মধুরতম ম্যাচের পর
পোস্টটি ২৫৪০ বার পঠিত হয়েছেদিনটা হতে পারত, শুক্রবারের ছুটির দিনের যেকোনো এক অলস বিকেল বা সন্ধ্যা; হয়ে গেল জীবনের গুটিকতক স্মরণীয়তম দিনের একটি। সারাজীবনের স্মৃতির সিন্দুকে জমানোর জন্য অসাধারণ কিছু মূহুর্ত।
১৬ মার্চ,২০১২। আচমকা পেয়ে যাওয়া টিকেট পকেটে নিয়ে, ভিড় ঠেলে দু’টোর সময় গেইটে ঢোকার মুখেই প্রথম বাধা। সীমান্তহত্যার প্রতিবাদ জানাতে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া আর্টপেপার, মার্কার আটকে দিল নিরাপত্তাকর্মী। অল্প বিরক্তি নিয়ে সিট খুঁজে নিয়ে মাঠের দিকে নজর দিলাম। প্রথমবারের মত শচীনকে সামনাসামনি ব্যাট করতে দেখার মুগ্ধতা না কাটতেই গম্ভীরকে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে হাল্কা নাচের উপলক্ষ এনে দিল শফিউল ; এরপরের খেলার রাশ টেনে নিল শচীন-কোহলির জুটি, আমরা দর্শকরা প্রায় ঝিমিয়ে পড়েছিলাম সেসময়।
শচীন পঞ্চাশ পেরোনোর পরেই প্রেসবক্সে কাউন্টডাউন শুরু হল। আশির পরেই নিজেকে প্রায় গুটিয়ে নিলেন তিনি, পাশের গ্যালারিতে বসা বন্ধুর সাথে বাজিও ধরে ফেলা হল, কার বলে করা হবে প্রতীক্ষিত শতকটি। ৯৯ রানে পৌঁছানোর পর প্রতিপক্ষ ভুলে পুরো স্টেডিয়াম চিৎকার করছে তখন ‘শচীন,শচীন’ বলে। কারণ বছরের পর বছর ধরে তিনি নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন যে, তাঁকে কোনরকম দল-মত-বর্ণ ভুলেই সম্মান জানাতে হয়। দু'জনের কাউকে বাজিতে জিততে না দিয়ে সাকিবের বলটাকে যখন স্কয়ার লেগে ঠেলে দিলেন, পুরো স্টেডিয়াম তখন হাততালি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সম্মান জানাতে, এ পর্যন্ত করা ৪৭১৩ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির সবচে বিখ্যাতটি দেখার গৌরবময় অনুভূতি নিয়ে। সাক্ষী হয়ে গেলাম ইতিহাসের, যা বাকি সব ব্যাটসম্যানের স্বপ্নেই আসে কেবল, পৃথিবীতে নামিয়ে আনেন শচীন টেন্ডুলকার; যে ল্যান্ডমার্কে পৌঁছে উপরে কেবল আকাশই দেখা যায়। টেন্ডুলকারকে ‘স্টার’ হতে দেখা আমাদের প্রজন্ম আরো ভাগ্যবান হলাম ঢাকার মাঠের এ কীর্তি নিজ চোখে দেখায়। শতকের শতক দেখার যে অপার্থিব দৃশ্য পৃথিবীতে আর কেউই কোনদিন দেখবে না হয়ত। ( সেঞ্চুরির দিকে নিকটতম পন্টিংয়ের ৭১,ক্যালিসের ৬২)
মাঠের দর্শকের মাঝে কানাকানি শুরু হল নতুন জন্ম নেয়া মিথের- শচীন সেঞ্চুরি মানেই দল হারলো। (পরিসংখ্যান অবশ্য অন্য কথা বলে, ৫১+৪৯=১০০ সেঞ্চুরির মাঝে ১১+১৩=২৪ টিতে হেরেছে তাঁর দল) শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইটের আলোতে বিশ্বকাপে ২৯৬ করতে পারলে আজ-ও ২৯০ করা সম্ভব কিনা, শচীন ছিল বলে ১৫/২০ রান কম হল কিনা – এসব হাল্কা তর্ক নিয়ে কাটল বিরতি।
এর পরের গল্পটা কেবলই আমাদের। শুরুতে অবিবেচকের মত খেলে নাজিম উইকেট হারালেও তামিম-জহুরুল ঘামেভেজা শ্রমিকের মত অল্প অল্প করে ইনিংসের ভিত গড়া শুরু করে ১১৩ রান যোগ করে বিচ্ছিন্ন হল। এরপরেই টিম ম্যানেজমেন্ট নিলেন ম্যাচের সবচে বিচক্ষণ সিদ্ধান্তটি- ইনফর্ম নাসিরকে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন দিয়ে চারে পাঠানো। আগের দিনই তর্ক করছিলাম বন্ধুর সাথে এ নিয়ে; পাশের জনকে বললাম- নাসির থাকলেই আজ হয়ে যাবে।
অল্প অল্প করে বাড়ছিল আস্কিং রেট। বিতর্কের পর দলে ফেরা তামিম স্বভাববিরুদ্ধ দৃঢ়তার পর যখন ক্রিজ ছাড়ল, তখন দরকার ৯৭ বলে ১৩৪। সাকিব নামল। ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে যখন ৪৬ আসল, তখন প্রথমবারের মত জয়ের ঘ্রাণ নাকে আসা শুরু করল। বারবার স্কোরকার্ডের দিকে তাকিয়ে তখন সবাই পাক্কা গণিতবিদ একেকজন, সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত। শেষ ১০ ওভারে দরকার ৮২, ৫০ বলে ৬৬; আরেকটি সাকিব-ম্যাজিকে যখন উন্মাতাল স্টেডিয়াম, তখনই ছোটদলের সাথে দেয়া আরো একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তে দর্শকদের ক্রোধের মাঝে সাকিবকে ফিরতে হল সাজঘরে।
বারবার তীরে এসে খেই হারিয়ে ফেলা দলকে পথ দেখাতে নামল এরপর মুশফিক। মাঠের সবচে খর্বাকৃতির ছেলেটা হয়ে উঠল পাহাড়সম। ৪৮-তম ওভারের একেকটি চার-ছয়ের সাথে আমিও তখন একেকবার বন্ধুদের বুকে-কোলে। রিয়াদের ম্যাচজয়ী বাউন্ডারিটা সীমানার দড়ি ছোঁয়ার আগেই পর্দার সামনের দর্শকরা পৌঁছে গেল রাস্তায়। আমি তখন স্টেডিয়াম দক্ষিণ-পূর্ব গ্যালারির লোহার গ্রিলের উপরে উঠে নৃত্যরত।
বের হবার সময় কিনে ফেলা ভুভুজেলা বাজিয়ে,পতাকা মাথার উপর নাচিয়ে আমরা সবাই তখন বিজয়-মিছিলে। ফিরতি পথে বাসের জানালা দিয়ে, হাতের মুঠোটা আরেকটু শক্ত করে বারবার চিৎকার দিচ্ছিলাম- ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে।
বহুবছর পরও যখনই শচীনের শততম শতকের প্রসঙ্গ আসবে, আমরাও গর্বভরে মনে করব এর কথা, কারণ ম্যাচশেষে ষোল কোটি লোকের গর্জনে এই অর্জন সেদিন চাপা পড়ে গিয়েছিল।
ম্যাচটা ছিল অনেককিছুর জবাব দেয়ার। সীমান্তহত্যা- ট্রানজিটের টালবাহানার জবাব, ক্রিকেট-বাণিজ্যের ক্ষতির ভয়ে সেদেশে খেলার আমন্ত্রণ না জানানোর জবাব, নাকউঁচু সিধু-মন্দিরাসহ ভারতীয়দের মন্তব্যের জবাব। মাশরাফির স্লগওভারে স্বভাববিরুদ্ধ ভালো বোলিং কিংবা তামিমের ৭০, জহুরুলের ৫৩, নাসিরের ৫৪, সাকিবের ৩১ বলে ৪৯, মুশফিকের হার-না-মানা ২৫ বলে ৪৬ হয়ত পথ দেখাল পুরো দলকে এক সুতোয় বেঁধে ‘একটি’ দল হিসেবে খেলার। প্রয়াত রানাকে উৎসর্গ করা যে ম্যাচে তাই একা কোন নায়ক নেই, ম্যাচজেতার পর ড্রেসিংরুমে করা ‘আমরা করব জয়’ গানের সময় মধ্যমণি ছিল না তাই একা কেউ।
বাঘের বাচ্চারা বাঘই হয় !
- 0 মন্তব্য