ছোট মাঠের বড় ক্রিকেট
পোস্টটি ২৬২৫ বার পঠিত হয়েছে‘আনঅর্থোডক্স’ ক্রিকেটে বেশ প্রচলিত শব্দ। প্রচলিত নিয়ম-ধারার বাইরে গিয়ে যা হয়, তাই তো আনঅর্থোডক্স। টি-২০ যেন এর বিশাল ফ্যান। নাসের হুসেইন গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ব্যার্থতার পর বলছিলেন, সময় এসেছে এরকম প্রতিভাদের পরিচর্যা করবার, সব কিছুকে ব্যকরন-গ্রামার এর কাঠামোতে বন্দী করে ফায়দা কোথায়! উপমহাদেশ নিঃসন্দেহে ‘আনঅর্থোডক্স’দের বিশাল কারখানা। গলি ক্রিকেট, স্ট্রিট ক্রিকেট এসবকে প্রেরনা জোগায়, এসব উৎপন্ন করে। কারনটা সহজ, যখন থেকে ক্রিকেট শুরু, তখন থেকেই গ্রাউন্ড, নেট, প্যাড এসবের ছোঁয়া পায় কজন? তখনই বোধহয় তৈরী হয় একজন লাসিথ মালিঙ্গার স্লিঙ্গার অ্যাকশন, জুনায়েদ খানের রান-আপের শুরুতে সেই বিশাল লম্ফ, আমাদের নাসির হোসেনের সেই হাড্ডিসার দুটো হাত থেকে বেরিয়ে আসে স্ট্রোকের ফুলঝুরি।
এরকম এক আনঅর্থোডক্স ক্রিকেটের গল্পই আজ শোনাই।
দিনাজপুর জিলা স্কুলের হোস্টেল। বিশাল এক মাঠ ছিল হোস্টেলে, কিন্তু বড় মাঠে ম্যাচ হতো রীতিমত ‘আয়োজন’ করে। দুই শিফটের স্কুল, ফলে 'টাইমিং' বলতে ঐ শুক্রবার নাহয় ছুটির দিন। তবে নিত্যিকার খেলা যেখানে হতো, আমরা তাকে বলতাম ‘ছোট মাঠ’। 'মাঠ' বলতে ডাইনিং এর সামনের এক চিলতে জায়গা। স্ট্যাম্প হলো একটা ইলেক্ট্রিক পোলের দাগ কাটা অংশ, অন্য এন্ডে একটা ইটের টুকরা। অফ-সাইডের তুলনায় লেগ সাইড খুবই ছোট, ফলে ঐ সাইড শট খেলার জন্য নিষিদ্ধ। সেদিকে একটা নির্দিষ্ট অংশ, গড়িয়ে হোক, উড়ে হোক, পার হলেই আউট! না শুধুই ব্যাটসম্যানদের হাতেই লাগাম পড়ানো হয়নি, সীমাবদ্ধতা রাখা হয়েছিল বোলারদের বেলায়ও! সামঞ্জস্য রাখতে তাই বোলারের উপরেও নিষেধাজ্ঞা আছে, বল লেগব্রেক হলেই ‘নো-বল’(ভাগ্যিস শেন ওয়ার্ন আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিলেন না!)। কোনো কোনো আম্পায়ার আবার লেগব্রেক নিয়ে বেশীই সচেতন হয়ে পড়তেন, বল অফ থেকে লেগে টার্ন করে নি, লেগের দিকে পড়ে সোজাই গেছে, তবুও নো ডেকে বসতেন! পিচ ছোট, স্বাভাবিকভাবেই বল ‘স্পিড’ হলেও নো(ফলে পূর্নাংগ অ্যাকশন নিয়ে বল করা যেত না,শুধু ছুঁড়তে হত)। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত নিয়মটা ছিল এই বোলিং অ্যাকশন নিয়েই, বল ডেলিভারীর সময় হাত কোনভাবেই তোলা যাবেনা মাথার উপরে! শুরুতে সীমাটা কান পর্যন্ত ছিল, পরে শিথীল করা হয়েছিল, হয়তো বোলার সংকটের কারণেই! এতসব নিয়মের বেড়াজালে বোলারের সংখ্যাই ছিল সীমিত, প্রায় ম্যাচে তো এমন হয়েছে, একজনই সব ওভার বল করেছেন! আর আম্পায়ারিং? সেতো বিভীষিকা, স্পেশালিস্ট বোলারের মত ‘স্পেশালিস্ট’ আম্পায়ারও ছিল অনুষংগ, বোলিং এন্ডের ব্যাটসম্যানকেই কাজ চালাতে হত বেশীরভাগ সময়ে!
এবার বাউন্ডারী, ’সার্কেল’ এর ভিতর খেলা, স্বাভাবিকভাবেই ছয় মারাও এখানে নিষিদ্ধ। তবে বল নো হলে ভিন্ন কথা, বলকে তখন আকাশপথে হোক, বা মাটিপথে- বাউন্ডারী পার করলেই হলো, মিলত অবশ্য সেই চার রানই। ‘অর্থোডক্স’ সুইপের সেখানে কোন মূল্যই নেই, যা কিছু মূল্যবান সবই আসত রিভার্স সুইপ আর প্যাডেল সুইপ থেকে। কেউবা আবার করতেন বা চেষ্টা করতেন রিভার্স প্যাডেল সুইপ করার!
এই প্যাডেল সুইপেও বিপত্তি আছে, দু-চারজন যে এটা করতেন দু পায়ের মাঝখান দিয়ে। বলাই বাহুল্য, বল বাউন্ডারী না গিয়ে স্ট্যাম্পেই আটকে গিয়ে ‘অকাল মৃত্যু’ ঘটেছে কত জনের। তবুও একেকজন যেন নেশার মত খেলতেন এসব শট, ’লাক্সারিয়াস’ শট বলে কথা!
এক থেকে শুরু করে আট ওভার- সব আকারেরই ম্যাচ হত সেখানে, হয়তো আট ওভারে ১১৬ রানের টার্গেট বেশ সহজেই উৎরে গেল প্রতিপক্ষ, আবার ১ রান করেও ম্যাচ জেতার মত ঘটনা সেখানে দুর্লভ নয়!
হোস্টেল সুপার হয়তো ‘নিষিদ্ধ’ সময়ে খেলার অপরাধে ব্যাট ‘সিজ’ করে নিয়ে গেছেন, তখন উপায়? তখন ব্যাটের অভাব পূরন করত একখন্ড লাঠি, রীতিমত গবেষনা করে বানানো থাকত সেসব, আমরা তাকে বলতাম ‘হান্ডার’। ‘হান্ডার’ দিয়ে খেলে কতজনের এমন অভ্যাস হয়ে যেত যে, পরে ব্যাট হাতে যেন অস্বস্তিতেই ভুগতেন কিছুটা!
আর হ্যাঁ,ফিল্ডিং, একেকজনের সে কী ডাইভ! হয়তো বল আটকানোর ‘ঝোঁকে’ ইটের উপরই ঝাঁপ দিয়ে বসলেন, কিংবা ধাক্কা খেলেন গাছের সাথে, পরোয়া কী? হ্যাঁ, সেই ছোট পরিসরেও এই জিনিসটাই ছিল সবচেয়ে প্রবল- প্রতিযোগীতা, জেতার নেশা, না হারার মানসিকতা। জানিনা আজকের ব্যক্তিগত জীবনে সেইসব ‘বিখ্যাত' 'ছোট-মাঠ' খেলোয়াড়দের কতটা কাজে আসে এসব!
হোস্টেল ছেড়েছি আজ বেশ কয়েক বছর হল। তবুও কোন এক বিকালে হয়তো বাসে বসে, হয়তো বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ হয়ে, হয়তো পুরোনো ‘হোস্টেল-মেটের’ সাথে আড্ডা দিতে দিতে কেন জানি উঁকি দিয়ে যায় সেই হোস্টেল, সেই ছোট মাঠ, সেই ‘হান্ডার’, সেইসব ‘বিখ্যাত’ খেলোয়াড়দের প্রায় ঝাপসা হয়ে আসা মুখ!
ক্রিকেট বোধহয় শুধুই জীবনের অনুষংগ নয়, জীবনটাই বোধহয় ক্রিকেটে বিলীন হয়ে যায় মাঝে মাঝে!
পুনশ্চঃ কলেজের হাউসেও এরকম ক্রিকেট খেলতাম, আমরা বলতাম ‘গেমস-রুম’ ক্রিকেট। গেমস রুমের জানালায় সবসময়ই পর্দার বদলে ঝুলত কাঁথা অথবা বেড-কভার। কোন জানালারই যে কাঁচ অবশিষ্ট ছিলনা, সেখানকার ব্যাটসম্যানদের তোপে।
সে গল্প আরেকদিন।
- 0 মন্তব্য