যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত এক 'কয়েদী'র গল্প
পোস্টটি ২৮১৪ বার পঠিত হয়েছেআজ তাঁর ১৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
তিনি মারা গেছেন ২০০০ সালে। সেও প্রায় ১৬ বছর হতে চললো। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৫০ জন। পরদিন ব্রাজিলের এক দৈনিক শিরোনাম করেছিল ‘বারবোসার দ্বিতীয় মৃত্যু !’
তার প্রথম মৃত্যু (!!!) হয়েছিলো প্রায় ২ লাখ মানুষের সামনে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। ২ লাখ। দিনটা ছিল ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই। মৃত্যুস্থান ব্রাজিলের মারাকানা।
১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল। সেবার বিশ্বকাপ হয়েছিলো পয়েন্টের বেসিসে। অর্থাৎ যার পয়েন্ট বেশী সে চ্যাম্পিয়ন। পয়েন্ট টেবিলের উপরের দুটি দল ছিল ব্রাজিল এবং উরুগুয়ে।
উরুগুয়ে তখন আটবার কোপা আমেরিকা এবং একবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। তার পরও স্বাগতিকরাই ফেভারিট ! ড্র করলেই ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন। শিরোপার এতটা কাছে থাকায় চারদিকে তাই সাজসাজ রব পড়ে যায়। ম্যাচের দিন-তারিখ নির্ধারিত হয় ১৬ জুলাই।
ব্রাজিলের সংবাদপত্রগুলোও বসে থাকেনি। দেশটির প্রভাবশালী দৈনিক 'ও মুন্ডো' জাতীয় দলের বিশাল এক ছবিসহ ক্যাপশনে ‘এরাই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’ লিখে ম্যাচ শুরুর আগেই একটা সংষ্করন প্রকাশ করে। জাতীয় দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের নামাঙ্কিত স্মারক মুদ্রা পর্যন্ত বাজারে ছেড়েছিল তারা! একদল মিউজিশিয়ানও প্রস্তুত রাখা হয়। ম্যাচ শেষে তাদের দায়িত্ব ছিল জয়ী দলের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো। ব্রাজিলের জাতীয় সঙ্গীত এবং ১১ জন খেলোয়াড়কে নিবেদন করে ‘ব্রাজিল ক্যাম্পিও’ নামে বিশেষ একটি গানের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন বাদকরা। কিন্তু উরুগুয়ের জাতীয় সঙ্গীতকে প্রস্তুতির তালিকায় রাখা হয়নি । আয়োজকরা প্রয়োজন মনে করেননি!
গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেলের সার্থক উদাহরণ!!!!!!!!!!
ব্রাজিলিয়ানদের প্রস্তুতির বহর দেখে উরুগুয়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও ভড়কে যান। ম্যাচ শুরুর আগে দূতাবাস থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা উরুগুয়ের ড্রেসিংরুমে ঢুকে উরুগুয়ের অধিনায়ক ভ্যারেলাকে অনুরোধ করেছিলেন, “হারের ব্যবধান যেন কোনোমতেই ছয় পর্যন্ত না যায়। চার পর্যন্ত আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে সন্তুষ্ট!”
কিন্তু ভ্যারেলা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কোচ হুয়ান লোপেজ পর্যন্ত রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলার নির্দেশ দেওয়ায় উরুগুয়ে ফুটবলের ‘ব্ল্যাক চিফ’ নামে খ্যাত এ ফুটবলার তাঁর সতীর্থদের বলেছিলেন, “হুয়ান খুব ভালো মানুষ। কিন্তু আজ তার সিদ্ধান্ত ভুল। এসব কথার কোনো মুল্যই থাকবে না, যদি আমরা ম্যাচটা জিততে পারি। তাই হারের জন্য আমরা কোনভাবেই মাঠে নামবো না। চার গোলের ব্যবধানে তো প্রশ্নই আসে না।”
মারাকানার নির্মাণকাজ তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। প্রায় ১ লাখ ৯৯ হাজার দর্শকের মধ্যে উরুগুয়ের সমর্থক ছিল একশ’রও কম! টানেল দিয়ে ভ্যারেলা তার দল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করতেই বজ্রনিনাদে ফেটে পড়ে সমর্থকরা। অধিনায়ক তার টিমমেটদের ভরসা দিয়ে বলেন, “ভেবো না, গ্যালারির কেউ খেলবে না।”
খেলা শুরু হওয়ার পর অসাধারণ খেলতে থাকে ব্রাজিল। কিন্তু দুর্দান্ত খেলেও প্রথমার্ধ গোলশূন্য ছিল তাঁরা। বিরতির পরে ফ্রিয়াকা ৪৭ মিনিটে গোল করে এগিয়ে দেন ব্রাজিলকে। মারাকানাতে তখন ২ লাখ দর্শকের গর্জনে কান পাতা দায়। ৬৬ মিনিটে শিয়াফিনো গোল করে সমতায় ফেরান উরুগুয়েকে। ব্রাজিলিয়ানরা তখনো আশায় বুক বেঁধে ছিল।
বিকজ ওয়ান ড্র ইজ এনাফ।
কিন্তু খেলা শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে ডান দিকে বল পেয়ে যান উরুগুয়ের উইঙ্গার অ্যালসিডেস ঘিঘিয়া। ব্রাজিলের লেফটব্যাক বিগোদাকে বোকা বানালেন। সবাই ভেবেছিল, ঘিগিয়া পাস দেবেন। সবাই’র মধ্যে ছিলেন বারবোসাও। আন্দাজ করতে পেরে পজিশন থেকে একটু সরে যান ব্রাজিল গোলরক্ষক তিনি। এই ভুলটাই তার বাকি জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ফাঁকা জায়গা পেয়ে শট নেন ঘিঘিয়া।
গোল!!!!!!!!!!!!
কোন এক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছিলেন, “সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন।” আসলেই কি তাই? জনসমুদ্রের গর্জন তখন ‘ঘিঘিয়া’ ঝড়ের পরে একদম নিস্তব্ধ। এ ব্যাপারে অনেক পরে ঘিঘিয়া বলেছিলেন, “কেবল মাত্র তিনজন মানুষ মারাকানাকে স্তব্ধ করে দিতে পেরেছিলো। পোপ দ্বিতীয় জন পল, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা এবং আমি।”
শেষ বাঁশি বাজার পর হার সহ্য করতে না পেরে অনেকেই লাফিয়ে পড়েছিল মারকানার ছাদ থেকে। কেউ কেউ আত্নহত্যাও করে বসে! পরের কয়েকদিন শহরের প্রতিটি ঘরের জানালা বন্ধ ছিল। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। মনে হচ্ছিল, প্রত্যেক ব্রাজিলিয়ান তাদের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে হারিয়েছে। সব সম্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়ার নির্মম বেদনা কেউই সইতে পারেনি। অনেকেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, ফুটবলের ইতিহাসে ১৬ জুলাই যেন আর কখনোই ফিরে না আসে।’
উৎসবের মুখরতা থেকে ব্রাজিলিয়ানদের আশ্চর্য পতন ছুঁয়ে যায় ভ্যারেলাকেও। ফাইনালের পর সারা রাত এক বারে কাটিয়ে দেন তিনি। খুন হয়ে যেতে পারেন, এই ভয়ে তার কোনো সতীর্থই রাস্তায় বের হননি।
এরপরেই উৎপত্তি হয় সেই বিখ্যাত শব্দের। “মারাকানাজ্জো।” মারাকানার দুঃখ।
মারাকানা বিপর্যয়ের পর ১৯৫০ বিশ্বকাপের গোলরক্ষক বারবোসাকে দায়ী করে গোটা ব্রাজিল। ব্রাজিল কখনোই ক্ষমা করেনি এই গোলরক্ষককে। বারবোসা একবার ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশনে যান। কিন্তু ফেডারেশনের সভাপতি বারবোসা এসেছেন শুনে দরজা বন্ধ করে দেন। মারাকানা ট্র্যাজেডির ৪৩ বছর পরও বারবোসাকে ব্রাজিলের কোন ম্যাচে ধারাভাষ্য দিতে দেয়নি দেশটির ফুটবল ফেডারেশন। ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপের আগে বারবোসা ব্রাজিলের ড্রেসিংরুমে যেতে চাইলে ব্রাজিলের তৎকালীন সহকারী কোচ মারিও জাগালো নাকচ করে দেন। তার মনে হয়েছিলো বারবোসা হয়তো ব্রাজিলের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসছেন!! একবার এক বারে গিয়েছিলেন বারবোসা। সেখানে এক মহিলা তার ছেলেকে বারবোসাকে দেখিয়ে বলেছিলো, “দেখো, এই লোকটা ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছিল।”
চরম হতাশ বারবোসা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমাকে সারাজীবনে যা শুনতে হয়েছে তাতে আমি রিঅ্যাক্ট করলে আমার জায়গা হতো হয় কবরে নাহয় জেলখানায়।” তিনি আরও বলেছিলেন, “ব্রাজিলের আইনে যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ ৩০ বছর। কিন্তু আমার জন্য তা হয়ে গেছে ৫০ বছর।”
বিনা দোষে ৫০ বছর জেল খাটানোর জন্য ‘জেলার’ অ্যালসিডেস ঘিঘিয়াকে দোষারোপ করতেই পারেন মোয়াসির বারবোসা।
- 0 মন্তব্য