একটি প্রকাশঅযোগ্য বিশ্বকাপ পোস্ট মর্টেম (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
পোস্টটি ৩১৩ বার পঠিত হয়েছে(আগের অংশ প্রথম পর্বে)
প্রথম প্রশ্নঃ শেষ কবে আমরা বাংলাদেশের কোন ব্যাটারকে ইনসাইড আউট শটে বা ফ্লিক করে ৯০ মিটার ছক্কা মারতে দেখেছি?
মোটা দাগে উত্তরটা বললে বলা যায় কখনোই দেখিনি। প্রবল স্মরণশক্তির নিয়মিত ক্রিকেট দর্শকদের অবশ্য এই বলে ফাঁকি দেয়া যাবেনা। তাঁরা মাথা চুলকে বলে বসবেন, দেখেছিতো। সৌম্য সরকারকে। ২০১৫ বিশ্বকাপ পরবর্তী পাকিস্তানের সাথে ওয়ানডে হোম সিরিজে তাঁকে একাধিকবার ফ্লিক করে মিরপুরের উপরের গ্যালারীতে বল পাঠাতে দেখেছি। সুতরাং কখনোই দেখিনি- কথাটা সত্য নয়। কিন্তু এই অসত্যটি কি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সত্যিকারের উলঙ্গ চিত্রটিকে ইংগিত দিচ্ছেনা? সীমিত ওভারের ক্রিকেটের অতি সাধারণ ঘটনা - ফ্লিক শটে ৯০ মিটার পার করা ছয়। সহযোগী দেশের ব্যাটাররাও সকাল বিকাল এ ধরনের শটে বল গ্যালারীতে আছড়ে ফেলছে, আর আমাদের কিনা তা খুঁজতে অর্ধযুগের পুরোনো অতীত ঘাটাতে হচ্ছে?
পরের প্রশ্নঃ শেষ কবে আমরা সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোন বোলারকে গুগলিতে প্রতিপক্ষ ব্যাটারকে বোকা বানাতে দেখেছি?
রিশাদ শুনলে মন খারাপ করতে পারেন। তবে উত্তরটা হচ্ছে এরকম কোন ঘটনা আমরা কখনোই দেখিনি। অথচ আধুনিক সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মান সম্পন্ন লেগ স্পিনারের কোন বিকল্প নাই। রাশিদ খানকে সাম্প্রতিক সময়ে কোন একটি সাক্ষাতকারে বলতে শুনেছি আফগানিস্তানে নাকি তাঁর মতো ১০০০ লেগ স্পিনার উঠে এসেছে এবং ঘরোয়া ক্রিকেট মাতাচ্ছে। রাশিদ খান যে তিলকে তাল করেছেন সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নাই। বরং তাঁর মানের ১০০০ কেন, ১ জন লেগ স্পিনার গোটা পৃথিবীতেই আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অবকাঠামোহীন দুঃস্থ আফগান ঘরোয়া ক্রিকেটে উঠে আসছে মিস্ট্রি স্পিনার সেটা যে রাশিদ একেবারে মিথ্যে বলেননি নূর নামক চায়নাম্যান ইতোমধ্যেই আফগান মূল দলের পাশাপাশি বিশ্বের শীর্ষ ফ্রাঞ্চাইজি লীগ গুলোতেও নূর ছড়াচ্ছে, সেটাই তার প্রমাণ। শুধু আফগানিস্তানেই না, প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি দেশের জাতীয় দলে মানসম্পন্ন লেগ স্পিনার আছে। এমনিকি আছে ওমান, আরব আমিরাত বা নেপালের মত দেশেও।
আর আমরা বিশ্ব ক্রিকেটের চতুর্থ ধনী বোর্ড দুই যুগ ধরে টাকার চাষ করেও একজন লেগস্পিনার ফলাতে পারি নাই। শুধু লেগস্পিনারের বিপক্ষে বল কোন দিকে বাঁক নেবে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে দেশ সেরা টেকনিশিয়ান মুশফিক-তামিমের সামনে পায়ে এসে অসহায় এলবিডব্লিউ হতে হতে কেরিয়ার (প্রায়) শেষ করে ফেললেন। ঘরোয়া লীগের কোন পর্যায়ে গুগলি না খেলা দেশসেরা টেকনিশিয়ানদেরই বা দোষ কিভাবে দেই? তাই বাংলাদেশের বোলিং এ আক্ষেপ আর ব্যাটিং এ বিভিষীকার অপর নাম হয়ে আছে লেগ স্পিন।
পরের প্রশ্নঃ শেষ কবে ৮০+ স্কোর করে বাংলাদেশের ব্যাটার র্যাংকিং এর প্রথম আটটি দেশের বিপক্ষে ম্যাচ বের করেছেন?
শর্ট টাইম মেমোরি লুজার না হলে নিয়মিত টাইগার সেজে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাওয়া আবেগী বাঙ্গাল এবার সত্যি সত্যি “পাইছি তোরে” বলে সত্যিকারের টাইগারের মত আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আমাকে মনে করিয়ে দিতে পারে মাত্র অর্ধযুগ আগের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিব-রিয়াদের সেই অবিস্মরণীয় জুটিকে। স্বভাবসুলভ দ্রুত ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরাতে তাঁরা দুইজনই ক্রিকেট বিশ্বকে হতবাক করে শতক হাঁকিয়েছিলেন। রিয়াদতো অপরাজিত থেকে ম্যাচ জিতিয়েই ফিরেছিলেন। নির্মম সত্য হচ্ছে পরের অর্ধযুগে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারেনি বাংলাদেশ। অথচ প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট দেশগুলোর সাথে খেললে যে কোন দলকেই নিয়মিত কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সেই পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে ম্যাচ বের করে আনার ঘটনা এত বেশি ঘটছে যে অর্ধযুগ আগের সেই ঘটনা ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। বাংলাদেশ ভক্তরা মনে রেখেছেন কারণ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনার আপাত স্বাভাবিক ঘটনা আমাদের ক্রিকেট দলের জন্য অতি অস্বাভাবিক।
পরের প্রশ্নঃ শেষ কবে বাংলাদেশের গতিমান কোন বোলারকে ১৫০ কিমি গতিতে বল করতে দেখেছি?
১৫০ কিমি কখনোই দেখাতে পারেনি বাংলাদেশের কোন বোলার। তাসকিন আর এবাদতদের গতি দৈবাৎ ১৪০ এর ঘরে উঠে বটে। অধিকাংশ সময়ে দেশের ইতিহাসের দ্রুততম এই দুই ফাস্ট বোলার ১৩৫ এর আশে পাশেই থাকেন। যদিও বর্তমান সময়ে শীর্ষস্থানীয় প্রত্যেকটি দেশের অন্তত একজন করে ১৫০ ছোঁয়া ফাস্ট বোলার আছেন। রঞ্জি, শেফিল্ড, কাউন্টি, বাস্টা বা কায়েদে আযমর সাধারণ দলগুলোর পেইস বোলারদের গতিও ১৩৫ এর কিছু কম হয়না।
পরের প্রশ্নঃ শেষ কবে বাংলাদেশের ব্যাটারকে ২০০ স্ট্রাইক রেটে সেঞ্চুরি করতে দেখেছি?
আমাদের কোন ব্যাটার ওয়ানডে-টি২০ কোথাও ২০০ স্ট্রাইক রেটে সেঞ্চুরি করতে পারেনি। ২০০ স্ট্রাইক রেটে সেঞ্চুরীর কথা শুনে চোখ কপালে তোলার দিন যে শেষ।
ওয়ানডেতে দ্বিশতক? কম্মিনকালেও করেনি বাংলাদেশ ব্যাটার।
দলীয় ৪০০? থাক, বলতে হবেনা। ৩৫০? নো, নেভার।
অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড, দঃ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান বা শ্রীলংকার বিপক্ষে ৩০০+ তাড়া করে জয়? ইয়েস, পেরেছে বাংলাদেশ। এক যুগ আগে ফতুল্লায় নিউজিল্যান্ডের সাথে ৩০৯ রান সফল ভাবে তাড়া করেছিল যা এখন পর্যন্ত এই দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র সফল ৩০০+ রান তাড়া। এক যুগে এক বার!
চাইলে এই প্রশ্ন উত্তর চলতে পারে আরও অনেক সময়। তবে ধারনা করছি, ঢের হয়েছে। আধুনিক ক্রিকেটের অতি স্বাভাবিক (Natural) ঘটনা, যা আমাদের ক্রিকেটারদের জন্য অতি প্রাকৃত (Super Natural), তারপরও কি ব্যর্থতার পোস্ট মর্টেম করতে কোচের স্বেচ্ছাচারিতা, সিলেক্টরদের অদূরদর্শিতা, ক্রিকেট রাজনীতি, ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ, দলীয় সমন্বয়হীনতা, ট্যাকটিকাল ভুল জাতীয় সমস্যা বের করার প্রয়োজন আছে? সমস্যার মূলতো আরও অনেক গভীরে। তারপরও তথাকথিত ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মিডিয়ায় এসে লাস্যময়ী উপস্থাপিকাদের সাথে ভাবের আদান প্রদান করে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে এসবই বলছেন। মুখফুটে কেউ বলবেন না সমস্যা আসলে সামর্থ্যহীনতার। তাঁদের না বলার সম্ভাব্য ৩ কারণঃ
১। সামর্থ্যের অভাবজনিত সত্যকে মেনে নিতে না পারা।
২। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতি ধৈর্য রাখতে না পারা।
৩। বোঝার অক্ষমতা।
কিংবা তারা হয়তো জানেন সামর্থ্যের প্রশ্ন তুললে টিভি মিডিয়াতে তাঁদের হয়তো ডাকা হবেনা। বোর্ড সংশ্লিষ্ট হলে তো কথাই নেই। সামর্থ্যের অভাব নিয়ে কথা বললেতো তার গঁদি নিয়েই টানাটানি হতে পারে। কি দরকার যেঁচে আপদ ডেকে আনার। বিসিবির মোটা বেতন, গাড়ি, এয়ার টিকেট, বিদেশ ভ্রমণ, ফাইভ স্টার হোটেল- চলুক না, যতদিন গা বাচিয়ে চালিয়ে নেয়া যায়। সাংবাদিকরাও জানেন, জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের তাঁদেরও প্রয়োজন। তাঁদের প্রিয়ভাজন হলেই না মিলবে গোপন এজেন্ট হিসেবে মিডিয়াতে প্রচারাভিযানের মোটা অংকের অর্থ। ক্রিকেট কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের দরকার ভিউ, মুখরোচক গল্প। সত্য বিশ্লেষণের বস্তা পচা! কনটেন্ট তাদের তৈরির প্রয়োজন নেই। তাদের মিলিত অপচেষ্টা একদিকে যেমন সত্যকে ঢেকে রাখে, আরেকদিকে প্রত্যেকটি বৈশ্বিক আসোরেই সামর্থ্যের বাইরে থাকা মিথ্যা স্বপ্ন তৈরি করে ক্রিকেট দলের উপর পর্বতপ্রমাণ চাপ তৈরি করে। হুযুগপ্রিয় আবেগী জাতি ঢোলের শব্দ ধবনিতে নেচে উঠে সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে। তারপর সামর্থ্যের বাইরে থাকা চাপ বরণ করে নিতে না পেরে ক্রিকেট দল ভেংগে পড়ে তাসের ঘরের মতো আর জাতি বরণ করে নেয় একরাশ হতাশা আর ক্রিকেট বহির্বিশ্বের উপহাস।
এমন নয় যে যেগুলো নিয়ে সর্বস্তরে চর্চা হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেই সমস্যাগুলো নেই। তবে সেগুলো এডভান্সড বিষয়। সামর্থ্য না থাকলে প্রয়োগ পরিকল্পনা কোন কাজে লাগেনা। ট্যাক্টিকাল স্ট্র্যাটেজির পর স্ট্র্যাটেজি সাজিয়ে শুধু ব্যর্থতার গল্পটাকে দীর্ঘায়িত করা হয়। গত দুই যুগে আমাদের ক্রিকেটের যৎসামান্যই উন্নতি হয়েছে। বৈশ্বিক আসোরে ধারাবাহিকভাবে পরাশক্তিদের হারানোর জন্য যে স্কিলসেটের প্রয়োজন সেটা আমাদের নেই। জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের সামর্থ্যহীন-যোগ্যতাহীন বলে অপমান করার কোন অভিপ্রায় এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। নিঃসন্দেহে এঁরাই আমাদের দেশ সেরা ক্রিকেটার। কিন্তু এটাও সত্যি বিশ্বমানের স্কিলসেট থেকে দেশ সেরা ক্রিকেটাররা বহু পেছনে।
পোস্ট মর্টেম তো হলো। যদিও বিশ্বকাপের পোস্ট মর্টেম, কিন্তু বিশ্বকাপের ঘটনা কিছুই যুক্ত হলোনা। আসলে বিশ্বকাপের ব্যর্থতা নিয়তিতে লেখাই ছিল। তামিমের অনুপস্থিতি থেকে অস্থিতিশীল ব্যাটিং অর্ডার, ফাস্ট বোলার আর টপ অর্ডারের অপ্রত্যাশিত বাজে পার্ফরমেন্স- এগুলো অবশ্যই অনুঘোটক হিসেবে কাজ করেছে। তবে সীমিত সামর্থ্য বাড়াতে কাজ না করলে এগুলো না ঘটলে অন্য অনুঘোটক ঘটতো। বিশ্বকাপের পোস্ট মর্টেম হয়েও তাই এটা আসলে দীর্ঘ দুই যুগেও বড় দল হয়ে উঠতে না পারার সামগ্রিক পোস্ট মর্টেম। পোস্ট মর্টেমে এক ধরনের নির্দেশনা বা সুপারিশ জাতীয় বস্তু থাকে। সেই হিসাবে এই লেখাতেও কিছু নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু গতানুগতিকভাবে ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামোগত উন্নয়ন আর স্পোর্টিং উইকেটে খেলার অভ্যাস বাড়ানো ছাড়া আর কিই বা বলা যায়? বিদেশী একটা বচন আছে- সমস্যার মূল ধরা পড়লে অর্ধেক সমস্যার সমাধান আপনাতেই হয়ে যায়। আমাদের সবার আগে মেনে নিতে হবে মূল সমস্যা আমাদের সামর্থ্যের অভাবের। দায় ক্রিকেটারদের নয়। থাকলেও খুব সামান্য। দায় আমাদের বোর্ডের এবং ক্রিকেট সমাজের যারা এত বছরেও সামগ্রিক উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণে ও বাস্তবায়নে চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ।
ধৈর্য ধরা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। দুই দশক ধরে যক্ষের ধনের মত বাংলাদেশ ক্রিকেটকে আগলে রাখা সমর্থকদের ধৈর্য্য রাখার ধৃষ্টতা এই অভাজন পোস্ট মর্টেমকারী দেখাতে লজ্জাবোধ করছেন। তিনি নিজেও তো ভুক্তভোগী সমর্থক। দুই দশকের ধৈর্য্যের ফসল ক্রিকেট বোর্ডের শুভংকর খেয়ে নিয়েছে। প্রায় শুন্য থেকেই শুরু করতে হবে। (সমাপ্ত)
- 0 মন্তব্য