এক যে ছিলেন রিচি বেনো
পোস্টটি ১৭৮৭ বার পঠিত হয়েছেবছর খানেক আগে বাসায় আপু-দুলাভাই-ভাইয়ারা মিলে সবাইকে বুফে (BUFFET) বানান জিজ্ঞেস করছিলেন আর মজা নিচ্ছিলেন। কারণ কেউ-ই সাইলেন্ট ‘টি’ পর্যন্ত আর আসতে পারছিল না। সেটা নিয়ে বেশ হাসাহাসি, হৈ চৈ হচ্ছিল। যখন সত্যিকার ‘বুফে’ বানান উদ্ধার হলো তখন সবার প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘ওহ, বাফেট!’ বাফেট-ই যে বুফে সেটা-ই অনেকে বুঝতে পারেনি। বেশ মজার ব্যাপার ছিল।
আপনি চাইলে রিচি বেনো’র নাম নিয়েও এমন মজা করতে পারেন। এখানেও যে একটা সাইলেন্ট ‘ডি’ আছে। রিচার্ড বেনো থেকে রিচি বেনো (BENAUD) হওয়া এই ভদ্রলোকের নামেই কেবল সাইলেন্ট কিছু একটা ছিল, নইলে জীবনভর অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে সরব ব্যাক্তিটি বোধকরি তিনি-ই ছিলেন।
পরপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন ১০ই এপ্রিল ২০১৫তে। তারও প্রায় বছর খানেক আগে গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে, সবচেয়ে সরব মানুষটি হয়ে গিয়েছিলেন কিছুটা নীরব-নিশ্চুপ। বলা ভালো, নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। নইলে ‘ক্রিকেট-ই জীবন’ এই আপ্তবাক্য মনে-প্রাণে ধারণ করা এই মানুষটি কি আর এত সহজে পিছু হটেন! সড়ক দূর্ঘটনা আর ত্বকের ক্যান্সার তাকে মৃত্যুর আগেই দিয়ে দিয়েছিল অন্যরকম এক মৃত্যু। মাইক্রোফোন হাতে ছুটে বেড়ানোতেই যার আনন্দ, ক্রিকেট-মাঠের সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণেই যার পরিতৃপ্তি, সেই তাঁর সেসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া কতটা কষ্টকর হতে পারে, আন্দাজ করতে পারেন?
কে জানে, কতটা কষ্ট বুকে চেপে এই পৃথিবী কে ‘বিদায়’ বলেছিলেন বেনো!
শুধু একটা নাম, কেবলমাত্র ‘রিচি বেনো’ বললেই বলা হয়ে যায় অনেক কথা। নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার বালাই নেই। নেই তাঁর কীর্তিগাঁথা, রস-কষ মিশিয়ে পরিবেশনার ঝক্কি! তিনি অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের একটা প্রতিষ্ঠান, একটা সুবিশাল স্তম্ভ, এক সুবৃহৎ মহীরুহ... কিংবা তার চেয়েও বেশী কিছু।
দু’শ উইকেট আর দু’হাজার রানের যে 'ডাবলস ক্লাব' তার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ও’রিলি-ক্ল্যারি গ্রিমেটের রেখে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিন শিল্পকে অন্য মাত্রায়-ই কেবল পৌছে দেননি, ভবিষ্যতের ওয়ার্ন-ম্যাকগিল তৈরীর অনুপ্রেরণাও হয়তো সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। অন্য যে কারো জন্যেই হয়তো এসব বেশ তৃপ্তিদায়ক। কিন্তু একজন রিচি বেনোর পাশে এসব যে বড্ড ম্রিয়মান দেখায়!
অধিনায়ক হিসেবে অজি-ক্রিকেট কে দূর্দান্ত একটা সময়-ই শুধু উপহার দেননি, পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই দিয়েছেন না-ভোলার মতো কিছু সময়। সাত বছর পর এ্যাশেজ পুনরুদ্ধার তো ছিলই। আরো ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই সিরিজ। যে সিরিজ ‘টাই’ ম্যাচের জন্যেই ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে আছে। অথচ সে সিরিজে ‘রিচি বেনো’ নামের এই মানুষটি ‘স্যার ওরেল’ এর সাথে তাল মিলিয়ে বাঁধনহারা আনন্দ-সঞ্চারী যে ক্রিকেট উপহার দিয়েছিলেন, তাতে সমগ্র ক্রিকেট-ই কি কম উপকৃত হয়েছিল! ক্রিকেট-বিমুখ দর্শকদের ক্রিকেট-মাঠমুখী করতে তাঁর এই অবদান তো হীরকখন্ড দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতোই ছিল।
শুধু কি অধিনায়ক? ক্রিকেট সংগঠক, ক্রিকেট বিশ্লেষক, ধারাভাষ্যকার থেকে শুরু করে কি ছিলেন না, বেনো? ওয়ানডে ক্রিকেট বদলে দেয়া ‘ক্যারী প্যাকার’ সিরিজে যুক্ত হওয়া, চ্যানেল নাইনের সাথে চুক্তি... কত কি! এমনি এমনি কি আর ‘রিচি বেনো’ একজন মানুষ কিংবা ক্রিকেটারের গন্ডি ছাড়িয়ে একটা ‘প্রতিষ্ঠান’ হয়ে যান!
৮৪ বছর বয়সে তাঁর দৈহিক সত্ত্বার হয়তো অবসান ঘটেছে। কিন্তু তাঁর কি অবসান হয়েছে? অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সামারে শ্বেত চুল আর চ্যানেল নাইনের মাইক্রোফোন হাতে অনেক গুলো রিচি বেনো’র মাঝে কি তিনি ফিরে আসবেন না?
কে জানে, যেখানে গেছেন সেখান থেকে কখনো-সখনো এক-আধটু ক্রিকেট মাঠে ঢুঁ মারার অনুমতি পাবেন কি না!
- 0 মন্তব্য