• ফুটবল

ক্লপ, আপনাকে টুপি খোলা অভিবাদন...

পোস্টটি ৬৮২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের মতে নাকি পৃথিবীর সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত। হাসি, কান্না, প্রেম- রোমাঞ্চ; সত্য মিথ্যা, জীবন- মৃত্যু; সব! তবু আমাদের যাত্রা কখনো সীমানা পেরিয়ে কসমোপলিটান প্রান্তরে; আবার কখনো সব হারিয়ে ফেলার বিস্ময় যুগান্তরে। 

পূর্বনির্ধারিত সবকিছুর গন্ডিতে আমাদের গন্তব্যহীন নিরন্তর বসবাস। হঠ্যাৎ একসময় আমাদের ভালোলাগায় ভেসে আসে ফুটবল নামে এক অদ্ভুত খেলা। আমরা যুগ থেকে যুগান্তরে তেপান্তর পেরিয়ে অদ্ভুত এক মিছিলে নিজেদের সামিল করি বুঝে- না বুঝে। সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত হলে আমাদের আবেগের জায়গা জুড়ে থাকা প্রিয় ফুটবল দল, প্রিয় ফুটবলারগুলোও কি পূর্ব থেকে নির্ধারিত ছিলো? 

জার্মানির মেইঞ্জের এক ভদ্রলোকের নিঃসঙ্গ একাকী, সংগ্রামী আর তীব্র অসুখী জীবনে প্রাণের সঞ্চার করেছিলো ফুটবল। নিজে খেলতেন, কাজ করতেন; পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে হাল না ছাড়া মনোভাবের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন একটা সময়। 

তারপর তিনি একটা সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধৈয্যশীল ফুটবল দলের দায়িত্ব নিলেন। ভদ্রলোক ম্যাজিক জানেন না ঠিক; তবে কিছু একটা তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলো বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড ভক্তরা। অশান্ত জনসমুদ্রকে এক পলকে শান্ত করে দিতে এক গাল রাশভারি হাসি হেসে বুক চাপটে হুংকার দিতেন। সে হাসিতে কোনো অহংকার থাকতো না। দিগ্বিজয়ের আনন্দও থাকতো না। তবু ম্যাজিক দেখিয়ে দর্শকদের যে আনন্দ ম্যাজিশিয়ানেরা পায়- চোখে মুখে যে অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠে তাদের; আমার ধারণা ভদ্রলোক সে হাসিই হাসতেন। 

ম্যাচ শেষে বিশাল ব্যবধানে হেরে গেছে তার দল। রাগ করে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার লোক তিনি নন। জনসমুদ্রকে সাক্ষী রেখে তার শীর্ষদের বুকে টেনে, মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করা উন্মাদ মানুষ তিনি। 

এই মানুষটিকে আমরা পেয়েছিলাম, একান্ত ডাগআউটে। মার্সিসাইডের এক পড়ন্ত বসন্তের ফুল ফুটা দুপুরে। তিনি হেসে হেসে মাতিয়ে রেখেছিলেন নিজের প্রথম দিনটা। নিজেকে যৎসামান্য প্রমাণ করতে বেছে নিলেন এক আইকনিক উক্তি; আমি মরিনহোর মতো স্পেশাল নই, আমি নরমাল ওয়ান। 

সেই 'নরমাল ওয়ান' ভেঙ্গেচুরে একাকার থাকা একদল যুবকদের মসৃন চাদরে মুড়িয়ে মুগ্ধতার রূপে প্রকাশ করলেন দুনিয়ার সামনে। ৩০ বছরের আক্ষেপ গোছালেন। কথা দিয়েছিলেন চার বছরের ভেতরে শিরোপা এনে দিবেন ক্যাবিনেটে। ভদ্রলোক কথা রাখলেন। দলকে ইউরোপীয়ান মর্যাদার শিরোপাও এনে দিলেন। 

৮ বছরের সংসার। সেই জার্মান ভদ্রলোক আমাদের একান্তই ইউর্গেন নোবার্ট ক্লপ। লিভারপুলকে এই সময়ে তিনি কি দিয়েছেন, সে হিসাব কষতে আমার ক্লান্তি লাগছে। অথচ কতকিছুই দেয়ার ছিলো। আর কতকিছুই তো পেয়েছি...

ক্লপ একজন শহুরে পাখি হয়ে মেট্রোপলিটন নগর থেকে গ্রামে বন্দরে; শহুরে দেয়ালে শিষ দিয়ে বেড়িয়েছে। আর অলরেড ভক্তরা তানজির তুহিনের গলায় কণ্ঠ মেলায়- 

আমি দেখিনি, আমি শুনিনি, আমি বলিনি অনেক কিছু; জানিনি, আমি বুঝিনি, তবু ছুটেছি তোমার পিছু....

ম্যাচ জিতলে যখন এই ভদ্রলোক বিশুদ্ধ ভালোবাসায় ক্লাবের পাশে দাঁড়ান; সকল উষ্ণতা ছড়িয়ে দেন- তখন অদ্ভুত এক মায়াজালে তার প্রতি আকর্ষণে পড়ে কোটি মানুষ। কত শরতের বিকেলে আনন্দে উদ্বেলিত করেছেন আমাদের, কত শীতের রাতে মন ভালো করার ওষুধের মতো কাজ করেছেন। কত অনিশ্চিত মূহুর্তের ত্রানকর্তা হয়ে আমাদের জীবন পাল্টে দিয়েছেন। 

জীবন এভাবে চললে কি আর এমন ক্ষতি হয়ে যেতো? পূর্বনির্ধারিত সবকিছুর মতো ক্লপ আমাদের ছেড়ে যাওয়াটাও নির্ধারিত ছিলো? অথচ আমরা তো এমন কিছু হবে কল্পনাও করতে পারতাম না একটা সময়। কি এক রহস্যে ক্লপ আমাদের কাবু করে ফেলেছেন দিনকে দিন! 

তার হুট করে ঘোষণা দিয়ে ক্লাব ছাড়া, যতটা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে তারচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে আমাকে। আমি ক্লপে বিশ্বাসী মানুষ। তার ক্যারিশিম্যাটিক ব্যক্তিত্বের মোহে পড়া মানুষ। আমি নিশ্চিত আমার মতো এমন কোটি মানুষ আছেন যারা ক্লপে বিশ্বাস রাখেন যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। 

আমি সম্ভবত একজন ভাগ্যবান মানুষ; ক্লপকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। একসাথে একটা কাছে হেঁটেছি। এই ছোট্ট মূহুর্তটাই আমার জন্য অনেক। উইল স্মিথের পারস্যুট অফ হ্যাপিনেস মুভির একটা উক্তি মাথায় ঘুরছে, 'This part of my life, this little part, is called happiness”. 

আধুনিক ফুটবলে কত কি সম্ভব। ৮ বছরের সম্পর্ক ছেদ করে অন্য ক্লাবে গিয়ে যোগ দেয়া, অন্য কেউ এসে আমার ক্লাবের দায়িত্ব নেয়া- সবকিছু সময়ের তালে আগাবে। শুধু যে শূন্যতা হবে তা হয়তো আর পূরণ হবে না। হয়তো আরোও ভালো কিছু ঘটবে! 

এই মৌসুমে শিরোপার খুব কাছে গিয়ে আমরা সেদিন ছিটকে গেলাম। এবার আর শিরোপা পাওয়া হচ্ছে না সম্ভবত। তাতে কি! ক্লাবের প্রতি সমর্থনে ছিটেফোঁটাও কমতি হবেনা এতটুক তো নিশ্চিত। 

এই ক্ষুদ্র সময়ে ক্লপ আমাদের যে বিশ্বাসের প্রতিদান দিয়েছেন, তার প্র‍তি আমার কৃতজ্ঞতা। আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ট ক্লাবদের একটির অংশ ছিলেন, থাকবেন। শত না পাওয়ার বেদনা ভুলে গিয়েও আপনার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে কোনো কার্পণ্য করবো না; সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ ক্লপ। 

এতোদিন আমাদের হাসিকান্নার মিশ্র আবেগে, সমস্ত সম্ভাবনার ফুল ফুটিয়ে যে অসংখ্য সুন্দর সব মূহুর্তের মিছিলে আমাদের সামিল করেছেন, তার জন্য ক্লপ আপনার প্রতি রইলো আমাদের টুপিখোলা অভিবাদন। আপনি কখনোই একা হাঁটবেন না।।