• ক্রিকেট

মরুগোলাপ

পোস্টটি ১৮৭৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

-‘আপনার জন্য বলিউডি গানের সুব্যবস্থা আছে।’
-‘ওসব হামেশাই শোনা হয়। আমার পশতুও চলে’
-‘তা হয় কিভাবে ? আপনি আমাদের মেহমান। এদেশকে যেন নিজের ঘর মনে করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা আমার দায়িত্ব -’ সাইদ রহমান আহমেদজাইয়ের কণ্ঠে প্রতিবাদের স্বর। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সহ-সম্পাদক সিদ্ধার্থ মঙ্গা তার অতিথি। কাবুল থেকে গাড়ীতে জালালাবাদ যাচ্ছেন তারা। পাকিস্তানের সীমান্ত তখনো কুড়ি কিলোমিটারের দুরত্ব। ওপারে পেশোয়ার, এপারে জালালাবাদ। আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এখান দিয়ে দিয়ে অবাধে প্রবেশ করে পাকিস্তানের সকল শিল্প ও কৃষিজাত পণ্য। তারপর ছড়িয়ে পড়ে গোটা আফগানিস্তানে। জালালাবাদ তাই আফগানদের সকল সামাজিক এবং ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের হৃৎকোরক।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভৌগলিক নৈকট্যই যে তার নেপথ্য কারণ-তা আর কারো অজানা নেই। কিন্তু, যে কথাটা কেউ জানেনা, তা হলো-জালালাবাদ আফগানিস্তান ক্রিকেটের রাজধানী। এর নেপথ্য অনুঘটকও ডুরান্ড লাইন, যেখান দিয়ে দুই দেশের ক্রিকেটারদের অবাধ ভাব বিনিময়ের পাশাপাশি, সন্ত্রাসীদের যাতায়তও একেবারে খোলা বইয়ের পাতার মতো ! এ অঞ্চলে বিদেশীদের সঙ্গ দেয়া মানে, পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটা হাতে নিয়ে ঘোরা। আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একাডেমির কোচ এবং গ্রাউন্ড ইন চার্জ সাইদ রহমান রাজি হওয়ার আগে, ঠিক এ কারণে আরও দুইজনকে জালালাবাদ যাওয়ার অনুরোধ করেও প্রত্যাখাত হন সিদ্ধার্থ মঙ্গা।


কাবুল, ভারত এবং পাকিস্তানের প্রাচীন শহরগুলোর মতোই জনবহুল। সড়কগুলো ভীষন ব্যস্ত। মার্কেট থেকে ফুটপাত পর্যন্ত বর্ণিল পণ্যের সমারোহ। বেশকিছু শপিং মলও গড়ে উঠেছে। টয়োটার আধিক্য চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এমন ব্যস্ত জনজীবনে বোমা ফাটার আওয়াজ শুনে এখন আর কেউ চমকে ওঠেনা। হোটেলগুলোতে প্রতি সপ্তাহে রুটিনমাফিক তল্লাশী চলে। রাস্তায় সশস্ত্র প্রহরীর কড়া চোখ। কিন্তু তারপরও বোমা ফাটছে। খৈয়ের মতো ! কাবুলের দৈনন্দিন জনজীবনে ‘তালেবান আতঙ্ক’ এখনো জীবিত। গত বছরের জুন থেকে আফগানিস্তানে কোচের দায়িত্ব নেয়া সাবেক কিউই অ্যান্ডি মোলসের অভিজ্ঞতাটা এরকম,‘-কোচিংয়ের মাঝে আশে পাশে কোথাও বোমার ফাটার আওয়াজ সবার কানে সয়ে গেছে। ব্লাক হক হেলিকপ্টারগুলো মাঠের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। মিশন শেষ করে ফিরে আসে। এসব দেখে মাঝেমধ্যে নিজেকে মনে হয়, যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানানোর কোচিং করছি ! ব্যাপারগুলো একেবারেই গা সওয়া হয়ে গেছে। এ কারণে রাস্তায় বের হলে এখন আর ভয় লাগেনা।’


সিদ্ধার্থ মঙ্গার মানসিক অনুভূতিটাই মোলসের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। জালালাবাদ রওনা হওয়ার আগে মুফতে কিছু উপদেশ পান সিদ্ধার্থ- বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরো কারণ তোমার গাড়ীতে বর্ম নেই, গাড়ী থেকে ভুলেও নেমোনা,.. ইত্যাদি। কিন্তু মোলস প্রতিদিন রাস্তায় যেভাবে বেরিয়ে থাকেন, সেরকম করেই বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং বর্মযুক্ত গাড়ীতে চড়ে বসা থেকে বিরত থাকেন সিদ্ধার্থ। তার মন সায় দেয়নি। অথচ, জালালাবাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিদেশী পর্যটকরা রসিকতা করে বলে থাকেন,‘এখানে বোমার থেকেও ড্রাইভিং বেশি বিপদজ্জনক’ ! তাদের বহনকারি গাড়ীটির ড্রাইভারও বেশ রসিক মানুষ। কাবুল থেকে বের হওয়ার পথে তার উক্তি,‘এখানে ড্রাইভিং, আর ‘বুজকাশি’র মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।’ পোলো খেলা দেখে থাকলে আফগানদের ‘বুজকাশি’র মর্ম উদ্ধার সম্ভব। একটি গোলাকার আকৃতির বল দিয়ে পোলা খেলা হয়। বাকি সব ঠিকঠাক, শুধু বলের জায়গায় একটা মৃত ছাগল ! তাই খেলাটির নাম ‘বুজকাশি’ ! ঘোড়ায় চড়ে মৃত ছাগল দখলের এ লড়াই আফগানদের জাতীয় খেলা।

ড্রাইভারের রসিকতা, আফগান মরুভূমির বিরান সৌন্দর্য্য এবং পথের দুই ধারে অগণিত ভেড়ার পাল দেখার ক্লান্তিতে ক্ষিদে পায় সিদ্ধার্থের। সম্বল বলতে আফগান নান রুটি এবং ঘি। অন্যকিছুর প্রয়োজন নেই। খাবারটা দীর্ঘ সময় পেটে মজুদ থাকে, বিধায় আফগানদের ভীষন প্রিয়। একেকটি প্রমান সাইজের নানরুটি দোকানগুলোতে জামা-কাপড়ের মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়। একাডেমি দল নিয়ে লক্ষৌর স্কুল দলের মুখোমুখি হওয়াকালিন দিল্লি পর্যন্ত খাবার-দাবারের ঝামেলাটুকু নান রুটি দিয়ে সেরে নিতেন সাইদ রহমান। আফগান ডালিমগুলোও আকৃতিতে বেশ বড় বড়। ভেতরে রসের প্রাচুর্য থাকায় ‘খাওয়ার সময় পোশাক সাবধান’-আগেই সতর্কবার্তা পেয়েছে সিদ্ধার্থ। আফগানরা তাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডে সবসময় একটি জিনিষ সঙ্গে রাখে-‘সেঞ্চা’। সবুজ চায়ের মতো পানীয়টি খেতে ভালই লাগে সিদ্ধার্থের। সে খাবার নিয়ে মত্ত থাকার সুযোগে সাইদ রহমান নিলর্জ্জের মতো দায়িত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে, পশতু গানের বদলে চালিয়ে দেয় বলিউডের কিছু চটুল গান। সিদ্ধার্থের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নিতে সে টোপ ফেলে-‘আপনার জন্য দুধপট্টির (দুধ-চা) ব্যবস্থা করতে হবে। অতিথি বলে কথা’ !
-না, আমি চায়ে দুধ কিংবা চিনি পছন্দ করিনা।
-আপনি খাঁটি ভারতীয় তো ! -সাইদ রহমানের কণ্ঠে সন্দেহ।


পশতু সঙ্গীত এবং বলিউডি গানের মল্লযুদ্ধ চলতেই থাকে। কোনপক্ষই হার মানতে রাজি নয়। একজন, সৌজন্যতাবোধ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর, আরেকজন তার অতিথিসেবা প্রমানে মরিয়া। শেষ পর্যন্ত জয়ী অন্যকেউ। গুলাম আলী ! পাকিস্তানের কিংবদন্তি গজল শিল্পি। সিদ্ধার্থ এবং সাইদ, দুজনেই ভাল উর্দু জানায় পেনড্রাইভে নিয়ে আসা গুলাম আলীই মল্লযুদ্ধ থামিয়ে দেয়। সাইদের শৈশব কেটেছে পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে। গুলাম আলীকে দ্বৈরথে ঠেলে দিয়ে সে বলে,‘পাকিস্তান সঙ্গীতশিল্পি এবং কৌতুকভিনেতারা ভারতীয়দের থেকে অনেক ভাল।’ সিদ্ধার্থ গানের ভলিউম বাড়িয়ে দেয়। স্পিকারে দরাজ কণ্ঠে গেয়ে চলেন গুলাম আলী-‘আওয়ার্গি’ (ভ্রমনক্ষুধা)। একেবারে খাপে খাপ !

গুলাম আলী প্রশ্ন করেন -‘ইস দ্যশত ম্যেইন এক শেহের থা, ও ক্যায়া হুয়া আওয়ার্গি’ ? সাইদ রহমানের দৃষ্টি সামনের উষর মরুভুমিতে। ‘দ্যশত’-পারস্য ভাষার শব্দ, যার অর্থ-মরুভূমি। শেহের, মানে নগর। অর্থাত্-‘একসময় এ মরুভূমিতে প্রাণ ছিল। তার কি হলো ’ ? সিদ্ধার্থের মনে হলো, হাজার বছর ধরে জবুথবু হয়ে বসে থাকা পাহাড়গুলোর কাছে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে। ওরাই তো সবকিছুর নীরব সাক্ষী ? যুদ্ধ-বিগ্রহ, গোঁড়ামি, জাতিগত বৈষম্য, রাশিয়ান, আমেরিকান, জিহাদি-এসবকিছুর সাক্ষী ওই পাহাড়গুলো, ভাবতে ভাবতে সিদ্ধার্থদের গাড়ী মাহিপুর পেরিয়ে যায়। মাহি অর্থ-মাছ, ‘পার’ অর্থ-উড়ন্ত। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাবুল নদী মাছে গিজগিজ করে। তখন লাফ দিয়ে পানির ওপরে ওঠা মাছগুলোকে উড়ন্ত বলেই মনে হয় ! জালালাবাদ যত নিকটবর্তী হচ্ছে, গুলাম আলীর প্রশ্নের সত্য ততই বিবসনা হয়ে পড়ছে সিদ্ধার্থের সামনে । তার চোখের সামনে চারপাশ ঘেরা সুবিশাল বিরান প্রান্তরটি একসময় গোটা এশিয়ার মধ্যে সেরা জলপাই প্রসব করতো। উর্বর কাদামাটি এবং শীতকালে তুষারপাত হয়না, যে কারণে জলপাই আবাদের জন্য জায়গাটা ছিল আদর্শ। বছরের পর বছর ধরে চলমান যুদ্ধ-বিগ্রহে জলপাইবাগানগুলোর কবর রচিত হয়েছে সেই একই মাটিতে ! একসময়ের সবুজভূমি, তাই এখন বিরান মরুভূমি।
 


সিদ্ধার্থ একেবারে হঠাত্ করেই আবিষ্কার করলো, এ উষর কোথাও বন্ধুর, কোথাও বা সমতল- তার বুকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে সম্পুর্ন ভিন্ন এক শহর ! এ শহরে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তুলকালাম হয়না। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য কিছুই লাগেনা, যে কোন উচ্চতার সামান্য তিনটে পাথর পাশাপাশি দাঁড় করালেই চলবে। উইকেট ! ছাল-চামড়া হারানো টেনিসবলগুলোর আব্রু রক্ষা করছে প্যাঁচানো টেপ। কারো হাতে বল, কারো হাতে ব্যাট। কিন্তু বেশিরভাগের পায়েই স্পঞ্জের স্যান্ডেল। অসংখ্য ক্ষুদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত ক্রিকেট ! সিদ্ধার্থ খেয়াল করে-ব্যাটসম্যানদের বেশিরভাগই অপরিণামদর্শী, কিন্তু বোলারদের অ্যাকশন নিখুঁত এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন চলাকালিন অসংখ্য স্থানীয় পাড়ি জমায় পাকিস্তানে। দেশে ফেরার সময় তাদের ঝুলিতে ছিল ক্রিকেটও। এরপর গোটা দেশে খেলাটি ছড়িয়ে পড়ে সংক্রামক ব্যাধির মতো ! মোহাম্মদ নবীকে মনে পড়ে যায় সিদ্ধার্থের। বেড়ে ওঠা, পেশোয়ারের শরণার্থী শিবিরে। সেখানেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি। দীর্ঘ ১৭ বছর পর কাবুলে ফেরেন মোহাম্মদ নবী। মরুভূমিটা তার অদেখা নয় - ধংস্বপ্রায় বাড়ি-ঘর, রাস্তার আনাচে-কানাচে অবিষ্ফোরিত শেল, দেয়ালে অসংখ্য বুলেটের ক্ষতচিহূ ! কিন্তু, তারপর থেকে এ পর্যন্ত আফগানদের অর্জন কি এতটাই তুচ্ছ যে, নেহায়েত ক্রিকেটের স্বার্থেও তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেললে জায়ান্টদের মান-মযার্দা ধূলিসাত্ হয় ?

ক্রিকেট রাজনীতির এসব হালচাল বোঝা বড় কঠিন ব্যাপার। এ সময়ের মাঝে তিনটি টি২০ বিশ্বকাপ খেলেছে আফগানরা। এখন দরজায় কড়া নাড়ছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সাদা পোশাকটা বাগিয়ে নিতে নিজেদেরকে প্রমানের এটাই সবচেয়ে বড় মঞ্চ। আফগানরা তা জানে বলেই, এখন তাদের ক্রিকেট সম্পর্কিত যে কোন কাজেরই শেষ মাথায় থাকে দুটি দেশের নাম-অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড।
খেলাটির প্রতি তাদের এ রোমান্সের বীজ পোঁতা রাস্তায়, নয়তো পতিত বিরানভূমিতে। চার্চের সঙ্গে নানদের যে সম্পর্ক, আফগানদের সঙ্গে ক্রিকেটের বন্ধনও এখন ঠিক ততোটাই গভীরে প্রোথিত। কিন্তু ইতিহাস মনে রাখবে, শুরুতে ‘সে’ ছিল ভিনদেশী এক লাজুক বধু, যে কি-না খুব সহজেই আফগানদের মোহাবিস্ট করে সীমান্ত পাড়ি দেয় তাদেরই সঙ্গে ! এতদিনে বেশ ডাগর হয়ে ওঠায়, এখন ‘তার’ প্রেমে মশগুল  ছেলে থেকে বুড়ো ! আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহজাদা মাসুদ স্বীকার করে নিলেন, সে সত্য,‘বিমানে করে বেশ নিচু দিয়ে আফগানিস্তান পাড়ি দিলে, আপনি শুধু ক্রিকেট খেলাটাই দেখতে পাবেন।’


এর আগে মোহাম্মদ নবীর সঙ্গে আলাপচারিতার সময় তার ফোনে একটি ভিডিও দেখেছিল সিদ্ধার্থ। স্থানীয় টি২০ টুর্নামেন্টের ফাইনাল। ভেনু-আমেরিকান কনস্যূলেটের দান-খয়রাত নিয়ে বানানো কাবুল স্টেডিয়াম। সিট খালি থাকা তো দুর অস্ত, গ্যালারীর স্ট্যান্ডগুলোও ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। বিজ্ঞাপনের তক্তা ধরেও ঝুলেছে অনেকেই ! এরপরও পিলপিল করে আসছিল দর্শক। শেষ পর্যন্ত, টিভিতে লাইভ টেলিকাষ্ট করে কয়েকবার স্টেডিয়ামে যেতে মানা করার পর ক্ষান্তি দেন আফগান ক্রিকেটপ্রেমীরা। আরও মজার বিষয়, ক্রিকেট নিয়ে কিছু গানও রচনা করা হয়েছে। আইপিএলের মতো গ্লামার সবর্স্ব নয়, নিখাদ ক্রিকেটিয় অনুভূতিতে ভর্তি সেসব গানের চরণ।
আফগানিস্তানের দক্ষিনাঞ্চলে একেবারে দুর্গম অঞ্চলের শহর মারজাহ। সেখানকার গল্পটা আফগান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নুর মোহাম্মদের কাছ থেকে আগেই শুনেছে সিদ্ধার্থ। মারজাহ’তে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করা খুব দুরহূ ব্যাপার। কিন্তু ক্রিকেটের জন্য এটা কোন ব্যাপারই না। অঞ্চলটির কচি-কাঁচাদের কাছে, লম্বা কেশের পেসার শাপুর জাদরান এবং গতিমানব হামিদ হাসান রীতিমতো কমিক বইয়ের হিরো ! তারা সবাই এ দুই পেসার সমন্ধে খোলনলচে জানতে আগ্রহী। স্থানীয় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়ে কমিক বই প্রকাশের পর থেকে এ পরিবর্তন।

সিদ্ধার্থ বুঝতে পারে, আফগানিস্তানের উন্নয়নে এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- ড্রাগ এবং সন্ত্রাস। ক্রিকেট দিয়ে যে এ ক্ষত সারানো সম্ভব এবং আফগানরা যে ধীরে ধীরে সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝে নিতে সময় লাগেনা সিদ্ধার্থের। জালালাবাদ যাওয়ার আগে শাহজাদা মাসুদ অনেকটা নাছোড়বান্দার মতোই তাকে এ ব্যাপারে একটা ধারণা দেন,‘গোটা দেশটাই এখন ক্রিকেটে আচ্ছন্ন। এই একটি মাত্র খেলা, যা ছায়াতলে আজ সবাই একতাবদ্ধ। আফগানিস্তান উপজাতিতে ভর্তি। সোভিয়েত আগ্রাসন, জিহাদি এবং তালেবান শাসনামলে সবাই একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জাতিগত দাঙ্গা এখানে একেবারেই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু ক্রিকেট দিয়ে গোটা আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব। এ কারণে জাতীয় দল জিতলে দেশের সব ধরণের জাতিগোষ্ঠি একত্রে উত্সব করে। ক্রিকেটই সবাইকে একসুত্রে গেঁথেছে।’


২০০১ সালে তালেবান শাসনের পতন ঘটার আগে আফগানদের অনেকেই পাকিস্তানের শরনার্থী শিবির থেকে দেশে ফিরে আসে। তখন মোহাম্মদ নবীর মতো আরও কিছু ক্রিকেটার সংক্ষিপ্ত সফরে দেশে আসতেন। কিন্তু চারপাশের ভগ্নদশা দেখে খোদ জন্মভূমিই তাদের কাছে হয়ে ওঠে অপ্রিয়। নবীর ভাষায়,‘যুদ্ধে সবকিছুই ধংস্ব হয়ে যায়। রাস্তাঘাট থেকে বাড়িঘর-কোনকিছুই টিকে থাকেনি। তখন মনে হতো পেশোয়ারেই আমরা সুখে আছি। কারণ ওখানে শান্তি আছে, স্বাধীনতা আছে এবং অতি অবশ্যই ক্রিকেট খেলার পর্যাপ্ত সুব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তানে কয়েকদিন থাকার পর পেশোয়ারে আর ফিরে যেতে ইচ্ছা হয়নি। তখন বুঝতে পেরেছি, জন্মভূমির টান কি জিনিস ! ২০০২ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যাই। এরপর থেকে একটি ম্যাচেও আমি বসে থাকিনি।’


সিদ্ধার্থ ভেবে দেখে, ক্রিকেটের সঙ্গে শাহজাদা মাসুদের জড়িয়ে পড়া একেবারেই কাকতালীয় ব্যাপার। আফগানিস্তানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের উপদেষ্টা ছিলেন মাসুদ। ২০০১ সালে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার পর ক্রিকেট দল গঠনের প্রস্তাব পান তিনি। অথচ, খেলাটি সমন্ধে মাসুদ তখন ক অক্ষর গোমাংস ! বোঝা তো দুরের কথা, কিছুই জানতেন না। একবার ব্রিটিশ সাংবাদিকের কাছে মাসুদ খুব আশা নিয়ে বলেছিলেন, তার দেশ একদিন বিশ্বকাপে খেলবে। সে কথা শুনে সাংবাদিকটি হো হো করে হেসে দেন। ক্রিকেট নিয়ে শাহজাদা মাসুদের আড়মোড়া ভাঙ্গার জন্য ওই হাসিটুকু ছিল যথেষ্ট। এখন টেস্ট ক্রিকেটই তার কাছে সবচেয়ে উপাদেয়।

আফগানিস্তানে অ্যান্ডি মোলসের আগমনের পটভূৃমিও মনে পড়ে সিদ্ধার্থের-ওয়ারউইকশায়ায়ের এ সাবেক ব্যাটসম্যান কেপটাউনের গোছালো জীবন ছেড়ে চলে আসেন এ যুদ্ধবিধ্বস্ত উষর মরুভূমির দেশে। তার ভাই ব্রিটেনের অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিটে কাজ করেন। সহোদরের বিরোধিতা এবং ব্রিটিশ সরকারের হাজারো যুক্তিকে পায়ে ঠেলে আফগানিস্তানকে নতুন ঠিকানা করে নেন মোলস। এদেশে পা রাখার আগে কেপটাউনে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্রিকেট দীক্ষা দিতেন এ কিউই। সে অভিজ্ঞতা থেকে মোলস বুঝতে পারেন, কেপটাউনের সেই শিশুদের তুলনায় আফগানদের জীবন আরও দুর্বিষহ। অসম্ভব কষ্টসহিঞ্চুতা এবং জীবনের প্রতি খিদে না থাকলে এখানে বেঁচে থাকাই দায় ! ‘জাতীয় দলে এমন বেশকিছু খেলোয়াড় আছেন, যাদের আত্নীয়-স্বজনদের বেশিরভাগকেই অপহরণের পর হত্যা করেছে তালেবান। বেশিরভাগ ক্রিকেটারই বেড়ে উঠেছে পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে। সেখানে পর্যাপ্ত পানি এবং বিদ্যূত্ সুবিধা ছিলনা। শিক্ষার অভাবটাও ছিল চোখে পড়ার মতো। এখান থেকে উঠে দাঁড়ানো কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয় ! প্রচন্ড প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও কিভাবে সুখ সুখে নিতে হয়, আফগানরা তা জানে। জাতীয় দলের এক ক্রিকেটার আমাকে বলেছে, কিভাবে তার চোখের সামনে গোটা পরিবারকে মেরে ফেলে মার্কিনি ড্রোন। এসব অভিশাপময় স্মৃতি থেকে মুক্তির জন্য সবাই বেছে নিয়েছে ক্রিকেটকে’-সিদ্ধার্থকে এক ফাঁকে বলেছিলেন মোলস।

তাহলে, আফগানরা কি শুধু একটা গোছালো জীবনের তাগিদেই ক্রিকেট খেলে -নিজেকেই প্রশ্ন করে সিদ্ধার্থ। জবাবটা তাকে আগেই দিয়ে রেখেছেন মোলস,‘দেশের প্রতিনিধিত্ব করার ব্যাপারটা সবাই বোঝে। তারা আসলে যে অবস্থা থেকে শুরু করেছে, সেখান থেকে এ পথ পর্যন্ত পৌঁছানো বাকি ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর পক্ষে বোধহয় শুধু স্বপ্নেই সম্ভব। ভুলে গেলে চলবে না, দেশটা একটা জীবিত যুদ্ধক্ষেত্র। প্রতিদিনই খেলোয়াড়দের জীবন থাকে হুমকির মুখে। এ অবস্থায় তাদের জনসাধারণের মন জয় করে চলতে হয়। এটা মোটেও কোন সাধারণ জীবন-যাপন নয়।’


পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে ক্রিকেট খেলা শিখতে পারা-আফগানদের কাছে গর্বের। এক্ষেত্রে দায়ী ভৌগলিক এবং সামাজিক নৈকট্য। পেশোয়ার এবং জালালাবাদকে বিচ্ছিন্ন করেছে শাসকরা। জনগন তো করেনি ? এ কারণে একই দেশভুক্ত হওয়ার পরও পেশোয়ার এবং করাচির মধ্যে সিদ্ধার্থ কোন মিল খুঁজে পায়না, যতটা পরিলক্ষিত হয় পেশোয়ার এবং জালালাবাদের মধ্যে।


শাহজাদা মাসুদের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় একটা প্রশ্ন করেছিল সিদ্ধার্থ-‘আফগানিস্তানের এ দলটাকে আপনার কখনো ভাড়াটে বলে মনে হয়নি’ ? জবাবে আফগান ক্রিকেটের এ মাথা যা বলেছিলেন, তা অনেক তারকা ক্রিকেটারে দেশপ্রেমের ক্লাসে অবশ্যপাঠ্য ,‘আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করার সময় তাদের কাছে আফগান পাসপোর্টটাই থাকে। সবাই জানে তাদের বাবা-মা আফগানিস্তান ছেড়েছিল তাদেরই ভালোর জন্য। বাবা মায়ের এ ত্যাগটা খুব বেশি অনুভব করে ক্রিকেটারেরা। যুদ্ধে নিহতের পরিমান প্রায় ১৫ লাখ। এ সংখ্যাটা তাদের দেশপ্রেমের জন্য যথেষ্ট।’
মোহাম্মদ নবীদের পরবর্তি প্রজন্ম নিয়ে দেশপ্রেমের প্রশ্ন ওঠার সুযোগ নেই। সবাই আফগানিস্তানেই বেড়ে উঠেছে। ফরিদ আহমেদ তাদেরই একজন। গত জানুয়ারীতে পাকিস্তানের অনুর্দ্ধ-১৯ দলের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৭ উইকেট নিয়ে একাই ছিঁড়েখুড়ে দেন এ পেসার। নয়মাস পর তার ডাক পড়ে জাতীয় দলের ক্যাম্পে। নবীদের সঙ্গে তার অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জল।

ফরিদের বাবা জালালাবাদেরই নিকটবর্তী একটি এলাকায় বসবাস করেন। তথ্যটা জানার পর সিদ্ধার্থের আগ্রহ দেখে সাইদ রহমান ফরিদের বাবাকে ডাকার ব্যবস্থা করেন। সম্পুর্ণ বিনা নোটিশে ফরিদের বাবা অতিথি আপ্যায়নের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তা ভুলতে সময় লাগবে সিদ্ধার্থের। সে নিরামিষাশী-কথাটা জানার পর একেবারে ভোজবাজির মতো টেবিলে খাবারের মেন্যূ পাল্টে যায়। ফিরে আসার সময় সিদ্ধার্থের হাতে নিজের বন্দুকটা তুলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন ফরিদের বাবা-‘আফগানিস্তানে থাকতে হলে এটার প্রয়োজন আছে।’
-অতিথিসেবার যে দৃষ্টান্তস্থাপন করেছেন, তারপর এটার দরকার কি ?
-আফগানদের অতিথিসেবার অর্ধেকও আপনার কপালে জোটেনি। এক কাজ করুন, আমাদের গ্রামে আজকের রাতটা থেকে যান। তাহলে বুঝতে পারবেন।
ফরিদের বাবাকে সবাই ডাকে ‘মালিক কাকা’। ছেলে ঝাঁপ দেয়ার পরই ক্রিকেটপাড়ে বাবার আর্বিভাব। এখন দুজনেই হাবুডুবু খাচ্ছেন । একজন খেলোয়াড় হিসেবে, আরেকজন মজা লুটছেন তার ভক্ত হয়ে। ফরিদ যে ম্যাচে ৭ উইকেট পায়, মোবাইলে তার ভিডিও সিদ্ধার্থকে দেখান মালিক কাকা। তার দেখার ফাঁকে মালিক কাকা বলে চলেন,‘সাতটি আউটের মধ্যে পাঁচটি উইকেটের পেছনে। বাকি দুটি এলবি এবং বোল্ড। ব্যাটসম্যানেরা কোন ভুল করেনি।’
সিদ্ধার্থ আড়চোখে খেয়াল করে, কথাগুলো বলার সময় মালিক কাকার চোখের ভাষা পাল্টে যায়। ‌দুটি চোখে নহর ধারার মতো ঝরে পড়ে প্রশান্তি !

হাজি অামানুল্লাহ। ইজাতুল্লাহ দৌলতজাইয়ের গর্বিত পিতা। ছেলে তার উঠতি প্রতিভা। আমানুল্লাহ সামান্য দোকানদার। পাশের এলাকা আরজান কিমত' ( সস্তা দামের)-এ মুদিখানা চালান। আফগানিস্তার কুখ্যাত কারাগার পুল-এ-চরখি পাশেই জায়গাটা। সাত বছর হলো বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। ইজাতের ভাই জানায়, ক্রিকেটে তাদের শৈশবেই হাতেখড়ি ঘটে। ঝাঁটাকে উল্টো করে ধরে ব্যাট বানিয়ে দুই ভাইয়ের খেলা শুরু। ইজাতের মধ্যে স্ফুলিৃঙ্গ দেখতে পেয়েছিলেন আমানুল্লাহ। কিন্তু তাকে প্রদীপ বানাতে চাই পরিচর্যা। এজন্য প্রয়োজন অর্থের ? ইজাতের চাচা ওয়েম্বলির পাশে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করেন। সিদ্ধার্থ জানতে পারে, এই যে ইজাত চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার- এ পর্যন্ত উঠে আসার নেপথ্যে রয়েছে পাউন্ড। আমানুল্লার বাড়িটা পাল্টে গেছে । এখন গোটা পরিবার একসঙ্গে বসে ইজাতের খেলা দেখে টিভিতে।

উইকেটকিপার আফসার জাজাই উঠে এসেছেন আরও গরীব জনপদ থেকে। চিলিশতুন সড়ক থেকে জলকাদায় ভর্তি একটা ঘুপচি গলি। আফসারের বাবার সঙ্গে দেখা করতে এ পর্যন্তও এসেছিল সিদ্ধার্থ। এসাজান পেশায় ট্যাক্সি ড্রাইভার। কিন্তু আফসারের গর্বিত পিতা। সিদ্ধার্থ তাকে্ বলেনি, আফগানিস্তানে আসার আগে তাকে ট্যাক্সিতে ওঠার ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। নিরাপত্তাই তার প্রধান অজুহাত। আফসারদের পরিবার যে ঘরে বসবাস করে তার ছাদ একেবারেই ঠুনকো। বছরের শেষ নাগাদ সম্ভাব্য তুষারপাতের সঙ্গে লড়াইয়ে ছাদটা যে হেরে যাবে, তা আন্দাজ করে নিতে অসুবিধে হয়না সিদ্ধার্থের। কিন্তু তার আন্দাজে ছিলনা, অমন কাকডাকা ভোরে আফগানরা কিভাবে আতিথ্যসেবার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে পারে ! কেটলিভর্তি দুধচা, নান এবং হরেকরকম পিঠা !

কাবুল স্টেডিয়ামের বিকেলগুলো অসাধারণ !

ডাক্তারি বিদ্যায় ট্রেনিং নিয়েছেন আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নুর মোহাম্মদ। স্টেডিয়াম স্টাফদের চোখে-ডক্টর সাহিব। খেলোয়াড়দের মাথা থেকে পা পর্যন্ত, সবকিছুর দেখভালের দায়িত্ব তার কাঁধে। নুর মোহাম্মদই কাবুল স্টেডিয়ামের সর্বেসর্বা। ধোপধুরস্ত স্যূট পড়ে অফিসে আসেন। বের হন ট্রাকস্যূট পড়ে। ইনডোরে গিয়ে ফুটবল খেলেন। কোচ, স্টাফ, ইলেকট্রিশিয়ান, পিওন-কোন ভেদাভেদ নেই। খেলাটার জন্য শুধু ইচ্ছের প্রয়োজন। শুধু জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে নিয়মটা আলাদা। অনুশীলনের ক্লান্তি চেপে না ধরলেই কেবল, তারা খেলতে পারেন। কোন বাঁধাধরা সময় নেই। শরীর যতক্ষন সায় দেবে ততক্ষন খেলা চলে। এরপর কুলডাউন এবং চা-বিস্কিট। সিদ্ধার্থের কাছে মনে হয়, স্কুলে গ্রীষ্মকালিন ছুটির সময় বন্ধুদের সঙ্গে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলার পর মায়ের ডাকে ঘরে ফেরার আগে শরীরে প্রচন্ড অবসাদ স্বত্তেও বাতাসে ঘুসি মেরে চলা চঞ্চল ছেলেটির মতোই-এরা সবাই।

হঠাৎ একজনের ডাকে সিদ্ধার্থের ভাবনা টুটে যায়। বদলি হয়ে মাঠে নামতে হবে। টাচলাইনের ভেতরে পা রাখার পরই খেলা নিয়ে আফগানদের খোলতাই আবেগের গোপন কুঠুরীর দরজাগুলো এক এক করে খুলে যায় তার সামনে। কাবুল স্টেডিয়ামে ঢোকার পর থেকে প্রায় পাঁচ মিনিট পর পর ''তার কোন অসুবিধে হচ্ছে কি-না' -এমন প্রশ্ন করে বিরক্ত করেছে যে লোকটি, সে তার বিপক্ষ গোলকিপার। শুধুমাত্র এজন্যই ডিফেন্সের নামে সিদ্ধার্থকে কষে লাথি মারতে লোকটি দ্বিতীয়বার ভাবেনি ! তার সতীর্থদের কাছে পর্যন্ত ভুলের কোন ক্ষমা নেই। অথচ, খেলাটা নাকি প্রীতি ম্যাচ ! মোলসের কথাগুলো মনে পড়ে যায় সিদ্ধার্থের,‌‌'আফগানদের আবেগ নির্ভেজাল। ওদের মুখ দেখেই সব বলে দেয়া যায়। কিন্তু ওরা যেন নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে, আমরা সেই চেষ্টাই করছি।'

খেলোয়াড় থেকে সমর্থক-সবাই জানে ক্রিকেটের পথে আরও এক কদম এগিয়ে যেতে আবেগই তাদের প্রধান অস্ত্র। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে গজেন্দ্রগামিতার সুযোগ নেই। কি বস্তি, কি রিফুজি ক্যাম্প, যেখান থেকেই উঠে আসুন না কেন-এখানে সবাই ফলাফল চায়। গত এশিয়া কাপে তারা বাংলাদেশকে হারায়। মোহাম্মদ নবীর বিশ্বাস, বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রত্যেক ম্যাচেই তারা জেতার মতো দল, 'আমাদের সিমাররা ওদের থেকে ভাল। ব্যাটসম্যানেরাও তুলনামুলক বেশি আক্রমণাত্নক। ওদের স্পিন এবং ফিল্ডিং ডিপার্টমেন্ট ভাল। কিন্তু আমরা শারীরিক দিক থেকে বেশি শক্তিশালি।' মজার ব্যাপার জয়ের ১৫ দিন পরই টি২০ ম্যাচে সেই একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আফগানরা মাত্র ৭২ রানে অলআউট হয় !

-'অামার কাছে মারাঠি সিনেমা খুব পছন্দের' রাতে খাবারে সিদ্ধার্থের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে আলাপ জমানোর চেস্টা করে সেই গোলরক্ষক-দৌলত আহমেদজাই। অবসর নেয়ার পর এখন একাডেমির কোচ।
সিদ্ধার্থ ভীষন অবাক হয়। মারাঠি মনে তো মহারাষ্ট্র ? সিদ্ধার্থ আরেকটু খোলাসা করে জানতে গিয়ে বুঝতে পারে দক্ষিণের ছবির কথা বলছেন দৌলত আহমেদজাই। আফগান ছবি সম্পর্কে তার কাছ থেকে সিদ্ধার্থ একটা ধারণা পায়,' আমাদের নায়ক সামান্য একটা কোদাল দিয়ে কালাকাশিনভের অজস্র গুলি ঠেকাতে পারে' !
বর্ষীয়ান আফগানই দিলীপ কুমার এবং কাদের খান বেশি জনপ্রিয়। বলিউডের এ দুই তারকার শেকড় প্রোথিত আফগানিস্তানে। এখানকার সেলুনের দেয়ালে রাজত্ব করেন শাহরুখ খান। ফুটবল খেলায় খেলায় ফাউল করলে নুর তাকে ডাকেন-অমরেশ পুরী ! সিদ্ধার্থ জানে, এ চিত্র সীমান্তের দুই পাড়ের মিথস্ক্রিয়ারই অংশ। সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার তো থাকছেই। প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য দিল্লি ছুটে যায় অসংখ্য আফগান নর-নারী। ভারতকে তারা সত্যিকার অর্থেই ভালবাসে। কিন্তু ভারতীর্য় ক্রিকেট কি তাদের পাত্তা দেয় ? নাকি নাক সিঁটকাতে পারলে বাঁচে ? সিদ্ধার্থ নুরের কাছ থেকে জেনেছে, গত বছর এক মিটিংয়ে বিসিসিঅাই সভাপতি শ্রীনিবাসন তাকে সরাসরি বলেন, দশ মিনিট সময় পাবে। এরমধ্যে যা বলার বলো।
আফগান জাতীয় দল কখনো ভারতের বয়সভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গেও খেলার সুযোগ পায়নি। ভারতের অত্যধূনিক ট্রেনিং একাডেমিগুলোতে সময় কাটানো তো অনেক দুরের ব্যাপার !

ভারতের ঠিক বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান। দেশটিকে বলা যায়, আফগান ক্রিকেটের ‌'পালক পিতা'। আফগান ‌'এ' দল এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার পাকিস্তান সফর করেছে। লাহোরের জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি মোহাম্মদ নবীদের নখদর্পনে। সেখানে তাদের মিসবাহদের মতোই অধিকার । আর্ন্তজাতিক আঙিনায় আফগানদের প্রথম প্রতিপক্ষও পাকিস্তান। যদিও এই মুহুর্তে পাকিস্তানকে খুব একটা পছন্দ করতে পারছে না আফগানরা। রাজনৈতিক বিবেচনায় তো প্রশ্নই ওঠেনা।

ভূ-রাজনীতি আসলে খুবই জটিল বিষয়। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের ভৌগলিক নৈকট্য অস্বীকার করার উপায় নেই। হামিদ কারজাই একবার বলেছিলেন-‌'আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান দুই অবিচ্ছেদ্য সহোদর।' ডুরান্ড লাইন সীমান্তের এপার-ওপারের পশতু জনগোষ্ঠিকে শুধু ভৌগলিকভাবেই আলাদা করতে পেরেছে। কিন্তু তাদের শরীর এবং মনের মিথস্ক্রিয়া থামানো সম্ভব হয়নি । পাকিস্তান এখনো আফগান মাটিতে প্রতি নিয়ত রক্তের হোলি খেলে চলা তালেবানের নিরাপদ আশ্রয়স্থল । এসব ভাবনার ফাঁকে সিদ্ধার্থের মনে ঘা মারে বেশ প্রচলিত একটি কৌতুক-‌'ভারত হলো, আফগানিস্থানে সেই প্রেমিকা, যাকে তারা কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তাই সুবিধা বুঝে পাকিস্তানকে বিয়ে করেছে আফগানিস্থান' !


সিদ্ধার্থ ভেবে দেখে, তার দেশের এমন বিমাতাসুলভ আচরণ আফগান ক্রিকেটের জন্য একদিক থেকে শাপেবর। দড়ির বাইরের দুনিয়াটা কত স্বার্থপর- তা বোঝার মাধ্যমে খুব ধীর গতিতে হলেও আফগান ক্রিকেটের উন্নতি কিন্তু থেমে নেই । বাংলাদেশের মুখোমুখি হয়ে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করবে তারা। এজন্য কোন ভাতা নেই ! বোনাসের প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু তারপরও চ্যালেঞ্জটা জীবিত - বাংলাদেশ এবং স্কটল্যান্ডকে অবশ্যই হারাতে হবে। এরপর অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং শ্রীলংকার মধ্য থেকে যে কোন এক 'দৈত্য'কে পরাভূত করা-তাহলেই পরবর্তি রাউন্ডে উত্তরণ। ক্রিকেটের পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়াও বলা যায়।


গ্রীক পুরাণের 'ফিনিক্স' পাখির কথা মনে পড়ে যায় সিদ্ধার্থের। আফগান জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটারদের বেশিরভাগই যুদ্ধশিশু। কিন্তু দড়ির ভেতরে সবাই সমান। শুধু জয়ই তাদের একসুত্রে গেঁথে রাখতে পারে। হতাশা অাছে, বাধাও বিস্তর ; কিন্তু, আশার কথা হলো প্রত্যাশার পরিমাণটাও নেহায়েত কম নয়।


জন্মভূমি এবং পরিবারের বিরোধিতা উপেক্ষা করে এখানে কাজ করছেন কোচেরা। কাবুলে তাদের প্রাত্যহিক জীবনের রোজনামচা একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ফোরহুইল ড্রাইভের পশমী সিটে গা এলিয়ে দিয়ে সিদ্ধার্থ তার ভাবনার পাখা মেলে দেয়-

আচ্ছা, সে চলে যাওয়ার পরও তো সাইদ রহমানকে ক্রিকেট সর্ম্পকিত নানা প্রশ্নবানে অস্থির করা থেকে নিস্তার দেবে না ক্ষুদেরা ? লন্ডনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও তো সামান্য ফুরসত পেলেই ইজাতের ওপর নজর রাখবেন তার চাচা ? ফরিদ উইকেট পেলে আনন্দের আতিশায্যে নিশ্চয়ই আকাশপানে কয়েক রাউন্ড একে-৪৭ এর গুলি খরচ করবে তার গর্বিত পিতা ? আগামি শীতে আরেকটু ভাল ঘরের আশায় বুক বেঁধেছেন আফসার ? এতসব আশার মাঝে কেউ কেউ তাদের পেশাদারিত্বকে আরও একধাপ এগিয়ে নেবে। বাকিরা হয়তো ভুলে যাবে জাতিগত সহিংসতা। ঐক্যবদ্ধ হবে একই সীমানার ছায়াতলে। স্বপ্নের চারাগাছে এখন থেকেই জলসিঞ্চন করছে অনেকে- আমার সন্তানকেও যদি মোহাম্মদ নবী বানাতে পারতাম ! ব্যবসায়ীরা দিনরাত খেটে চলছেন। নবী-শেহজাদদের মুখ বেচে কিভাবে, আরও দুই পয়সা বেশি রোজগার করা যায় ? প্রশাসকদের লক্ষ্যও অভিন্ন। সত্যিই, এই বিশ্বকাপ তার বাকি সন্তানদের কাছে হতে পারে মহাগুরুত্বপুর্ণ, কিন্তু আফগানদের কাছে তা বাঁচা-মরার লড়াই।

প্রাগৈতিহাসিক কালের অতিকায় হস্তী লোপ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই একই কালের ক্ষুদ্র তেলাপোকা তো আজও টিকে আছে স্বমহিমায় ?  তেলাপোকা নয়, ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভষ্ম থেকে উড়াল দিতে চায় আফগানরা। আর তাই, বিশ্বকাপে রোজ প্রত্যুষে ধূমায়িত ‌'সেঞ্চা'র সৌরভে মৌ মৌ করবে প্রতিটি আফগান কুঁড়েঘর। কান পাতলে, নান রুটির দেহ কয়েক টুকরো হওয়ার শব্দও হয়তো ভেসে আসবে ! তখন এ যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাটি কি কেবল শুধুই উষর মরুভূমি ? নাকি -'‘ইস দ্যশত ম্যেইন এক শেহের হ্যায়' ?

('দ্য ক্রিকেট মান্থলি' সাময়িকীতে সিদ্ধার্থ মঙ্গার প্রতিবেদন অবলম্বনে গত বছরের জানুয়ারীতে লেখা ফিচার)