• ফুটবল

আবেগহীন ফুটবলের যুগে এক আবেগী চরিত্র | পর্ব : ২

পোস্টটি ১১৫৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ট্রান্সফার নিয়ে অনেক কাদা খোঁড়াখুঁড়ি হলেও শেষ পর্যন্ত প্রাণের মার্সেই ফিরে আসেন পায়েত। ফিরে আসেন এমন এক টিমে, যাদের সামনে বড় এক লক্ষ্য। এমনকি মার্সেই এর জন্য সাপ্তাহিক বেতন থেকে প্রায় ২৫ হাজার পাউন্ড স্যাক্রিফাইস করেন তিনি। তারপরও ফিরে আসেন সেই শহরে, সেই দেশে, যাকে তিনি ভালোবেসেছিলেন।

আর সে ফেরাটাও ছিলো রূপকথার মতোই। প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম ম্যাচই ছিলো মার্সেই এর অন্যতম শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী লিওঁর বিরুদ্ধে, কুপ ডি ফ্রান্সে। সে ম্যাচে ভেলোদ্রোমের হাজার হাজার সমর্থক সমস্বরে চিৎকার করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়। পরের ম্যাচেই গেঁগার বিপক্ষে পেয়ে যান দ্বিতীয় কিস্তিতে নীল-সাদা জার্সিতে তাঁর প্রথম গোল।

তবে পায়েতের ফেরা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই। বয়স ততদিনে ২৯ হয়ে গেছে। মার্সেই কে আর কতটুকু কি দিতে পারবেন পায়েত? ২৯.৩ মিলিয়ন ইউরো কি এর চেয়ে ভালো কোনো জায়গায় ব্যবহার করা যেতনা?

প্রশ্নগুলো অবশ্য অমূলক ছিলোনা একদমই। তবে পরের সিজনেই একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করেন পায়েত। সেবার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মৌসুম কাটে তাঁর। অলিম্পিয়ানদের হয়ে সেবার ১৮ টি এসিস্ট করেন দিমিত্রি পায়েত। দলকে টেনে নিয়ে যান ইউরোপা লিগের ফাইনালে।

তবে ভাগ্য তার বরাবরই নির্মম। আতলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ইউরোপা লিগের ফাইনাল ম্যাচটিতে ৩২ মিনিটের মাথায় হ্যামস্ট্রিং ইঞ্জুরিতে পড়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন পায়েত। দলের সেরা তারকার এমন পরিণতির পর শেষ পর্যন্ত শিরোপা জয়ের কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হয় মার্সেই কে। কে জানে, পায়েতের ইঞ্জুরিটা না হলে হয়তো গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো, হয়তো মার্সেই এর ট্রফি কেসে যুক্ত হতো আরও একটি মহাদেশীয় শিরোপা।

image_search_1693507001858
তবে ভাগ্যের নির্মম করাঘাতের তখনও অনেক কিছুই বাকি। ইউরোপা লিগ ফাইনালের সেই ইঞ্জুরি শুধু মার্সেই এর শিরোপা জয়ের স্বপ্নই কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে পায়েতের বা একজন খেলোয়াড়ের জীবনের সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় দলীয় অর্জন। পায়েত কে ফ্রান্স দলের অন্যতম চালিকাশক্তি ধরে নিয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপের জন্য দল প্রস্তুত করে রেখেছিলেন ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম। কিন্তু পায়েতের সেই হ্যামস্ট্রিং ইঞ্জুরি মূহুর্তের মধ্যে পাল্টে দেয় সব হিসাব নিকাশ। পায়েতের জন্য দল ঘোষণার শিডিউল পিছিয়ে দেওয়া হয়। পায়েত কে ছাড়া নতুন করে স্কোয়াড প্রস্তুত করতে বাধ্য হন দেশম। অবশেষে শুধু সেই ইঞ্জুরির জন্য বিশ্বকাপের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসতে হয়।

পায়েত কে ছাড়াই বিশ্বকাপে যায় ফ্রান্স, এবং জয় করে আনে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি টা। ভাবুন তো, পায়েতের সেই ইঞ্জুরিটা না হলে তাঁর ক্যারিয়ার আরও কতটা উজ্জ্বল হতে পারতো? নামের পাশে লেখা থাকতো একটি বিশ্বকাপ। পায়েত হতেন একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। হয়তো সেদিন তাঁর হাত ধরে মার্সেই ও জিতে নিতো ইউরোপা লিগের শিরোপা। কিন্তু শুধু একটি ইঞ্জুরি, একটি ইঞ্জুরি মুহূর্তে মধ্যে সম্ভাব্য এতগুলো অর্জন কে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে।

এতগুলো সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে গিয়েও এমন স্বপ্নভঙ্গ প্রভাব ফেলে তাঁর বিশ্বকাপ পরবর্তী পারফর্মেন্সের ওপর। পরের সিজনে ধারাবাহিকভাবে ডাউনগ্রেড হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এ যেন একদম অন্য পায়েত, অচেনা পায়েত। যে রুডি গার্সিয়া মান্দান্দা ক্রিস্টাল প্যালেসে যাওয়ার পর তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলো ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড, সে গার্সিয়ার দলে এক প্রকার ব্রাত্য হয়ে পড়েন পায়েত।

নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা একটা সিজন কাটানোর পরই ভুলে যাওয়ার মতো একটা সিজন পার করেন পায়েত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্ট্রাগল করতে হয়। তবে খুব বেশী দীর্ঘকায় হয়নি এ দুর্দশা। সিজন শেষে বরখাস্ত হন কোচ রুডি গার্সিয়া, তার স্থলাভিষিক্ত হন পর্তুগীজ তরুণ কোচ আন্দ্রে ভিয়া বোয়া। ভিয়া বোয়ার আন্ডারে নিজেকে নতুন করে ফিরে পান দিমিত্রি পায়েত। কোচের সাথে তাঁর গড়ে ওঠে এক নিবিড় সম্পর্ক।

ভিয়া বোয়াও পূর্ণ আস্থা রাখেন পায়েতের ওপর। পায়েত কে কেন্দ্র করে তিনি মার্সেই টিম গড়ে তোলেন। তিনি বলেন, "বার্সেলোনা যেমন মেসি নির্ভর, জুভেন্টাস যেমন রোনালদো নির্ভর, তেমনি আমরা পায়েত নির্ভর।" তার তৎকালীন সতীর্থ আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার দারিও বেনেদেত্তো বলেন, "আমরা বল তার কাছে পাস দিতাম, কারণ আমরা জানতাম তার সে অ্যাবিলিটি আছে। জয়ের জন্য সে সবকিছু করতে পারে। হয় সে নিজে গোল করবে, অথবা অন্যদের দিয়ে করাবে। ও পুরো দলের খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। ও ছিলো একজন কমপ্লিট ফুটবলার। তাকে ছাড়া পুরো দলকেই অচেনা মনে হতো।"

102681457_10158434878009798_3848661859699785728_o
ভিয়া বোয়ার আন্ডারে আবারও আস্তে আস্তে নিজের স্বরুপে ফিরতে শুরু করেন পায়েত। পুরোনো ছন্দ ফিরে পাচ্ছিলেন আবার। নিজেকে আবারও মেলে ধরতে শুরু করেন। দলের অন্যতম সেরা তারকা ফ্লোরিয়ান থাউভা ইঞ্জুরির জন্য যখন দীর্ঘদিনের জন্য মাঠের বাইরে ছিটকে গেলো, অনেকেই ভেবেছিলো মার্সেই হয়তো এবার বেশ ভালো রকমের স্ট্রাগল করবে। কিন্তু পায়েত ম্যাজিকে থাউভার অনুপস্থিতি অনুভবই করা যাচ্ছিলোনা। ভিয়া বোয়ার আন্ডারে দলও এগিয়ে যাচ্ছিলো দুর্দান্ত ভাবে। বহুবছর পর সেবার লিগে রানার্সআপ হয় মার্সেই, সেই সাথে বহু অপেক্ষার পর ব্যাক করে চ্যাম্পিয়নস লিগে। যদিও সেবার কোভিড আউটব্রেকের কারণে সিজন পুরোটা শেষ করা সম্ভব হয়নি, তবে পয়েন্ট কাউন্ট করে সেবার লিগ পজিশন নির্ধারণ করা হয়, আর সেখানে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থেকে লিগ রানার্সআপ হিসেবে সিজন শেষ করে মার্সেই। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কোচ ভিয়া বোয়ার থাকলেও মাঠের খেলায় অন্যতম ক্রুসিয়াল পারফর্মার ছিলেন পায়েত।

পরের সিজনে মার্সেই বেশ বাজে অবস্থা পার করতে শুরু করে। বহুবছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগে ফিরলেও বিদায় নিতে হয় সবকটি ম্যাচ বাজেভাবে হেরে। লিগেও বাজে অবস্থা পার করছিলো। এর মধ্যে শুরু হয় দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। দলের প্রেসিডেন্ট জ্যাক অঁরি এরোর বিরুদ্ধে ফ্যানদের ক্ষোভ ছিলো বহুদিন ধরেই, সেটা সেবার চরম আকার ধারণ করে। অবশেষে জানুয়ারি তে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ে কোচ আন্দ্রে ভিয়া বোয়া নিজেও। এর পরপরই তিনি পদত্যাগ করেন কোচের পদ থেকে। এরপর ক্লাব প্রেসিডেন্টের এরো কেও পদচ্যুত করা হয়। তার জায়গায় নতুন ক্লাব প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান তৎকালীন স্পোর্টিং ডিরেক্টর পাবলো লংগোরিয়া। সিজনের শেষভাগে এসে নতুন কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন হোর্হে সাম্পাওলি। সব মিলিয়ে মার্সেই দলটি সেবার একটি পুরো এলোমেলো সিজন কাটায়। দলের কেউই সেবার সেরকম কন্সিস্টেন্ট পারফর্ম করতে পারেনি।

এরপর আসে ২০২১-২২ সিজন। নতুন প্রেসিডেন্ট লংগোরিয়ার দূরদর্শিতা চিন্তাভাবনার পাশাপাশি সাম্পাওলির অভিজ্ঞ হাতের স্পর্শে মার্সেই শুরু করে নতুন এক যাত্রা। এর মার্সেই এর এ নব্যযুগের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নেন দিমিত্রি পায়েত। আর সেবার পায়েত আরও একবার বিশ্ববাসী কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন পায়েত কি, পায়েত কি করতে পারে। সিজনের শুরু থেকে পায়েত জাদু তে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে পুরো ফ্রান্স। তার অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্সে সম্মোহিত করে তোলেন সবাইকে। একা হাতে মার্সেই এর অ্যাটাক টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দুর্দান্ত সব কি পাস, জাদুকরী ক্রস, অবিশ্বাস্য প্লে মেকিং, অভাবনীয় সব গোল, আর "ফ্রি কিক স্পেশালিষ্ট" এর অতুলনীয় সব ফ্রি কিক, সব মিলিয়ে পায়েত হয়ে পড়েন একের ভেতর সব।

পায়েত জাদুতে ভর করে উড়তে থাকে মার্সেই ও। এক যুগ পর প্রথমবারের মতো সেবার লিগ টাইটেলের জন্য ফাইট করতে দেখা যায় তাদের। লিগ জিততে না পারলেও রানার্সআপ হয়ে পরের সিজনে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা নিশ্চিত করে অলিম্পিয়ানরা। আর প্রায় এই পুরো কৃতিত্বের দাবিদার আর কেউ নয়, ওয়ান অ্যান্ড অনলি দিমিত্রি পায়েত। আর এর স্বীকৃতি স্বরূপ সাত বছর পর আবারও নির্বাচিত অলিম্পিক ডি মার্সেই এর প্লেয়ার অব দ্য সিজন। জায়গা পান ইউএনএফপি টিম অব দ্য সিজনে। সেই সাথে মনোনীত হন ইউএনএফপি প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডের জন্যেও। ক্যারিয়ারের একদম সায়াহ্নে ৩৫ বছর বয়সে এসে ঝলক দেখিয়ে দেন পুরো বিশ্বকে, পার করেন নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা একটা সিজন। পুরো ফ্রান্স কে বাধ্য করেন পায়েত বন্দনায় মেতে উঠতে আরও একবার।

IMG_20210801_030503
সে সিজন শেষে গত সিজনের শুরুতে বিভিন্ন ইস্যুর জের ধরে সাম্পাওলির স্থলাভিষিক্ত হন ক্রোয়াট কোচ ইগোর তুদোর। তবে আগের সিজনে আগুন ছড়ানো পায়েত তুদোরের দলে আস্তে আস্তে অনিয়মিত হয়ে ওঠেন। শুরুর একাদশে তো তাকে দেখাই যেতোনা, বদলি হিসেবে নিয়মিত মাঠে নামতেন না। তার প্লেয়িং টাইম হয়ে পড়ে খুবই সীমিত। তবে অল্প যে একটু টাইম পেতেন, বেশিরভাগ সময়ই তাতেই ক্রুসিয়াল গোল এসিস্ট করে দলকে নিশ্চিত বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতেন। তবে বয়সের ভার খেলার মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। আগের মতো ক্ষিপ্রতা আর দেখা যাচ্ছিলোনা। স্লো হয়ে পড়ছিলেন ধীরে ধীরে। সিজনের শেষ দিকে এসে দলে একদমই ব্রাত্য হয়ে ওঠেন পায়েত। সবাই বুঝেই ফেলেছিলো, সময় ঘনিয়ে এসেছে, এবার ইতি টানতে হবে।

অবশেষে গত ২১ জুলাই প্রেস কনফারেন্স কে মার্সেই কে বিদায় বলে দেন দিমিত্রি পায়েত। দীর্ঘ এক যাত্রার সমাপ্তি টানেন, বিদায় জানান নিজের প্রাণপ্রিয় মার্সেই কে, নিজের ঘর কে। ধন্যবাদ জানান ক্লাব, সতীর্থ, কোচ, প্রেসিডেন্ট সহ সবাইকে, যারা এতদিন তাঁকে আপন করে রেখেছিলো, আগলে রেখেছিলো পরম যত্নে। অশ্রুসিক্ত নয়নে আরও একবার বলেন, "ওএম আমার পরিবার।"

পরিবারই তো। ছোট্ট শান্ত রিউনিয়ন ছাড়ার পর এখানেই তিনি পেয়েছিলেন ভালোবাসার আশ্রয়, এটাকেই করে তুলেছিলেন নিজের ঘর, নিজের ঘর। মার্সেই-ই তো তার সবচেয়ে বড় আপনজন। এ ক্লাব, এ শহর, এ শহরের ফুটবল পাগল হাজার হাজার মানুষ, বা বিশ্বজোড়া কোটি কোটি সমর্থক, এরাই তো তার পরিবার, সবচেয়ে কাছের মানুষ। মার্সেই আর পায়েত জড়িয়ে গেছেন এক অবিশ্বাস্য ও অবিচ্ছেদ্য মায়ার বন্ধনে, লন্ডনের জাঁকজমকপূর্ণ জীবন, অর্থ, খ্যাতি কোনোকিছুই এ মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে তাঁকে রুখতে পারেনি। পায়েত অর্থ বা খ্যাতির পেছনে কখনো ছোটেননি। তিনি শান্তি চেয়েছিলেন, সুন্দর জীবন চেয়েছিলেন, নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলেন, আর তা তিনি পেয়েছিলেন এ মার্সেই তে। তাই তো শত শত লোভনীয় সব অফার প্রত্যাখ্যান করেছেন, নিজের ভালো লাগা টাকে আপন করে নেওয়ার জন্য, মার্সেই এর জন্য। সবকিছুর চেয়ে তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো নিজের কমফোর্ট, নিজের আবেগ।

যখন বিশ্বের নামীদামী সব তারকা ছুটেছে অর্থ ও ফেমের পেছনে, যখন "সর্বকালের সেরা" খ্যাত তারকারাও  আবেগ কে দূরে সরিয়ে অর্থের নেশায় ইউরোপ ছেড়েছে, তখন সাধারণ পায়েত সব অর্থলিপ্সা কে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। অর্থের জন্য জলাঞ্জলি দেননি নিজের আবেগ কে, নিজের ভালোবাসা কে, নিজের শান্তি কে।

ওয়েস্ট হ্যাম থেকে যখন পুনরায় আবার মার্সেই ফিরে আসেন, তখন মার্সেই এর সাথে ক্যারিয়ার ডিল সাইন করেছিলেন পায়েত। যখন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মৌসুম কাটাচ্ছিলেন, তখনও সে ডিলের অংশ হিসেবে ধারাবাহিক ভাবে প্রতি সিজনে নিজের বেতন কমিয়ে আনছিলেন পায়েত। মার্সেই এর জন্য নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। মার্সেই এর সাথে তাঁর সম্পর্ক টা একদমই ক্লাব-খেলোয়াড় সম্পর্ক ছিলোনা। এটি সবসময়ই ছিলো একটা পরিবারের মতো সম্পর্ক, আর পায়েত সবসময়ই নিঃস্বার্থ ভাবে সেটা রক্ষা করে গেছেন।

20220902_162727
এমনকি মার্সেই কে বিদায় বলার পর লিগ ওয়ানের অসংখ্য ক্লাব তাঁর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু তিনি ফ্রান্সের বুকে মার্সেই ছাড়া অন্য কোথাও নিজেকে দেখতে চাননি। তাই নির্দ্বিধায় সবাইকে না বলে দিয়েছেন। এমনকি ইউরোপও ছেড়েছেন, গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন দূর পরবাস কে, যোগ দিয়েছেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ভাস্কো ডা গামায়।

সবার মাঝে থেকেও পায়েত ছিলেন একটু অন্যরকমের। ক্যারিয়ার তাঁর কখনো সমান্তরালে চলেনি। প্রতিনিয়ত দেখেছেন উত্থান পতন। মার্সেই তে অসাধারণ ভাবে শুরু করার পর ক্লাবের ফিনান্সিয়াল ইস্যু তে ক্লাব ছেড়েছেন, ওয়েস্ট হ্যামে গিয়ে নিজেকে চিনিয়েছেন বিশ্ববাসীর কাছে, ২০১৬ ইউরো তে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন বিশ্ববাসীকে, ২০১৮ তে ইউরোপা লিগে মার্সেই কে টেনে নিয়ে গেছেন ফাইনালে। অথচ মূদ্রার উল্টো পিঠও দেখতে হয়েছে বারংবার। নিজ দেশের মাটিতে ইউরোর ফাইনালে উঠে বিদায় নিতে হয়েছে খালি হাতে হাতে, নিজ দলকে একক নৈপুণ্যে ইউরোপা লিগের ফাইনালে তুলেও সেখানে গিয়ে ইঞ্জুরি নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মাঠ ছেড়েছেন, শেষ হাসি হাসা হয়নি। সেবারের সেই ইঞ্জুরি তাকে ছিটকে দিয়েছে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে, যেই স্কোয়াড পরবর্তীতে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় পড়েছে, যে কৃতিত্বের অন্যতম ভাগিদার হতে পারতেন তিনিও।

এ শতকের অন্যতম সেরা প্লেমেকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ছুয়েছেন লিগ ওয়ানে ১০০ গোল ও ১০০ এসিস্টের মাইলফলক। এই শতকে লিগ ওয়ানে সবচেয়ে বেশি এসিস্টের রেকর্ডও তাঁর দখলে। মার্সেই দলকে তিনি একা হাতে টেনে নিয়ে গেছেন বছরের পর বছর। মার্সেই এর জন্য তিনি ছিলেন এক ভরসার নাম। সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতিতে পায়েত মাঠে থাকা মানেই ছিলো একটা আলাদা শক্তি।

পায়েত অতুলনীয়, পায়েত অনন্য, পায়েত অসাধারণ। পায়েত নিজেকে  প্রতিষ্ঠা করেছেন অনন্য হিসেবেই, যিনি নিজের আবেগ কে কখনো বিক্রি করেননি, মানবীয় গুণগুলো ধারণ ও লালন করেছেন সবসময়। অর্থের ঝনঝনানিতে নিজেকে বিক্রি করেননি। বাঁচতে চেয়েছেন নিজের আবেগ কে বুকে ধরে। ফুটবল বিশ্বের আবেগহীন পেশাদার ক্যারিয়ারে ব্যতিক্রম থেকেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন পেশাদার খেলোয়াড় হয়েও একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা যায়, যার আবেগ আছে, ভালোবাসা আছে, তীব্র অনুভূতি আছে। তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে তিনি একজন মানুষ৷ আর এটিই তাকে দিয়েছে ফুটবল বিশ্বে একটি অনন্য জায়গা।