• ক্রিকেট

বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দর্শনের গলদ কোথায়?

পোস্টটি ৯০৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি খেলার বয়স প্রায় ষোল বছর; দীর্ঘ এ যাত্রায় বাংলাদেশীয় আদলের টি-টোয়েন্টি খেলার ফলাফল নিঃসন্দেহে ভয়াবহ খারাপ। দেড় যুগের বেশি সময় ধরে টি-টোয়েন্টি খেলা একটি দল টি-টোয়েন্টি আঙিনায় নিজেদের প্রমান করতে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছে৷ প্রাচীন টি-টোয়েন্টি ব্যাকরণ মস্তিষ্কে ধারণ করে বর্তমান সময়ের টি-টোয়েন্টি খেলা চালিয়ে যাওয়া স্রেফ বোকার স্বর্গে বাস করার মতো৷ কারণ আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের রঙ বদলেছে, বদলেছে টি-টোয়েন্টি দর্শন ; ১৩০-১৪০ রান করে টি-টোয়েন্টি জেতার দর্শন এখন সমূলে উৎপাটিত হয়েছে। 

FB_IMG_1659871399272

 

বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টির দৈন্যদশার মূল কারণ খুঁজতে গেলে শুরুতে দেখতে হবে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিলীগের আমলনামা। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি লীগ বলতে "বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ" (বিপিএল) এর নামই সর্বাগ্রে উচ্চারিত হবে ; বাকী টি-টোয়েন্টি লীগগুলোর সার্বিক অবস্থা নাজেহাল, নেই কোনো নির্দিষ্ট শিডিউল; কালেভদ্রে দেখা দেয় এই লীগগুলো৷ 

বিপিএল নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই; পিচ, আম্পায়ারিং কিংবা ফ্রাঞ্জাইজির মালিকানা নিয়ে হট্টগোল লেগেই থাকে৷ সমালোচনার সিংহভাগ থাকে পিচ নিয়েই; ১২০-১৩০ রানের মামুলী সংগ্রহ করে টি-টোয়েন্টি জিতে যাওয়ার ধারণাটা এখান থেকেই উদ্ভূত হয়;  যে ধারনার প্রভাব জাতীয় পর্যায়ের টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও দেখা যায়। ফলাফল ঘরের মাঠে স্লো-স্কোরিং পিচে কোনোমতে পার পাওয়া গেলেও অ্যাওয়ে সিরিজগুলোতে নিজদের দৈন্যদশা উজ্জ্বলতার সাথে ফুঁটে উঠে৷ ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে স্লো পিচে ধবলধোলাই করে বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের সাথে হেরে যাওয়াটাই বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দর্শনের ক্যান্সারকে ফুঁটিয়ে তুলে।  

 

মোটাদাগে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দুর্বলতা বলতে বুঝানো হয়; এখানে কোনো 'স্ট্রং মাসলের কেউ নেই', 'ছয় মারার মতো বডি স্ট্রাকচার নেই',

আদৌ মাসল-পাওয়ার টি-টোয়েন্টির সাথে সামঞ্জস্য কিনা সেটা তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু প্রায় একই বডি স্ট্রাকচার, মাসল নিয়ে দিব্যি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে রাজত্ব করছে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের বেলায় কেন মাসল বিড়ম্বনা?  

 

ঘরের মাঠের টি-টোয়েন্টি সিরিজগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এখানে হাই-স্কোর দেখা দেয় কালেভদ্রে; বেশিরভাগ ম্যাচই হয় লো-স্কোরিং।  ফলে ক্রিকেটারদের টি-টোয়েন্টি দর্শন, মাইন্ডসেট লো স্কোরিং দর্শনের দিকেই প্রতিফলিত হয় ; অ্যাওয়ে সিরিজে যখনি তাদের সামনে ১৬০-১৭০ কিংবা ১৮০+ রানের টার্গেট দেওয়া হয় তখনি তাঁদের দৈন্যদশা ফুঁটে উঠে।  আদৌত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট যতোটা পাওয়ার-হিটিংয়ের খেলা ঠিক ততোটাই এটি মানসিকতার খেলা।  

পাওয়ার-হিটারের প্রসঙ্গে আসার আগে দেখতে হবে, ঘরোয়া টি-টোয়েন্টির খবরাখবর ; যতদূর জানা যায়, এখানে প্রতিনিয়ত লো-স্কোরিং, বাজে পিচে অনবরত খেলা চলছে ; ফলে পাওয়ার-হিটার খুঁজে না পাওয়ার হাহাকার লেগেই থাকে। মূলত বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পাওয়ার-হিটার খুঁজে না পাওয়ার মূল রহস্য এখানেই নিহিত৷ 

 

১২০-১৩০ রানের পিচ থেকে পাওয়ার-হিটার খুঁজে বের করার অলীক স্বপ্নে বিভোর ক্রিকেটের কর্তারা অথচ একই সময়ে আফগানিস্তানকে দেখা যায় ভিন্ন পথে হাঁটতে; তাঁদের ঘরোয়া লীগগুলোতে প্রতিনিয়ত ১৮০-১৯০ কিংবা ২০০+ রানের ম্যাচ দেখা যায়, ফলাফল পাওয়ার-হিটার উৎপাদনে তারা সঙ্গত কারণেই এগিয়ে আছে, থাকবে। রাহমানুল্লাহ গুরবাজ, নাজিবুল্লাহ জাদরানদের পাওয়ার হিটার তকমটা আসলে ঘরোয়া লীগের কারণেই এসেছে৷ 

 

বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ম্যাচের পর যে বেদবাক্যগুলো শুনতে হয় তা অনেকটা এরকম- 

'আর ১৫-২০ রান বেশি হলে আমরা জিততাম', 'যদি আরলি উইকেট না হারাতাম, আমরা জিততাম','যদি ওই শটটি ক্যাচ না হয়ে বাউন্ডারি হতো তাহলে আমরাই জিততাম' 

এমন আক্ষেপাত্মক বাক্যগুলো হরহামেশাই এ দেশীয় দর্শকদের শুনতে হয়। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়; আক্ষেপাত্মক বাক্যগুলোর কোনো পরিবর্তন হয় না। 

 

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মানসিকতার প্রশ্নেও বাংলাদেশ এগিয়ে থাকার চেয়ে, ঢের পিছিয়ে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ হতে পারে অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের কথায়- 

"আমার মনে হয় এক-দুইটা ম্যাচ যদি জেতা যেত তাহলে দলের আত্মবিশ্বাসটা আরও ভালো থাকতো।  যেরকম অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সিরিজের সময় ড্রেসিংরুম উৎফুল্ল ছিল" 

একটা-দুইটা ম্যাচ জিতে ফেইক-আত্নবিশ্বাস অর্জন করে ক্ষত স্থানে সাময়িক প্রলেপ দেওয়া যায় বটে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতার জন্য গোড়ার আগাছা পরিষ্কার না করলে ম্যাচের পর ম্যাচ এভাবেই ধুঁকতে হবে৷ 

 

বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে জস বাটলার নেই, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল নেই, ডেভিড মিলার নেই, লোকেশ রাহুল নেই; এসব নিয়ে রীতিমতো আক্ষেপ  কিংবা হাহাকার শোনা যায়;  কিন্তু ভবিষ্যত জস বাটলার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল তৈরিতে কিংবা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁদের তুলে আনার মতো পর্যাপ্ত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, প্রসেস,  পিচ কন্ডিশন, মাইন্ডসেটের ব্যাপারে বিসিবির নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা কতটুকু সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ কেবল সাময়িক পরিকল্পনা করে দু-এক ম্যাচে সফলতা অর্জন করা যাবে বটে ; কিন্তু বছরের পর বছর বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের মিডিওকোর দল হিসেবেই খেলে যেতে হবে৷ 

 

"সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা?" প্রাবন্ধিক বেগম রোকেয়ার মুখনিঃসৃত বাণীর সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে বলতে হয়, বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দর্শনের গোড়ায় যে আগাছা দেড় যুগ ধরে দানা বেঁধেছে, তা সমূলে পরিষ্কার না করে সাময়িকভাবে টি-টোয়েন্টিতে ভালো করা সম্ভব কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য যে সহসা ধরা দিবেনা তা অনুমেয়..