• অন্যান্য

ক্রিকেটের সাথে বেড়ে ওঠা

পোস্টটি ২২২৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

তখন আমার ছিল হাফপ্যান্ট পরার বয়স। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অ্যাকশন প্র্যাকটিস করতাম, হ্যাঁ, ঠিক এভাবে বলটা ছুঁড়তে হবে! আমাদের দুকামরার ঘরে একরত্তি জায়গাটা চ্ছিল আমার রানআপের জন্য বরাদ্দ। দিনমান কেটে যেত এভাবে। বিকেলে সামনের উঠোনে নাম বেটে খেলা। খুব জোরে বল করা যাবে না, বলটা যে হারিয়ে যাবে! আরেকটা বল, ওরে বাবা, পাক্কা ১৫ টাকা দাম। কে দেবে অত টাকা? 

 টিভি বলতে চিনতাম শুধু বিটিভি। ঈদের সময় আনন্দমেলা, শুক্রবার সকালে মনের মুকুরে, দুপুরে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি। তখন বাসায় রাখতাম ভোরের কাগজ।  বুঁদ হয়ে পড়তাম টেন্ডুলকার, লারাদের জাদুকরী সব ইনিংসের কথা। ওই যে, সাদাকালো ছবিতে ব্যাট উঁচিয়ে আছে টেন্ডুলকার! হাতটা ব্যাট বানিয়ে শ্যাডো করতে করতে ভাবতাম, একদিন আমিও...

এমন সময় পড়লাম মালয়েশিয়ায় কিলাত ক্লাব মাঠে আইসিসি ট্রফি হচ্ছে। সেটাতে ফাইনালে উঠলে নাকি বিশ্বকাপে খেলবে। বিশ্বকাপ! তখনো মাত্র জয়াসুরিয়া, কালুভিতারানাদের স্মৃতি চোখে লেগে আছে। সে কি ধুন্দুমার মার!সেই টেন্ডুলকার স্টাম্পড হিয়ে গেল জয়াসুরিয়ার বলে।  আর রিচি রিচার্ডসনের শট তো আম্পায়ারের কানটাই ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেই বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ!

পেপারে-টেপারে কী লিখেছিল এখন আর অতশত মন নেই। হঠাৎ একদিন ছোটমামা এসে পড়ল, বাংলাদেশ হল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গেছে। এই ম্যাচটা জিতলেই নাকি বিশ্বকাপ। আমার ছোট্ট মনের বিশ্বকাপের আকাশ ছোঁয়ার বয়স তখনো হয়নি।

এমন সময় একদিন হঠাৎ ছুটি হয়ে গেল স্কুল। বিজ্ঞান টিচার এসে বললেন, বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে গেছে। তার মানে বিশ্বকাপ! আকরাম, বুলবুলদের নামটাম তখন শুনেছিলাম শুধু। আর  একটু একটু পড়েছিলাম পেপারে। বিশ্বকাপে ওঠার আনন্দে আমরা একটা আস্ত টেনিস বল কিনে ফেলি। কোত্থেকে যেন স্কুলে একটা ব্যাটও জোগাড় হয়ে যায়। সেদিন আর আমরা কেউ লারা-টেন্ডুলকার নই, সবাই আকরাম, বুলবুল, নান্নু।

ফাইনাল কেনিয়ার সাথে। সকালে ছোটমামা এসে বলল,চল রেডিওতে খেলা শুনবি। মামাবাড়ির ট্রানজিস্টরটা ছিল মস্ত। সেখান থেকে গমগম করে কার যেন ধারাভাষ্য শোনা যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, কেনিয়ার ওদুম্বে-টিকোলো নামের দুইজন বেদম পিটুনি দিচ্ছে। আমাদের সবার একটু মন খারাপ হলো। আইসিসি ট্রফিটা কি আমাদের আর জেতা হবে না ?

পরদিন শুনি বৃষ্টির জন্য খেলা আবার শুরু হয়েছে। আবার রেডিওতে কান লাগিয়ে উৎকর্ন হয়ে অপেক্ষা। এবার টার্গেট ছোট, ওভারও অবশ্য কম। কিন্তু সেদিনটা আসলে আমাদেরই ছিল। একেকটা চার হয়, আর আমরা উল্লাসে ফেটে পড়িতে থাকি। শুরুর দিকে এসে আম্মু মুখ ঝামটা দিয়ে যাচ্ছিলেন, ক্রিকেট ক্রিকেট করে ছেলেপেলে সব বরবাদ হয়ে গেল। একটু পর দেখি, আম্মা নিজেই এসে বলছেন, ভলিউমটা বাড়িয়ে দে, রান্না করতে করতে শুনব। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি।

খেলা তখন শেষের দিকে। ধারাভাষ্যকার বারবার বলছেন, ম্যাচে টানটান উত্তেজনা। হঠাৎ চিৎকার, ছক্কা! পাইলট নাকি বল সীমানার ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছে। আনন্দ, রোমাঞ্চের অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আমি কাঁপতে থাকি। চলে আসে শেষ বল। এক বলে তখন দরকার এক রান। আমরা সবাই থরোথরো করে কাঁপছি। সবার শুধু দেহটা দেশে, মন ওই কিলাত ক্লাবে। জিতে গেছি, হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন ছোটমামা। আমার একন জানি বিশ্বাস হতে চায় না! যাহ, আমরা টুর্নামেন্ট জিতে গেছি ? আসলেই ? কে যেন একটু পর এসে আমাকে রঙ মাখিয়ে দেয়। জীবনে সেই প্রথমবার রঙ লাগে গায়ে। ক্রিকেট এরপর অবশ্য আরও অনেকবার আমাদের মনে রঙ লাগিয়েছে বটে।

সেই শুরু। এরপর আরও কতোশতো স্মৃতি। বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। বিশ্বকাপের আগে সে কী প্রতীক্ষা। সারাদিন বসে থাকতাম, কখন বিটিভিতে গুডলাক বাংলাদেশ গনিটা দেখাবে। “পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমার ঢেউ বিশ্ব দেখুক... যাত্রা শুভ হোক”... হুনহুন করে গাইতে গাইতে কী যে দারুণ একটা অনুভূতি হতো। তখন আরেকটু সেয়ানা হয়েছি, ক্রিকেটের অন্ধিসন্ধির খবর জানতে শুরু করেছি।

চলে আসল বিশ্বকাপ। একেকটা রানও তখন আমাদের কাছে কত মহার্ঘ্য ! মাঝে মাঝে আবার নান্নুর ব্যাটের কানায় লেগে চার হয়ে যায়। সেসব অবশ্য আমরা টিভিতেই দেখতে পাচ্ছিলাম। ওই যে রক্তমাংসের শান্ত, পাইলট। এর মধ্যেই আবার হারিয়ে দিল স্কটল্যান্ডকে। এরপর পাকিস্তানকেও হারানো, উরেব্বাস! মনে আছে আব্বার বন্ধুরা মিলে একটা মেজবানের আয়োজন করেছিলেন সেই উপলক্ষে।

দুঃখও কী কম দিয়েছে ? ঈদের আগের দিন, আয়েশ করে গ্রামের বাড়িতে বসে আছি জয় দেখব বলে। ওমা, কোথাকার কোন কানাডা এসে হারিয়ে দিয়ে গেল। সেবারের মতো ম্যাদামারা, পানসে ঈদ আজ অবধি কাটাইনি। পুরো ঈদটাই যেন মাটি হয়ে গিয়েছিল।

কান্না ? সেটাও দিয়েছে। এশিয়া কাপের সেই ফাইনালের কথা কি সারাজীবনেও ভোলা যাবে? মাঠে কাঁদছিল মুশফিক, সাকিবরা, আর তাদের সাথে কাঁদছিল পুরো দেশ। 

স্বপ্ন যেখানে দেখার সুযোগ, সেখানে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা থাকবেই। আনন্দের সাথে গলাগলি করে থাকবে বেদনারা। প্রাপ্তির সাথে থাকবে হতাশা, বঞ্চনা। ক্রিকেট ছাড়া এতসব অনুভূতির সাথে আমাদের আর একাত্ম করেছে কে?  ভাবতে অবাক লাগে, এক সময় একটা জয়ের অপেক্ষায় আমরা বসে থাকতাম দিনের পর দিন, এখন সেই জয় কতো অনাআয়সেই না আসে। ভাবা যায়, একসময় টানা পাঁচ বছর আমরা একটা ম্যাচও জিতিনি! একসময় একটা জয় পেলে টিএসসি ছুটে যেত সবাই, এখন সিরিজ জিতলেও তেমন কোনো উৎসব হয় না। কে জানে , পরেরবার হয়তো বিশ্বকাপ পেলেই...

আমাদের প্রজন্মটা অনেক কারণে ভাগ্যবান। আমরা টেন্ডুলকার লারাদের স্বর্ণযুগ দেখেছি, দেখেছি ম্যাকগ্রা, আকরাম, ওয়ার্ন, মুরালিদের। কিন্তু ব্যাঘ্রশাবকদের যে বেড়ে ওঠাটা চোখের সামনের দেখেছি, সেটাকেই আমি এই প্রজন্মের পরম পাওয়া বলে মেনে নেব।

দিনশেষে ক্রিকেটেই তো আমরা দুদন্ড শান্তি খুঁজি !