• ফুটবল

ভালোবাসা দিবসে ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় উপহারের গল্প

পোস্টটি ৬৮৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারের বাড়ানো বলটা নিখুঁত ছিলো , দুর্দান্ত গতি নিয়ে দৌড়ে আসা ১১ নং জার্সি ধারী যে মানুষটা বলটা পেলেন তিনি ভুল করবেন না , ফাইনালে তো অবশ্যই না.. 

বাম পায়ের সুন্দর স্পর্শ , ফরাসি গোলরক্ষক হুগো লরিস পরাস্ত হলেন...

আনহেল ফাবিয়ান ডি মারিয়া গোল করলেন , নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় উৎযাপন করলেন...

এরপর কাঁদলেন , কাঁদালেন কোটি কোটি আর্জেন্টাইন ভক্তদের - কঠিন থেকে কঠিনতর সময়ে সর্বদা যাদের পাশে পেয়েছেন...

 

"গভীর বিষাদের দিনগুলোতে 

কেঁদেছিলাম একসাথে

আজ আনন্দের অশ্রুধারায়ও ভাসবো 

তোমাদেরই নিয়ে"

 

 

মারাকানার ফাইনালটার কথা কী মনে পড়ে ? অপয়া চোট ! একের পর এক ব্যাথানাশক নিয়েও মাঠে নামতে পারেন নি ডি মারিয়া । সেদিন গোটজের সেই গোলটা তো বুলেটের মতোই বিদ্ধ হয়েছিলো , রক্ত হয়ে ঝরে পড়েছিলো অশ্রু । সেদিনও ডি মারিয়া কেঁদেছিলেন ।

 

 

ঐ দিন ডি মারিয়া মাঠে থাকলে গল্পটা অন্যরকম হতো - ৮ বছর পর আরেকটি ফাইনালে এসে সমর্থকদের সেই বিশ্বাসটাকেই যেন তিনি সত্য প্রমাণ করলেন ! নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করে ৬৪ মিনিটে যখন বদলি হয়ে উঠে গেলেন , ফরাসিদের বিপক্ষে ২-০ তে এগিয়ে আকাশী নীলরা , ২টি গোলেই সরাসরি অবদান মারিয়ার , ১ম গোলের পেনাল্টিটাও তারই আদায় করা.. আর্জেন্টাইনদের জয় তখন সময়ের ব্যাপার , কিন্তু...

 

ইতিহাসের সবচেয়ে জমজমাট  বিশ্বকাপের ফাইনালটা এরকম একপেশে হওয়া তো মানায় না তাই না ? কিলিয়ান এম্বাপ্পে হতে দেন নি , ২ মিনিটের ব্যবধানে ২ গোল করে জমিয়ে দিলেন ফাইনাল , ডি  মারিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে আকাশপানে ফিরে হয়তো ঈশ্বরকে বলছিলেন , "আপনি এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারেন না ।"

 

অতিরিক্ত সময়ে মেসির গোল , এম্বাপ্পের পেনাল্টিতে ফরাসিদের আবার কামব্যাক । রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল ! 

ট্রাইব্রেকার !! স্নায়ুচাপের কি দুর্বিসহ পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো ডি মারিয়াকে...

 

অবশেষে ট্রফিটা এসেছে... আকাশী নীল আর্জেন্টিনা জার্সিতে খচিত হয়েছে নতুন একটি তারা যে তারার স্নিগ্ধ আলোয়  মুছে গেছে দীর্ঘ বিষাদের তিমির...

 

দীর্ঘ ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার পতাকায় বিরাজমান সূর্য্যটা হাসছে , যে হাসির প্রধান রূপকার লিওনেল মেসি , পার্শ্বচরিত্র আনহেল ফাবিয়ান ডি মারিয়া...

 

 

১৯৮৮ এর ১৪ই ফেব্রুয়ারি রোজারিও নামের ছোট্ট শহরটাতে জন্মেছিলেন ডি মারিয়া , ভালোবাসা দিবসে ঈশ্বরের কাছ থেকে ভালোবাসার সবচেয়ে বড় উপহারটা বোধ হয় ওই বছরই পেয়েছিলো আর্জেন্টাইনরা...

 

পাতলা গড়নের হলেও ছোট্ট মারিয়া ছিলেন ভীষণ চঞ্চল , এই চাঞ্চল্য কমানোর জন্যই কোনো এক ডাক্তারের বুদ্ধিতে ফুটবল খেলা শুরু করলেন , ক্রমেই ফুটবলের সাথে প্রণয়ের শুরু চার বছর বয়সী ডি মারিয়ার...

 

দরিদ্রতার মধ্যে বড় হয়েছেন , ফুটবল অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় ফুটবলটাও ছিলো না । বাবা , মা কয়লার কারখানায় কাজ করতেন । নিজের পরিবারকে খুব বেশি ভালোবাসেন , তাই একটু বেশি উপার্জন এবং বাবা, মার কষ্ট কিছুটা কমানোর জন্য দুই বোনের সাথে খুব ভোরে উঠে নিজেও কয়লার কাজ করতেন ছোট্ট ডি মারিয়া..

 

অনুশীলন চালানোর জন্য ফুটবল নেই , বুট নেই ।লোকাল ক্লাব টোরিটো ৩৫ টি ফুটবলের বিনিময়ে কিনে নেয় তাঁকে । মারিয়ার পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় রোজারিও সেন্ট্রালের হয়ে , সেখানে ২ সিজন দুর্দান্ত কাটানোর পর ইউরোপীয়ান অভিজাত ক্লাবদের নজরে পড়েন , ২০০৭ সালে পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকায় যোগ দেন , সেইখানেও অনবদ্য ডি মারিয়া । ৪ বছর পর লীগ শীরোপা জেতে বেনফিকা । এরপর ২০১০ এ পাড়ি জমান স্পেনে , সর্বকালের সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে । ২৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রিয়াল পেয়ে যায় এক মহামূল্যবান রত্ন , যার বদৌলতে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর লা ডেসিমা জেতে রিয়াল । পাশাপাশি কোপা ডেল রে , লা লীগা সবই জেতেন মারিয়া । স্পেন অধ্যায় শেষ করে , তৎকালীন রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার এ আসেন , রেড ডেভিলদের হয়ে ডি মারিয়ার অধ্যায় টা মনে রাখার মতো ছিলো না , সিজন শেষেই নতুন ঠিকানা পান মারিয়া - এইবার ফ্রান্সের ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেই । এইখানেই নিজেকে ক্লাবের কিংবদন্তী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি । পিএসজির হয়ে ৫ টি লীগ শিরোপা , ৫ টি ফ্রেন্স কাপ জয় করেন । ক্লাবটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টকারী খেলোড়ারও তিনি ।

২০২২ এ পিএসজি অধ্যায় শেষ করে জুভেন্টাসে যোগ দেন ।

 

দৈহিক গঠন পাতলা হলেও পাওয়ার এবং স্পিড অসামান্য , রাইট বা লেফট উইং অথবা অ্যাটাকিং মিডি সব পজিশনেই সমান পারদর্শী ডি মারিয়া , ভদ্রলোক তার সমসাময়িক উইঙ্গারদের মধ্যে অন্যতম সেরা । পর্তুগাল , স্পেন , ইংল্যান্ড , ফ্রান্স কিংবা ইতালি যেখানেই গিয়েছেন মারিয়া , সেইখানেই ফুটবল কে করেছেন মোহিত । 

 

 

দেশের হয়ে মারিয়ার ক্যারিয়ার আরো কয়েকগুণ উজ্জ্বল , মানুষটার জন্মই হয়েছিলো সম্ভবত আর্জেন্টিনাকে ফাইনাল জেতানোর জন্য..

২০০৮ সালে অলিম্পিকের ফাইনালে গোল করেছেন , ২০২১ এর কোপা আমেরিকার ফাইনালে জয়সূচক গোল করে আলবিসিলিস্তেদের ২৮ বছরের শিরোপা খড়া কাটিয়েছেন , ফাইনালিসিমা তেও গোল করেছেন আর বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই গোলটা করে তো মহাকালের কাছ থেকে অমরত্বের উপহার টাও নিজের করে নিয়েছেন । 

' ডি মারিয়া' নামটা ফুটবল পুরাণে খচিত হয়ে গেছে স্বর্ণাক্ষরে । একটা গোটা প্রজন্মকে তিনি দিয়েছেন প্রাপ্তির চরম সুখ , লিওনেল মেসি নামক ভিনগ্রহী ফুটবলারকেও প্রদান করেছেন শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ।

 

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে , কাল থেকে কালান্তরে - টঙ দোকানের চায়ের আড্ডায় ফুটবল নিয়ে গল্প গুলো জমানো থাক লিওনেল মেসির জন্য । প্রিয় ডি মারিয়া , গল্পের খানিকটা আপনার জন্যও থাক ।

 

৩৫ তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা আনহেল ।