফিলোসফি আপাতত দৃষ্টিতে সহজ হলেও এটা ইমপ্লিমেন্ট করার জন্যে অনেক বেশি স্ট্যামিনা এবং টেকনিক্যাল অ্যাবিলিটির দরকার হয়। উনার পছন্দের ফরমেশন হচ্ছে ৩-৩-১-৩ যা প্রথমে ৪-২-৩-১/৪-৩-৩/৪-১-৪-১ ফরমেশনে লুকায়িত থাকে। এই ৩-৩-১-৩ ফরমেশনে ব্যাক লাইনে একটা এক্সট্রা সেন্টারব্যাক এনে থ্রি ম্যান ব্যাকলাইনে কনভার্ট করা হয়। যাতে উপরের দিকে উইংব্যাক এবং ওয়াইড মিডফিল্ডারগুলো ওপেন স্পেস পেয়ে অ্যাটাক করতে পারে। এই সিস্টেমে অটোমেটিকালি প্রেস করা সহজ হয়ে যায়।
এখানে ব্যাকলাইনে মিডম্যানকে একটু নিচের দিকে খেলানো হয়। এই ধরনের ডিফেন্ডারদের বলা হয় লিবেরো। লিবেরো হচ্ছে একজন ভার্সেটাইল সেন্টারব্যাক যিনি ডিফেন্স লাইনের একটু পেছন থেকে পুরো ডিফেন্স কন্ট্রোল করেন, পুরো ব্যাকলাইনকে নেতৃত্ব দেন এবং প্রয়োজন হলে সুইপিং রোল প্লে করতেও দ্বিধাবোধ করেনা। এই ধরনের ডিফেন্ডারদের পাসিং একুরেসি ভালো হয়ে থাকে। এটি খুবই পুরাতন এবং বিলুপ্তপ্রায় একটি রোল। ব্যাকলাইনের তিনজন এবং তাদের সামনে দুইজন উইংব্যাক মিলে একটি অর্ধচাঁদ আকৃতির সৃষ্টি করে । এই আকৃতির মাঝে একজন মিডফিল্ডার বলমেকিং করার জন্যে থাকেন। তার রোল অনেক সময় ডিপলাইয়িং মিডফিল্ডারের মতো থাকে আবার অনেকসময় স্পেস কাভার করে ডিফেন্ড করে ব্যাকলাইনকে সাপোর্ট করে।
বিয়েলসার এই ট্যাক্টিক্সে দুইজন উইংব্যাক খুবই ভার্সেটাইল হয়ে থাকে।এই উইংব্যাকরা যেমন উইঙ্গারের সহায়তায় ওভারল্যাপ করে একইভাবে উইঙ্গারদের সাথে উপরের দিকে প্রগ্রেস করতে থাকে। এতে করে সামনে থাকা ১ জন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার এবং তিনজন ফ্রন্টলাইনার সহ মোট ৫ জন প্লেয়ারের একটা ওভারলোড তৈরি হয়। উপরের দিকে যে ৩ জন ফ্রন্ট লাইনে থাকেন, তাদের পেছনে একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার থাকে যাকে স্প্যানিশ ভাষায় বলা হয় এনগানশে। এটি এমন একটি রোল যেখানে মিডফিল্ডারদের সাথে ফরওয়ার্ড লাইনের সেতুবন্ধন করা হয়। এনগানশে মূলত ফ্রি রোল প্লে করে স্পেস ক্রিয়েট করে গোল করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এই গোটা সিস্টেম একটি ত্রিভুজ আকৃতি তৈরি করে যেখানে বল পজেশন, পাসিং, ওভারল্যাপিং, প্রেসিং - সবকিছুই একটা নির্দিষ্ট সিস্টেমে হয়ে থাকে।
অ্যাথলেটিক বিলবাও থাকাকালীন তিনি ৩-৩-১-৩ ফর্মেশনের পরিবর্তে ৪-২-১-৩ ফরমেশন ইউজ করেন যেখানে ডিফেন্স লাইনে ৪ জন ২ জন মিডফিল্ডার, সামনে একজন এনগানশে এবং উপরের যথারীতি তিনজন ফ্রন্ট প্লেয়ার থাকেন। ফরমেশন চেঞ্জ হলেও তার খেলার মূলনীতি ছিলো একই।
বিয়েলসার ট্রেনিং সেশন নিয়েও রয়েছে বেশ মজার কাহিনী। অনেকে তার এই সেশনকে কমান্ডো ট্রেনিং এর সাথে তুলনা করেছেন। এমনকি একবার ম্যাচের আগে গভীর রাত অবধি ট্রেইনিং করানোর নজিরও আছে তার। প্র্যাকটিস সেশনে ভালো ভিউ পাবার জন্যে একবার গাছের উপরে পর্যন্ত উঠে সবাইকে তদারক করেছিলেন তিনি।
এই ভদ্রলোকের মতো পাগলা ফুটবল লাভার হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তিনি সবসময় নিজের ফিলোসফিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কখনো নিজের নীতির বিরুদ্ধে আপোষ করেন নি যার জ্বলন্ত উদাহরণ লাৎজিওর সেই ইস্যু। এই কারণে হয়তো কখনো কোনো ক্লাবে বেশিদিন থিতু হতে পারেননি। বড় কোনো ক্লাবেও যাবার সুযোগ হয়নি।
জগতে যুগে যুগে অনেক মানুষ আসে কোনো না কোনো বিষয়ে নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটাতে। তারা নিজেদের অর্জন কিংবা সাফল্যের কথা চিন্তা করেন না, নিজেদের ধ্যান ধারণা কে বাস্তবে প্রয়োগ করে নতুন নতুন উপায় বের করার চেষ্টা করেন। ফুটবলেও এমন কিছু ক্যারেকটার আছেন যারা কখনো সাকসেস ওরিয়েন্টেড ক্যারিয়ারকে পাত্তা দেয়নি, নিজেদের নীতি, উদ্দেশ্য এর জন্যে। বিয়েলসা, রাংনিক, সাচ্চী, রাইনাস মিশেল - এরা হচ্ছে এমন কিছু ক্যারেকটার।
তবে এদের রেখে যাওয়া ফিলোসফি ফুটবলকে নিয়ে গেছে আরেকধাপ উপরে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জন্যে হয়েছে আনন্দের এক বিশাল খোরাক।
- 0 মন্তব্য