পুরো এক যুগকে ফুটবলের নেশায় মাতিয়ে রাখা আর্জেন্টাইন জাদুকর
পোস্টটি ৮৭০ বার পঠিত হয়েছেতার ক্যারিয়ার নিয়ে কি লিখবো, কীভাবে লিখবো? কোন বিশেষণ দিয়ে তার খেলোয়াড়ি জীবনকে ব্যাখা করবো? সবকিছুই কম পড়ে যাবে। ফুটবলের প্রধান মানদণ্ড গোল-এসিস্ট, সে হিসেবের বাইরে দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গের নান্দনিক ফুটবল খেলা, সবকিছুতে তিনি ১০০ তে ১০০। ট্রফির হিসেবে যদি আসি, ক্লাব ক্যারিয়ারে সবকিছু জেতা সম্পন্ন হলেও ৩৪ পর্যন্ত তাকে শোনা লেগেছে জাতীয় দলের হয়ে জিতেছো কি? যখন জাতীয় দলের হয়ে কিছু একটা জিতলো, তখন নিন্দুকেরা বলতো বিশ্বকাপ কই? তার জবাবও সবাইকে দিলেন ৩৫ এ এসে। জিতলেন বিশ্বকাপ, ক্লাব ফুটবলের কল্যাণে কম্পলিট ট্রফি ক্যাবিনেট জাতীয় দলের অর্জনগুলোর সাথে মিলে হয়ে গেলো স্বয়ংসম্পন্ন। বিশ্বকাপ ট্রফি যেনো তার ক্যারিয়ারের বাক্যকে সম্পূর্ণ করার জন্য এসে গেলো পূর্ণচ্ছেদ রূপে।
একজন প্রফেশনাল ফুটবলার ফুটবল খেলে কেন? এর প্রথম এবং প্রধান উত্তর, জীবিকার জন্য। যদি আরেকটু ডিপলি চিন্তা করা হয়, তাহলে বলা যায় গোল-এসিস্ট, ট্রফির জন্য। বিশ্বসেরা হওয়ার স্বপ্ন সবাই রাখে, তবে নিজের যোগ্যতা, মেধা এবং পরিশ্রমের সংমিশ্রণ ঘটাতে পেরে খুব কমজনই বিশ্বসেরা ফুটবলার হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেন। তিনি এমন একজন, যিনি উপরের সবকিছুই তার ক্যারিয়ারে পেয়েছেন।
তবে এসবের চাইতেও মূল্যবান যে জিনিস তিনি পেয়েছেন, সেটা হলো স্ট্রিট। সোজা ভাষায় রাস্তা।
He got the street with him- ইংরেজিতে বললে একটু গোছানো শোনাতো। বাংলায় বলায় আজব শোনাচ্ছে। তবে এর মূলভাব একই।
রোজারিও থেকে কাতালুনিয়ায় গিয়ে একজন সাধারণ বালকের বিশ্বসেরা হওয়ার গল্প রোজারিওর উঠতি প্রতিটা ফুটবলারকে অনুপ্রেরিত করে। যে লা মাসিয়াতে তার বেড়ে উঠা, সে লা মাসিয়ার প্রতিটা ছাত্রই তাকে আদর্শের মানদণ্ড বানিয়ে স্বপ্ন দেখে, তার মতোই বিশ্বসেরা হতে হবে। যে বার্সেলোনার হয়ে খেলে তার বিশ্বসেরা হওয়া, সেই বার্সেলোনায় আসা ফুটবলারদের আইডলের তালিকায় তার নাম থাকবেই।
তার ইনফ্লুয়েন্স কি শুধুমাত্র রোজারিও, কাতালুনিয়া, লা মাসিয়া, বার্সেলোনাতেই সীমাবদ্ধ? এই প্রশ্নের উত্তর: অবশ্যই না। তার ভক্ত হয়ে, তার নাম নিজের গায়ে জড়াবে বলে আফগানি বালক মর্তুজা সাদা নীল পলিথিনের পেছনে তার নাম লিখে গায়ে জড়ায়। তার খেলায় ভক্তরা এতোটাই মুগ্ধ যে প্রায়ই ইন্টারন্যাশনাল ম্যচে স্টেডিয়ামে শুধুমাত্র তাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য ভক্তরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং শাস্তির আশংকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাঠে নেমে পড়ে।
তার জন্য ভক্তের এমন পাগলামির উদাহরণ বলে শেষ করা যাবে না। এমন উদাহরণ খুঁজতে পুরো বিশ্ব ঘুরা লাগবে না। রোজারিও, কাতালুনিয়া থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আমাদের নিজের দেশের দিকেই না হয় তাকাই। এমন হাজার হাজার মানুষ আছে, যাদের ফুটবল দেখার একমাত্র কারণ এই বাঁ পায়ের জাদুকর, যারা রাতের পর রাত শুধুমাত্র এই ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির লোকের খেলায় মুগ্ধ হয়ে নিজের ঘুম কামাই করেছে। যাদের কাছে ফুটবল মানেই নাম্বার টেন গায়ে জড়ানো এই ব্যক্তি, কোনো ক্লাব বা ন্যাশনাল দল নয়, শুধুমাত্র এই মানুষটাই যাদের কাছে ফুটবলের সমার্থক শব্দ, এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। বরং অনেক বেশি। তাদের এই পাগলামি কি মর্তুজা বা স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়া ব্যক্তিদের চেয়ে কম, মোটেও না।
ক্যারিয়ারের সম্পূর্ণটা জুড়ে যদি ভক্তদের ভালোবাসার সিক্ততা মাখা থাকে,, তবে এর মাঝখানে সামান্য অংশ আছে যা কালো স্ফুলিঙ্গের মতো। এবং তার জীবনের এই সামান্য অংশটাই আমাদের সবার জন্য অনেক বড় শিক্ষা। অনেক কিছু করেও মানুষের সমালোচনার দ্বারা বিরক্ত হচ্ছেন? মনে রাখবেন বিশ্বসেরা হওয়ার পরও ৩৪ বছর বয়স পর্যন্ত এক ইন্টারন্যাশনাল ট্রফির অভাবে তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার অনেকে চোখ এড়িয়ে যেতো। ভাবছেন, আপনার দ্বারা আর হচ্ছে না? তাহলে মনে করবেন রোজারিওর এক হরমোন রোগী কিশোর সবকিছুকে উপেক্ষা করে বিশ্বসেরা হয়েছে। এটাই আপনার শেষ সুযোগ, এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারবেন না, এমনটা মনে করছেন? তাহলে মনে রাখবেন ক্যারিয়ারের একদম অস্তভাগে এসে, সর্বশেষবারে লোকটা নিজের সবচেয়ে অধরা অর্জনের দেখা পেয়েছে।
প্রফেশনাল ফুটবল খেলে ইনকাম সবাই করতে পেরেছে, ফুটবল খেলে গোল এসিস্ট ট্রফিও অনেক ফুটবলার জিতেছে, অনেক ফুটবলারই কালক্রমে বিশ্বসেরা হয়েছে। কিন্তু কয়জনই বা এভাবে ভক্তদের সবচেয়ে বড় পাগলামির কারণ হয়েছেন? কয়জনই বা একটি পুরো প্রজন্মের ফুটবলকে ভালোবাসার কারণ হয়েছেন? কয়জনই বা ব্যর্থতার গ্লানিতে ভুগা মানুষের অনুপ্রেরণা হওয়ার মতো ফেয়ারি টেইল ক্যারিয়ার পেয়েছেন? শুধু এসব প্রশ্নই করবো না। কে-ই বা পেরেছেন নিজের দেশকে বিশ্বকাপ ফুটবলের মঞ্চে তিন যুগ পর বিশ্বসেরা বানানোর একমাত্র আশা হতে? কে-ই বা ভেবেছিলেন একজন আসবে, এসে দি গ্রেটেস্ট ম্যারাডোনাকে গ্রেট বানিয়ে নিজে গ্রেটেস্ট হবেন, ম্যারাডোনার লেগ্যাসিকে আউটশ্যাডো করবেন। কেউই ভাবেননি। কিন্তু এমন একজনই এসেছেন। ৩৬ বছর আগে এমনই এক দিনে হোর্হে মেসি এবং মারিয়া কুচেত্তিনির ঘর আলোকিত করে এসেছিলেন এক বালক। যার নাম রাখা হয় লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।
ধন্যবাদ মেসি পুরো এক প্রজন্মকে এভাবে ফুটবলের সৌন্দর্য উপলব্ধি করানোর জন্য। ধন্যবাদ মেসি আর্জেন্টিনাকে পুনরায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করে একসাথে কয়েক প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। ধন্যবাদ মেসি, এক্সিস্ট করার জন্য।
- 0 মন্তব্য